হতাশায় আলোর দিশা
হতাশায় আলোর দিশা - ছবি : সংগৃহীত
হতাশা বা মানসিক অবসাদ একটি নীরব ঘাতকের নাম। আধুনিক সভ্যতা আমাদের জীবনকে গতি দিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের আত্মার সব প্রশান্তিকে কেড়ে নিয়েছে। পৃথিবীজুড়ে মানসিক অবসাদগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। কিন্তু আশার কথা হলো এ ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায় আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর দেখানো পথেই রয়েছে।
আল্লাহ বলেন, ‘আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি দিয়ে এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের যখন তারা বিপদে পড়ে তখন বলে নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই কাছে ফিরে যাবো।’ (২ : ১৫৫-৫৬)
এই আয়াতগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর এখানেই আছে। কেন বিপদ-আপদ, দুঃখ-দুর্দশা আপনার ওপর আপতিত হয়? বিপদগ্রস্ত অবস্থায় আপনি কিভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দেবেন। বস্তুত ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় কিভাবে দুনিয়াবি দুঃখ, কষ্ট থেকে সৃষ্ট হতাশাকে বাস্তবধর্মী এবং সন্তোষজনক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দূর করা যায়। কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে আমরা হতাশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
১. সালাত তথা মেডিটেশন : মানসিক অবসাদগ্রস্ততাসহ বিভিন্ন রকমের মানসিক রোগ দূরীকরণে গবেষকরা সালাতের নিউরো ফিজিওলজিক্যাল প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেন। তারা দেখেন যে, এর প্রভাবে ফ্রন্টাল লোবের (Frontal Lobe) কার্যকারিতা কমে। এ অঞ্চলে রক্ত সঞ্চালন কমে। ফ্রন্টাল লোব আমাদের সব শারীরিক ও মানসিক কার্যক্রমের সময় সক্রিয় থাকে। এর প্রভাবে হতাশা, দুশ্চিন্তা, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD) এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা যখন খুব মনোযোগের সাথে সালাত আদায় করি তখন এটি অসচল হয়ে যায়। এটি সেই মুহূর্তে কোনো তথ্য গ্রহণ করে না। এর ফলে আমাদের মনোজগতে প্রশান্তির অনুভূতি সৃষ্টি হয়। সালাতের মাধ্যমে শরীর ও মনের যে সংযোগ তা মানসিক অবসাদ দূরীকরণে বিস্ময়কর ভূমিকা রাখে।
সালাতে স্রষ্টার সাথে আমাদের হৃদয়ের একক অপার্থিব সংযোগ তৈরি হয়। সালাতকে তাই গবেষকরা শক্তিশালী অ্যান্টিডিপ্রেজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (২ : ১৫৩)
২. তাকদিরে বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল : তাকদিরে বিশ্বাস ঈমানের পূর্বশর্ত। এ বিশ্বাস একজন মানুষকে সব বিপদেও হাল ছেড়ে না দিতে প্রেরণা জোগায়। আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে শেখায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ (৬৫ : ৩)
যা কিছু আমাদের জীবনে ঘটে তা পুনঃনির্ধারিত। নিশ্চয় আল্লাহর পরিকল্পনাই সর্বোত্তম মুমিনদের জন্য। তাকদিরে বিশ্বাস এবং তাওয়াক্কুল আমাদের বিপদ বা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে শেখায়। কি করে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয় তা শেখায়। তাওয়াক্কুল ও তাকদিরে বিশ্বাসীরা প্রশান্তির সাথে বলে, ‘আমার বিষয়টি আমি আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সর্বদ্রষ্টা।’ (৪০ : ৪৪-৪৫)
৩. আশা : আমরা যখন সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করি, তখন আমাদের সব কিছুর জন্যই আল্লাহর ফয়সালাকে মেনে নেই। আশা পোষণ করি যে, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। পৃথিবীর সব দরজা বন্ধ হলেও আল্লাহর রহমতের দরজা আমাদের জন্য সবসময়ের জন্যই খোলা। এর চেয়ে প্রশান্তিকর কোনো অনুভূতি আছে, যে সারা জগতের স্রষ্টা স্বয়ং আপনাকে সান্ত্বনা দিতে প্রস্তুত। ক্ষমা করতে প্রস্তুত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। কেননা কাফিররা ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।’ (১২ : ৮৭)
