ইসলামে কি ব্যক্তির প্রশংসা করা যায়?
ইসলামে কি ব্যক্তির প্রশংসা করা যায়? - ছবি : সংগ্রহ
ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিম সমাজ হবে ব্যক্তিত্ববান মানুষ দ্বারা ভরপুর আলোকিত একটি সমাজ। যে সমাজে থাকবে না কোনো শঠতা, তেলবাজি বা বাড়াবাড়িমূলক স্বভাব; যাতে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য ও প্রতারণার দ্বার উন্মুক্ত হয়। মুসলিম সমাজে মানুষের চরিত্র হবে অত্যন্ত খোলামেলা, হৃদ্যতাপূর্ণ ও সুস্পষ্ট। তাদের কথা ও কাজের মধ্যে থাকবে না কোনো বৈপরীত্য। আর না তারা একে অন্যের তোষামোদি বা তেলবাজি করে যে যার যার সুবিধা লুফে নিবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে আমোদের মুসলিম সমাজ এমনই এক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত যে, তা আজ এক তোষামোদের সমাজে পরিণত হয়েছে। কেউ সুবিধা আদায়ের জন্য, কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে অথবা অসুবিধায় পড়ে একে অন্যের অযাচিত প্রশংসায় লিপ্ত হয়। এক দিকে চলে পেছনে পেছনে চরম পরচর্চা অন্য দিকে চলে মুখোমুখি অতি প্রশংসা। পরচর্চার পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যক্তি প্রশংসা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, অধিকার এবং মানুষের ব্যক্তিত্বকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করে। ফলে ইসলামে এ উভয় প্রকার বাড়াবাড়িমূলক কাজকেই অতি নিন্দনীয় ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। নিচে ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি প্রশংসার নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
প্রশংসা-স্তুতির বিষয়ে প্রথম মূলনীতি হলো, ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।’ অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি জগতগুলোর প্রতিপালক। পবিত্র কুরআনের প্রারম্ভে বর্ণিত সূরা ফাতিহার এই ঘোষণার মাধ্যমে সব প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য সুনির্দিষ্ট (খাস) করে দেয়া হয়েছে; যা তাওহিদ ও সকল প্রকার ইবাদতের মূলভিত্তি। কাজেই এ বিষয়ে যখনই ভিন্ন কোনো পন্থা অবলম্বন করা হয়, তখনই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় শিরকের দ্বার উন্মোচিত হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় মূলনীতি হলো, ইসলামে আত্মপ্রশংসা হারাম। যে ব্যক্তি নিজে নিজের গুণগান বা আত্মপ্রচার করে বেড়ায়, ইসলামের দৃষ্টিতে সে ঠুনকো ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং নেতৃত্ব বা ইমামতির উপযুক্ত নয়। ফলে মুসলিম সমাজে তার অবস্থান অনেক নি¤œ পর্যায়ে, কিন্তু ওই ব্যক্তি নিজেকে যত উপরেই ভাবুক না কেন। হাদিসে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছেÑ ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান, যে নিজের সমালোচনা করে।’ [আবু দাউদ]।
আকিদাগত দিক থেকেও সকল প্রকার প্রশংসা করা হবে একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। যাকে বলা হয় ‘হামদ’। আর ব্যক্তি চরিত্রের প্রশংসা করা করা হবে আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূল আ: গণের, যাকে বলা হয় ‘নাত’। এতদ্ব্যতীত মুসলিম মাত্রই অন্যের প্রশংসা বিষয়ে অত্যন্ত সাবধান থাকতে হবে যে, তিনি কী করতে যাচ্ছেন!
