কাদিসিয়্যার যুদ্ধ এবং এক সাহাবার শাহাদাত বরণের মহান কাহিনী
কাদিসিয়্যার যুদ্ধ এবং এক সাহাবার শাহাদাত বরণের মহান কাহিনী - ছবি : সংগৃহীত
গল্প-প্রিয়তা মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা। একটি গল্প মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি বিনির্মাণে বহুমাত্রিক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মানুষের কল্পনার বিস্তার ও সৃজনশীলতার প্রখরতা বৃদ্ধির জন্য প্রাচীনকাল থেকেই গল্প-বলার রীতি প্রচলিত আছে। বিশেষত শিশু-মনোস্তত্ত্ব-বান্ধব হওয়ায় গল্প-বলার শৈক্ষিক উপযোগিতা সর্বজনস্বীকৃত। এ কারণে আমাদের স্কুল লেবেলের পাঠ্যসূচিতে গত দুই দশক আগেও যেসব গল্প আমাদের শিশু-কিশোরদের অফার করা হতো, তা কতটুকু গঠনমূলক ও মেসেজ অরিয়েন্টেড বিবেচনা করেই নির্বাচন করা হতো।
কিন্তু বর্তমান সময়ে বিশ্বায়নের নামে ভৌগোলিক ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের বিলুপ্তি সাধন করে একটি বহুজাতিক ও অভিনব বিশ্বব্যবস্থা চালু করার প্রয়াসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনাপ্রসূত জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপরিচয়গত বৈচিত্র্যে একমাত্রিকতা আনয়নের এ প্রচেষ্টায় আমাদের শিশু-কিশোররা সর্বাগ্রে আক্রান্ত হয়। তাদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের সব দ্বার প্রায় রুদ্ধ করা হয়। বর্তমানে শিশুদের জন্য যেসব গল্প-কবিতা পাঠ্য করা হয়েছে, তার অধিকাংশই প্রতীকীবাদী ও মেসেজবিহীন। এতে শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ও বন্ধনের কথা শিল্পায়িত না করে তাদের এক অলীক, লক্ষ্য বিবর্জিত ও কল্পনাপ্রসূত জগতে বিচরণের দিকে ধাবিত করা হয়। তাই আমাদের শিশু-কিশোরবান্ধব পাঠ্যক্রম প্রণয়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তা না হলে আমরা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নিবেদিত ও প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরিতে ব্যর্থ হবো এবং আগামী দিনের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতা হারাব। সুতরাং এ বিষয়টি নিয়ে ভাবার এখনই সময়।
আমাদের পূর্বসূরি মুসলিমদের নিত্যদিনের প্রতিটি মুহূর্তের পথচলায় আমাদের জন্য রয়েছে আদর্শ গল্প। আমরা তাদের জীবনী পাঠ করি না বলে গল্প জগতে গঠণমূলকতার সঙ্কট বিরাজ করছে। আমাদের ওয়াজ মাহফিলগুলোতে এসব জীবনজাত গল্পের প্রকট অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এসব দ্বীনি আলোচনায় ইসলামের থিওরিটিক্যাল রূপ প্রাধান্য পায় বলে এসব ওয়াজের আবেদন বহুমাত্রিকতা ও কালজয়ীতা অর্জনে সক্ষম নয়। অথচ কুরআনের এক বৃহৎ অংশজুড়ে আছে নবী-রাসূল ও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সত্য