লাইলাতুল কদর : কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

লে. কর্নেল (অব:) এ কে এম মাকসুদুল হক | May 20, 2020 06:38 am
লাইলাতুল কদর

লাইলাতুল কদর - সংগৃহীত

 

 

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন : লাইলাতুল কদর রমজান মাসের কোনো এক রাতে হয়। (২ঃ১৮৫, ৪৪ঃ৩-৪, ৯৭ঃ০১) মূলত এই রাতটিতে কুরআন নাজিলের জন্যই এর মর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। এই রাতের ব্যাপারে প্রায় ৪০টির মতো হাদিস আছে। ওই সব হাদিসের সার হলো : শেষ দশকে রাতটি লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তবে শেষ দশকের কথা থাকলেও ২১ থেকে ২৯ শে রমজান পর্যন্ত বেজোড় রাতগুলোর ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মহিমান্বিত রাতটি বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে আবর্তিত হয়। আর বিভিন্ন ধরনের সুস্থ-অসুস্থ, বৃদ্ধ ইত্যাদি ধরনের মানুষ নবীজীকে সা: ওই রাতের বিষয়ে বিভিন্ন বছরে এবং বিভিন্ন তারিখে ও সময়ে প্রশ্ন করে উত্তর জেনে নিয়েছেন বলেই হয়তোবা এতগুলো বর্ণনার অবতারণা হয়েছে। রাসূল সা: সাধারণের জন্য শেষ দশকের রাতসমূহ; দুর্বল, বৃদ্ধদের জন্য শেষ বোজোড় অথবা ৭ রাত এবং অসুস্থের জন্য শুধু ২৭ শে রাত উল্লেখ করেছেন বলে উক্ত হাদিসগুলো নিয়ে চিন্তা করলে মনে হয়। তবে তিনি নিজে শেষ দশক কঠিনভাবে পালন করেছেন, তা পাওয়ার জন্য ইতেকাফ করেছেন। আসলে এই নমনীয়তা হলো ইসলামের সৌন্দর্য। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে এই রাতের সুনির্দিষ্ট সময় জানিয়ে তা আবার ভুলিয়ে দিয়েছেন। এই ভুলিয়ে দেয়াটাকে রাসূল সা: উম্মতের জন্য কল্যাণকর বলেছেন।

প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সব বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হলো আত্মিক উৎকর্ষতা সাধন। কাজেই সুনির্দিষ্ট সময়ের পরিবর্তে ৭ থেকে ১০ দিনের একটা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বান্দাহর পরম আত্মিক উন্নতি ও আল্লাহ তায়ালার সাথে তৃপ্তিমূলক সম্পর্ক সৃষ্টির সুযোগ রাখা হয়েছে। আর এই উদযাপনকারী সময়টা সূর্যাস্ত থেকে ফজরের উদয় পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।

লায়ল শব্দের অর্থ রাত। আর শব শব্দের অর্থ রাত, এটি একটি ফারসি শব্দ। আমাদের পূর্ব পুরুষগণ ফারসি ভাষায় জ্ঞানচর্চা করতেন বলে এই শব্দ আমরা পেয়েছি। কাজেই লায়লাতুল কদর বা শবে কদর বলতে কদরের রাতকে বুঝায়। কদর অর্থ : ১. মাহাত্ম্য, সম্মান, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব; ২. তাকদির, ভাগ্য, আদেশ ইত্যাদি। কদরের রাত শ্রেষ্ঠ বা সম্মানিত এ জন্য যে, এই রাতে পৃথিবীর ইতিহাসের এবং ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে বিশ্বজনীন নবী, কিতাব এবং ওহির অভিষেক হওয়ার মাধ্যমে। আবার কদর অর্থ ভাগ্য বা আদেশ এ জন্য যে, এই রাতে পৃথিবীতে আগামী এক বছরে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা, জন্ম, মৃত্যু, রোগ, অর্জন ইত্যাদির কার্যাদেশ সংশ্লিষ্ট কার্য সম্পাদনকারী ফেরেশতাগণের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। কাজেই মহা সম্মানিত এই রাতকে পালন করার লক্ষ্যে ঈমানদারগণের জন্য রয়েছে বিশেষ বোনাস। সেটা হলো এই রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