ইসলামে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রেরিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:-এর চারিত্রিক প্রশংসাও করতে হয় বিধিবদ্ধ নিয়ম মেনে। যেমন নামাজে ও নামাজের বাইরে তাঁর প্রতি দোয়া-দরুদ পাঠ করার বিধিবদ্ধ নিয়ম রয়েছে; যা রাসূলুল্লাহ সা: স্বয়ং নিজে উম্মাহকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজের ব্যাপারেও সাহাবিদেরকে অতিরিক্ত প্রশংসায় প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে আমার সাহাবিরা, তোমরা তোমাদের নবীর ব্যাপারে এমন কোনো প্রশংসায় প্রবৃত্ত হবে না, যেমন করেছিল তোমাদের পূর্ববর্তীরা। তারা (খ্রিষ্টানরা) তাদের নবীর প্রশংসা করতে করতে তাঁকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। অথচ তিনি (ঈসা আ:) ছিলেন আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল।’ একজন নবীর প্রতি এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে যে, উম্মতরা তাকে প্রভু বানিয়ে ফেলে! অতএব নবী-রাসূলগণের প্রশংসার ব্যাপারেও সাবধান থাকতে হয়, যাতে কোনো প্রকার অতিশয়োক্তি বা বাড়াবাড়ি করা না হয়।
সাধারণত উদ্দেশ্য হাসিলকে সামনে রেখে কোনো ব্যক্তির প্রশংসা বা তোষামোদে প্রবৃত্ত হওয়া জায়েজ নয়। ইসলাম এ কাজকে অতি গর্হিত ও নীতিবিবর্জিত স্বভাব হিসেবে দেখে থাকে। কেননা তা সম্পূর্ণরূপে ‘আলহামদুলিল্লাহর’র খিলাফ। এ ছাড়া সার্বিক দিক বিবেচনায় বিষয়টি শিষ্টাচার বিরোধী এবং অসামাজিক কার্যকলাপের আওতাভুক্ত। এ জন্য হাদিস শরিফে দেখা যায়, যখনই কেউ সামনে উপস্থিত ব্যক্তির প্রশংসা করত, রাসূলুল্লাহ সা: স্বয়ং তাতে বাধা দিতেন এবং তার বিরোধিতা করে বক্তব্য পেশ করতেন। অনুরূপভাবে সাহাবিদের সামনেও কেউ প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করলে তাঁরা তা ভীষণভাবে অপছন্দ করতেন এবং সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করতেন। এ সম্পর্কিত দলিল আমরা একটু পরেই উল্লেখ করছি।
এ পর্যায়ে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এবং কী কারণে ব্যক্তি প্রশংসাকে রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবিগণ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন। যদিও এতে মানুষের জন্য উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনার কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। আরো মনে করা হয় যে, প্রশংসার দ্বারা তো মানুষের কর্মক্ষমতা ও উদ্ভাবনী শক্তি আরো বেড়ে যায়। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এতে সামান্য উপকারিতা পরিলক্ষিত হলেও বাস্তবে এর নেতিবাচক এমন সব অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে যা ঈমান, আমল ও বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যেমন, কারো মুখোমুখি প্রশংসা করা হলে-
আল্লাহর সাথে শিরক হতে পারে।
মনের মাঝে অহঙ্কার সৃষ্টি হতে পারে।
নিয়্যাহ ও ইখলাস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
লোকদেখানো আমলের প্রবণতা বাড়তে পারে।
অন্তরে শয়তানের কুমন্ত্রণা সৃষ্টি হতে পারে।
অসত্য বলতে হতে পারে।
অবৈধ সুবিধা আদায়ের কারণ হতে পারে।
প্রশংসার ছলে তিরস্কার করাও উদ্দেশ্য হতে পারে। ইত্যাদি।
এতদসংশ্লিষ্ট কারণে হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থে ব্যক্তি প্রশংসা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে অসংখ্য বর্ণনা ও ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে এখানে কয়েকখানা হাদিস তুলে ধরা হলো।