কাহিনী। এসব কাহিনী সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন : আমরা ওহির মাধ্যমে নাজিলকৃত এই কিতাবে তোমাকে সুন্দরতম গল্প শুনাই। অথচ তুমি (এসব গল্পের ব্যাপারে) ছিলে অনবগত। (সূরা ইউসুফ) যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এসব গল্পকে সুন্দরতম ও উত্তম বলে অভিহিত করেছেন, সেখানে কী করে এসব গল্প আমাদের পাঠ্য হয় না, তা সত্যিই বিস্ময়কর। অথচ এসব গল্পের মাধ্যমে কুরআনের সাহিত্যমান যেমন চিত্তাকর্ষক, হৃদয়গ্রাহী ও আনন্দময় হয়ে সব সত্যব্রতী মুমিনের মনের খোরাক জোগায় তেমনি এসব গল্প কুরআনের বিষয়বস্তুর সরলীকরণ ও স্পষ্টায়িতকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে বলে কুরআন-সম্পৃক্তরা মনে করেন। তাদের বিবেচনায় একটি শিল্প সার্থক ও কালোত্তীর্ণ গল্প নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান আল-কুরআন ও হাদিসের গল্পে নিহিত আছে।
সা’ঈদ বিন জায়েদ রা:-এর জান্নাতে যাওয়ার গল্পটি রাসূল সা:-এর হাদিস থেকে নেয়া একটি আদর্শ গল্প। এ গল্পটি আমাদের ঈমান-দীপ্ত হৃদয়কে নাড়া দেয়। ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের প্রেরণায় রাখে উন্মুখ। আমাদের মনের গভীরে জাগিয়ে তুলে স্রষ্টাপ্রেমের আকুতি। প্রজ্ব¡লিত করে জান্নাতে যাওয়ার ঈমান-দীপ্ত বাসনাকে।
আল-কাদিসিয়্যা যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী প্রান্তরে রোজাদার সা’ঈদ বিন জায়েদ রা: যখন টানা তিন দিন মুসলিম সৈন্যবাহিনীর পাহারায় থেকে খানিকটা ক্লান্ত-অবসন্ন। তখন তাঁবুর প্রবেশদ্বারে পাহারারত সাহাবি আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল-আনসারী তাকে বললেন : হে সা’ঈদ তুমি তো টানা তিনি দিন ঘুমাওনি। আল্লাহর কসম করে তোমাকে অনুরোধ করি! তুমি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। আমি ততক্ষণ গোহার পাহারা দিতে থাকব। এ কথায় আস্বস্ত হয়ে সাঈদ রা: তাঁবুতে প্রবেশ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। আর যথারীতি আবদুল্লাহ রা: তাঁবুর পাহারা দিতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর পাহারারত আবদুল্লাহ রা: তাঁবুর ভেতর থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি তাঁবুর ভিতরে গিয়ে ঘোমাচ্ছন্ন সা’ঈদের মুখে শুনলেন কিছু আজব কথা। সা’ঈদ বলছিলেন : হে ‘আইনা’ (ডাগর নয়না) হে মুর্দ্বিয়া তোমাকে স্বাগত। না... না আমি ফিরে যেতে চাই না... আল্লাহর কসম ফিরে যেতে চাই না...। এ কথা শুনে আবদুল্লাহ ভাবলেন; হয়তো অতিরিক্ত ঘুমের চাপে জায়েদ এমনটি করছেন। তখন আবদুল্লাহ সা’ঈদকে ডাকতে লাগলেন। খানিকটা সন্ত্রস্ত ও হতচকিত হয়ে সাঈদ ঘুম থেকে উঠলেন। তখন আবদুল্লাহ সাঈদকে বললেন : এমন করছ কেন? কী হয়েছে তোমার?
