আল্লাহর ৪ নির্দেশ
আল্লাহর ৪ নির্দেশ - প্রতীকী ছবি
মুসলমানদের জীবনকে উত্তম উপায়ে পরিচালিত করার জন্য এবং কঠিন থেকে কঠিনতর ছাঁচে জীবনকে গড়ে তোলার জন্য আল্লাহ ভালোবাসাস্বরূপ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। আর এই নির্দেশনার মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্য সফলতার সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ্ তায়ালা নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যে প্রতিযোগিতা করো এবং সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো, আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা আল-ইমরান : ২০০)
এ আয়াতটিতে মুসলিমগণকে চারটি বিষয়ে নসিহত করা হয়েছেÑ এক. সবর, দুই. মুসাবারাহ, তিন. মুরাবাতা এবং চার. তাক্ওয়াÑ যা বাকি তিনটির সাথে অপরিহার্যভাবে যুক্ত।
এর মধ্যে ‘সবর’-এর শাব্দিক অর্থ বিরত রাখা ও বাধা দেয়া। আর কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় এর অর্থ নফ্সকে তার প্রকৃতিবিরুদ্ধ বিষয়ের ওপর জমিয়ে রাখা।
এর তিনটি প্রকার রয়েছেÑ এক. ‘সবর আলাত্ত্বা’আত’। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: যেসব কাজের হুকুম করেছেন, সেগুলোর অনুবর্তিতা মনের উপর যত কঠিনই হোক না কেন তাতে মনকে স্থির রাখা।
দুই. ‘সবর আনিল মা’আসী’ অর্থাৎ যেসব বিষয়ে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সা: নিষেধ করেছেন, সেগুলো মনের জন্য যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন, যত স্বাদেরই হোক না কেন, তা থেকে মনকে বিরত রাখা।
তিন. সবর ‘আলাল-মাসায়েব’ অর্থাৎ বিপদাপদ ও কষ্টের বেলায় সবর করা, ধৈর্য ধারণ করা, অধৈর্য না হওয়া এবং দুঃখ-কষ্ট এবং সুখ-শান্তিকে আল্লাহরই আগত মনে করে মন-মস্তিষ্ককে সে জন্য অধৈর্য করে না তোলা।
‘মুসাবারাহ’ শব্দটি সবর থেকেই গৃহীত হয়েছে। এর অর্থ, শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে দৃঢ়তা অবলম্বন করা। অথবা পরস্পর ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করা।
‘মুরাবাতাহ’ অর্থ হলো, ঘোড়াকে বাঁধা এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। কুরআন ও হাদিসের পরিভাষায় এ শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়Ñ
এক. ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তের হেফাজতে সুসজ্জিত হয়ে থাকা অপরিহার্য, যাতে ইসলামী সীমান্তের প্রতি শত্রুরা রক্তচক্ষু তুলে তাকাতেও সাহস না পায়। এটাই ‘রিবাত’ ও ‘মুরাবাতাহ’ এর বিখ্যাত অর্থ। এর দুটি রূপ হতে পারে : প্রথমত, যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা নেই, সীমান্ত সম্পূর্ণ শান্ত, এমতাবস্থায় শুধু অগ্রিম হেফাজত হিসেবে তার দেখাশোনা করতে থাকা। এ ক্ষেত্রে পরিবার-পরিজনসহ সেখানে বসবাস করতে থাকা কিংবা চাষাবাদ করে রুজি-রোজগার করাও জায়েজ। এমতাবস্থায় যদি সীমান্ত রক্ষাই নিয়ত হয় এবং সেখানে থাকা অবস্থায় রুজি-রোজগার করা যদি তারই আনুষঙ্গিক বিষয় হয়, তবে এমন ব্যক্তির ও ‘রিবাত ফি সাবিলিল্লাহর’ সওয়াব হতে থাকবে। তাকে যদি কখনো যুদ্ধ করতে না হয়, তবুও। কিন্তু প্রকৃত নিয়ত যদি সীমান্তের হেফাজত না হয়, বরং রুজি-রোজগারই হয় মুখ্য, তবে দৃশ্যত সীমান্ত রক্ষার কাজ করে থাকলেও এমন ব্যক্তি ‘মুরাবিত ফি-সাবিলিল্লাহ্’ হবে না।
অর্থাৎ সে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে সীমান্ত রক্ষাকারী বলে গণ্য হবে না।
দ্বিতীয়ত. সীমান্তে যদি শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা থাকে, তবে এমতাবস্থায় নারী ও শিশুদের সেখানে রাখা জায়েজ নয়। তখন সেখানে তারাই থাকবে, যারা শত্রুর মোকাবেলা করতে পারে।