আরবরা তখন মিলিয়ন বা বিলিয়ন জানত না, তাই হাজারই ছিল তাদের সর্বোচ্চ সংখ্যা বা অসংখ্য হিসাব। কাজেই এই রাতের ইবাদত শুধু এক হাজার নয় বরং অসংখ্য মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এই রাতে হজরত জিবরাইল আ:-এর নেতৃত্বে ফেরেশতা অবতরণ করে ইবাদতে মশগুল বান্দাহদের জন্য দোয়া করেন এবং সালাম পৌঁছে দেন।

রাসূল সা: বলেন : ‘লায়লাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় কিয়াম (সালাত) করবে, তার পূর্বের সব পাপ মোচন করা হবে।’ (বোখারি : ১৮০২, মুসলিম : ৭৬০) হজরত মা আয়শা রা: লায়লাতুল কদর রাতের দোয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে রাসূল সা: পড়তে বলেন : ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করা তুমি পছন্দ করো, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও।’ লায়লাতুল কদরের আমল : নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন, জিকির, দোয়া এবং তৃপ্তির সাথে ক্ষমা চাওয়া (তিরমিজি : ২৫১৩)।

বোখারি শরিফে এ বিষয়ে ৯টি হাদিস থেকে দেখা যায়, ৮টিতেই বলা হয়েছে লায়লাতুল কদরকে তালাশ করতে। অর্থাৎ রাসূল সা: কদরের রাতকে তালাশ করতে বলেছেন। এই তালাশের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো কুরআনের মহত্ত্ব অনুধাবন করা বা সমস্ত চিন্তাচেতনা দিয়ে কুরআনকে উপলব্ধি করা। আমরা যদি যোগসূত্র ধরে পেছনের দিকে কুরআনের ভূমিকার দিকে যাই, দেখতে পাবো কুরআন অনুসরণ করাই এই রাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য। দেখা যাক ধারাবাহিকতায় কী আসে : ১. কুরআন নাজিল হয়েছে কদরের রাতে (৯৭:১) ২. এই রাতটি রবকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ (৪৪:৩) ৩. নাজিলের মাসটি হলো রমজান মাস। আর তা নাজিল হয়েছে বিশ্বমানবতার পথের দিশারি এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী ও সঠিক পথের সুস্পষ্ট বর্ণনাকারী হিসেবে। এই কুরআন প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতাস্বরূপই রমজানের সিয়াম পালন করতে হবে (২:১৮৫) ৪. এই সিয়ামের মাধ্যমে ঈমানদারগণ মুত্তাকি হতে পারবে (২:১৮৩) ৫. আর এই মুত্তাকিদেরই কুরআন পথ প্রদর্শন করে (২:২)।

সাধারণত মুত্তাকি হলো : যারা শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে দয়াময় আল্লাহ তায়ালাকে সার্বক্ষণিকভাবে নিজের সত্তায় উপস্থিত জেনে ভালো কাজ করতে থাকে ও মন্দ এড়িয়ে চলে। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর তালাশ করতে হবে কুরআনকে আলিঙ্গন করার জন্য। আর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুত্তাকি হতে পারলেই তবে বুকে বরণ করা এই কুরআন থেকে সত্য পথের সন্ধান মিলবে।

দয়াময় আল্লাহ্ আমাদের সবার জীবনে লায়লাতুল কদরের উদ্দেশ্য সফল করুন। আমিন। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সব ভালো কাজ কবুল করুন। ভুল-ত্রুটির জন্য আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের মাফ করুন। আমিন।

লেখক : অধ্যক্ষ ,বাদশাহ্ ফয়সল ইন্স্টিটিউট (স্কুল অ্যান্ড কলেজ)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us