৪. কুরআন অধ্যয়ন : কুরআন হচ্ছে আমাদের দুনিয়ার জীবনযাপনের রোডম্যাপ। কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন নবীর জীবন থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, কিভাবে চরম সঙ্কটে তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে অটল অবিচল ছিলেন। আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। যখন রাসূলুল্লাহ সা: কোনো বিপদে পতিত হতেন। সেই প্রেক্ষাপটেই ওহি নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা তাকে সান্ত্বনা দিতেন। সে সান্ত্বনার ভাষাগুলো সব মানুষের জন্যই সব সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘এই কিতাব মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনে। পরাক্রমশালী সর্বপ্রশংসিত পথের দিকে।’ (১৪:১)
৫. দোয়া ও ধৈর্য ধারণ : দোয়া বিশ্বাসীদের জন্য এমন এক পদ্ধতি যার মাধ্যমে তারা জীবনের অর্থ খুঁজে পায়। যা তাদের মানসিক শক্তি দেয় দুনিয়াবি পরীক্ষাগুলো সফলভাবে মোকাবেলা করতে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট গবেষণায় দেখেছেন যে, মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানোর থেরাপি বেশ কার্যকর। এই সাইকোথেরাপিকে বলা হয় Cognitive behavioral therapy (CBT). এর মাধ্যমে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসকে উৎসাহিত করা হয়। এতে করে রোগীরা নেতিবাচক ভাবনা দূর করার জন্য ইতিবাচক দক্ষতা ও অভ্যাসকে কাজে লাগাতে শেখে। আমরা দোয়ায় বিনম্র হয়ে স্রষ্টার কাছে সাহায্য চাইব সব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য।
কুরআনে সরাসরি প্রায় ২০০ আয়াত ছাড়াও অনেক আয়াতে প্রচ্ছন্নভাবে বিপদে ধৈর্য ধারণ করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটি এমনই একটি গুণ যা মুসলিমদের সব রকম খারাপ পরিস্থিতিতে প্রশান্ত থেকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে। এ ছাড়া ধৈর্যধারণকারীর জন্য আল্লাহ উত্তম প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তাদের দিলেন দুনিয়ার প্রতিদান এবং আখিরাতের উত্তম সওয়াব।’ (৩ : ১৪৮)
গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক অবসাদে ভোগা রোগীদের মধ্যে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া নিউরোসায়েন্টিস্টরা রিসার্চ করে দেখেছেন যে, আমাদের ব্রেইনে একটি ছোট্ট এলাকা আছে। যা ধর্মীয় চিন্তাচেতনাকে প্রসেস করে। এটিকে তারা ‘স্রষ্টার মডিউল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ধর্মীয় অনুভূতির সময় এলাকাটি সচল হয়ে ওঠে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে এটি বেশ প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে মানসিক সমস্যা থেকে বের হতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আমরা অতি মানবীয় কোনো প্রাণী নই। জীবনের সমস্যা থাকবেই। এ সমস্যাগুলোকে মেনে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিণত করার মাধ্যমেই চরম দুর্দশায়ও আমরা মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকতে পারব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সুতরাং কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ ( ৯৪ : ৫-৬)
মুমিনদের জন্য দুনিয়া তো পরীক্ষা ক্ষেত্র। দুর্লভ কোনো কিছু কি কখনো স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়? তেমনি অতি আকাক্সিক্ষত জান্নাত পেতে গেলে আমাদের নিশ্চয়ই কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কষ্টকর পরিস্থিতির তীব্রতা যত বেশি হয়, তার পুরস্কার তত বেশি। আল্লাহ কাউকে ভালোবাসলে তাকে পরীক্ষা করেন।’ (তিরমিজি-২৩৯৬)
দুনিয়ার দুঃখ, হতাশা ও কষ্টের বিনিময় আখিরাতে আল্লাহ এমনভাবে দেবেন যে আপনি খুশি হয়ে যাবেন। আপনার প্রশান্ত আত্মার জন্যই করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালা জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে, ‘হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি ফিরে এসো তোমার রবের প্রতি সন্তুষ্টচিত্তে।। সন্তোষভাজন হয়ে। আর প্রবেশ করো আমার জান্নাতে। (৮৯ : ২৭-৩০.)
মুমিনের জীবনে জান্নাত ছাড়া আর কোনো শ্রেষ্ঠ চাওয়া কী থাকতে পারে?
লেখিকা : গবেষক ও নিবন্ধকার