উত্তরে সা’ইদ রা: বললেন : আবদুল্লাহ তোমাকে একটা গোপন কথা বলব। তবে কসম আল্লাহর আমার মৃত্যুর আগে কাউকে কথাটা বলবে না। আর তুমি তো জানো, কবরে যেমন সব রহস্য-কথার সমাধি হয়, তেমনি একজন মুমিন অপর মুমিনের গোপনীয়তার সমাধিস্থল। তুমি যদি তোমার স্ত্রীকে কোনো গোপন কথা বলো, অথবা সে যদি তোমাকে বলে, তবে এ কথা কখনো তার মাকে, ভাইকে অথবা অন্য কাউকে বলতে যেও না। তুমি এ কথাও জান যে, স্ত্রীর গোপন কথা স্বামী যখন প্রকাশ করে অথবা স্বামীর গোপনীয়তা স্ত্রী যখন প্রকাশ করে, তখন তারা উভয়েই একটি জঘন্যতম কবিরা গোনাহে লিপ্ত হলো। বিশেষত যদি তারা তাদের গোপন অভিসারের কথা প্রকাশ করে।
সাহাবি সাঈদ রা: আরো বললেন : আমি দেখলাম কিয়ামত যেন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর শুনতে পেলাম আকাশ থেকে কে যেন বলছে : মহান আল্লাহ সা’ঈদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন। দেখলাম তিনজন ফেরেশতা আমাকে জান্নাতে নিয়ে গেছেন। আমি জান্নাতের পাহারাদার রেজওয়ানের সাথে হাত মিলালাম। জান্নাতে এমন কিছু সুন্দরী নারী দেখতে পেলাম যা জীবনে দেখিনি। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম : তোমরা কি ঐসব হুর, যাদের কথা কুরআনে পড়েছি? তারা আমাকে বলল : না... আমরা তো তাদের সেবিকা মাত্র। এভাবে আমি যতই পথ চলছি ততই এখানে-সেখানে কিছু অবর্ণনীয় সুন্দরী নারীর দেখা পাচ্ছিলাম। আমি তাদের একই প্রশ্ন করছিলাম আর তারা একই উত্তর দিতে থাকল। শেষ পর্যন্ত আমি পূর্ণিমার চাঁদের মতো দু’জন সুন্দরী ও তাদের মাঝখানে সূর্যের মতো প্রদ্বীপ্ত আলোকময়তায় ভাস্বর আরেকজনকে দেখতে পেলাম। আমি তাদের সালাম করলাম। তারা সালামের উত্তর দিলো। আমি তখন মাঝখানে বসা নারীকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে সে বলল : ‘আমি আইনা, আমি মুর্দ্বিয়া’। আমি তোমার বেহেশতি স্ত্রী। আমি তখন তাকে স্পর্শ করতে হাত বাড়ালাম। তখন সে বলল : আজ না। তুমি এখনো দুনিয়াতে আছ। তুমি আমাদের জন্য এখনো বৈধ নয়। তবে তিন দিন পর তুমি আমাদের জন্য বৈধ হয়ে যাবে। তখন আমি বললাম : আল্লাহর কসম! আমি ফিরে যেতে চাই না। ফিরে যেতে চাই না। ফিরে যেতে চাই না। ঠিক তখনই তুমি আমাকে জাগিয়ে দিলে।
পাহারাদার আবদুল্লাহ আরো বলেন : তখন থেকে আমি যুদ্ধের ময়দানে সা’ঈদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম। এ ঘটনার ঠিক তৃতীয় দিন রোজ বৃহস্পতিবার রোজা রেখে সা’ঈদ রা: প্রাণপণ যুদ্ধ করছিলেন। সূর্য যখন অস্তাচল ঘেঁষে ডুবতে শুরু করেছে ঠিক তখনই একটি তরবারির আঘাতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আমি তার কাছে দৌড়ে গেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম : সা’ঈদ! তোমার আর ইফতার করা হলো না বুঝি? প্রতি উত্তরে সা’ঈদ কুরআনের একটি আয়াত তিলাওয়াত করলেন। যার অর্থ : মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ওয়াদাকৃত সত্যলোকের পরম-আয়েশি আসনে। তারপর সা’ঈদ রা: বললেন : হে ডাগর নয়না-মনোতুষ্টিনী ! এবার তোমায় স্বাগত।
সাঈদ বিন জায়েদ রা:-এর জান্নাতে যাওয়ার এ গল্পটি আদর্শিক দায়বদ্ধতাবোধ ও শৈল্পিকতার উপাদানগত প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ একটি সত্যগল্প। সত্য ঘটনার বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কোনোরূপ অলীকতার আশ্রয়-প্রশ্রয় ব্যতিরেকে কিভাবে একটি শিল্পস্বার্থক ও আদর্শজাত গল্প নির্মাণ করা যায়- এ গল্প তারই নিরেট উদাহরণ। আমাদের ইসলামী সাহিত্যিকরা এসব গল্পের আদলে বিশ্বমানের সাহিত্য নির্মাণ করতে পারেন বলে আমরা মনে করি।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইসলামিক স্কলার