রিবাত বা সীমান্ত রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতের বর্ণনায় হাদিসে এসেছে, সাহল ইব্নু সা’দ রা: থেকে বর্ণিত : নবী সা: বলেন, আল্লাহর রাস্তায় একটি সকাল কিংবা একটি বিকাল অতিবাহিত করা দুনিয়া ও তার ভিতরের সব কিছু থেকে উত্তম। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২৭৯৪)
ফাদালাহ ইবনু ‘উবাইদ রা: সূত্র থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সা: বলেন : প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথে তার আমল শেষ হয়ে যায়, কিন্তু সীমান্ত প্রহরার সওয়াব বন্ধ হয় না। কিয়ামত পর্যন্ত তার আমলের সওয়াব বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং সে কবরের যাবতীয় ফিতনাহ থেকে নিরাপদ থাকবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২৫০০)
এসব বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, ‘রিবাত’ বা ‘সীমান্ত রক্ষার’ কাজটি সদকায়ে জারিয়া অপেক্ষাও উত্তম। কারণ, সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তার সদকাকৃত বাড়ি-ঘর, জমি-জমা, রচিত গ্রন্থরাজি কিংবা ওয়াকফকৃত জিনিসের দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে। যখন উপকারিতা বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার সওয়াবও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে সীমান্ত প্রহরার সওয়াব কিয়ামত পর্যন্ত বন্ধ হবে না। কারণ, সমস্ত মুসলিম সৎকর্মে নিয়োজিত থাকা তখনই সম্ভব, যখন তারা শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকবে। ফলে একজন সীমান্তরক্ষীর এ কাজ সব মুসলিমদের সৎকাজের কারণ হয়। সে কারণেই কিয়ামত পর্যন্ত ‘রিবাত’ কর্মের সওয়াব অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া সে যত নেক কাজ দুনিয়ায় করত, সেগুলোর সওয়াব ও আমল করা ছাড়াই সর্বদা জারি থাকবে।
দুই. কুরআন ও হাদিসে ‘রিবাত’ দ্বিতীয় যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তা হচ্ছে, জামায়াতের সাথে সালাত আদায়ে খুবই যতœবান হওয়া এবং এক সালাতের পরই দ্বিতীয় সালাতের জন্য অপেক্ষমাণ থাকা। এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সা: বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজের সংবাদ দিব না, যা করলে তোমাদের গুনাহ্ মাফ হয়ে যাবে এবং তোমাদের মর্যাদা বুলন্দ হবে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই। তিনি বললেন, তা হচ্ছে, কষ্টকর স্থান বা সময়ে অজুর পানি সঠিকভাবে পৌঁছানো, মসজিদের প্রতি বেশি বেশি পদক্ষেপ এবং এক সালাতের পরে অপর সালাতের অপেক্ষায় থাকা। আর এটিই হচ্ছে, রিবাত।’ (মুসলিম : ২৫১)
বাস্তবে দু’টির মধ্যে মিল আছে। প্রথমটি মানব শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদের অংশ। আর দ্বিতীয় অংশটি জিন শয়তানের বিরুদ্ধে এক অমোঘ অস্ত্র।
‘তাকওয়া’ শব্দটির অর্থ আল্লাহ্ভীতি। উপরের তিনটি কাজ একমাত্র তাক্ওয়া অবলম্বনের মাধ্যমেই সহজ হয়।
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘উদ রা: থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, নবী সা: ( দোয়ায়) বলতেন, ‘‘আল্লাহ-হুম্মা ইন্নি আস্আলুকাল হুদা-ওয়াত্তুকা-ওয়াল ‘আফা-ফা ওয়াল গিনা-’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে হিদায়াত [সঠিক পথ], তাকওয়া [পরহেজগারিতা], হারাম থেকে বেঁচে থাকা ও অমুখাপেক্ষিতা প্রত্যাশা করি)। (মুসলিম: ২৭২১)
আমরাও রাসূল সা:-এর শেখানো দোয়াটি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করব যাতে আল্লাহর এই চারটি নির্দেশ পালন আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। আমরা যাতে সবরের সাথে অপেক্ষায় থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করে যেতে পারি।
লেখিকা : কবি, সাহিত্যিক ও ইসলামী গবেষক