এক. হজরত আবু বকর রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা:-এর মজলিসে এক ব্যক্তির প্রশংসা করা হলো। তিনি তা শুনতে পেয়ে বললেন, ‘সর্বনাশ! তুমি তো তোমার ভাইয়ের গলা কেটে দিলে!’ এ কথা তিনি বারবার উচ্চারণ করলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘তোমাদের কারো যদি একান্তই প্রশংসা করতে হয়, তাহলে এরূপ বলবে- আমার ধারণামতে তিনি এরূপ। অবশ্য যদি সে সত্য সত্য সে রূপ হয়ে থাকে। অথচ তার প্রকৃত অবস্থা তো আল্লাহই ভালো জানেন। আর আল্লাহর সম্মুখে কেউ নির্দোষ নয়।’ [সহিহ বুখারি]।
দুই. হজরত আবু মুসা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সা:এক ব্যক্তিকে আরেক ব্যক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শুনলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি তো তাকে হত্যা করে ফেললে, অথবা তার পিঠ কেটে ফেললে।’। [আদাবুল মুফরাদ]।
তিন. হজরত ইবরাহীম তাঈমী রা: তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা আমি হজরত উমারের দরবারে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি মুখের সামনে অপর এক ব্যক্তির প্রশংসা করল। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি তো তাকে জবাই করে দিলে। আল্লাহ তোমার বিনাশ করুন!’ [আদাবুল মুফরাদ]।
চার. হজরত আবু মা’মার বলেন, এক ব্যক্তি জনৈক আমিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার প্রশংসা করছিল। হজরত মিকদাদ তার মুখের ওপর বালু ছুড়ে মারেন এবং বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: আমাদেরকে প্রশংসাকারীর মুখে বালু নিক্ষেপ করতে আদেশ করেছেন।’ [আদাবুল মুফরাদ]।
এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত উমর রা: অনুরূপ এক প্রশংসাকারীর মুখে বালু ছুড়ে মেরেছেন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, তৎকালীন আরবে কোনো কথা বা কাজে কেউ যখন চরম অসন্তোষ বা অপন্দনীয় কিছু পেত, তখন তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করার পরিবর্তে মুখে বালু নিক্ষেপ করা হতো। এতে চরম বিরক্তি ও বিরাগ প্রকাশ পেত।
অপর এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত আলী রা:-এর যখন প্রশংসা করা হতো তখন তিনি এই দোয়া করতে করতে ওই স্থান ত্যাগ করতেন যে, ‘হে আল্লাহ, আমি আমাকে অন্যের চেয়ে ভালো চিনি, আরো ভালো চেনো তুমি। অতএব তারা আমার ব্যাপারে যা ভাবে, আমাকে তার চেয়েও উত্তম করে দাও এবং আমার সব পাপ ক্ষমা করে দাও, যা আমি অসতর্কাবস্থায় করে ফেলেছি।’
উপরোল্লিখিত হাদিসগুলোয় রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবিদের কাছ থেকে ব্যক্তি প্রশংসা বা তোষামোদ সম্পর্কিত যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে, তাতে একজন ব্যক্তিত্ববান মুসলিমের পক্ষে এমন হীন কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া মোটেও সমীচীন নয়। এতে অপরের পাশাপাশি নিজের ব্যাপারেও ভুল বিশ্বাস তৈরি হয় এবং নিজের অজান্তে আত্মোপলব্ধির অনুভূতি হ্রাস পায়। অন্য দিকে অতিশয় প্রশংসিত ব্যক্তি যদি সমাজের ক্ষমতাশালী কেউ হয়, তা হলে সে আরো স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দেখা দেয়। কাজেই সর্বাবস্থায় ব্যক্তি প্রশংসা থেকে বিরত থাকা উত্তম।
ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তির যদি প্রশংসা করতে হয়, তা হলে এতটুকুন বলা যায় যে, তিনি একজন ভালো লোক। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর অনেক সাহাবির ব্যাপারে অনুরূপ বলেছেন। যেমন, হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে ভালো লোক আবু বকর, ভালো লোক উমর, ভালো লোক আবু উবাইদাহ, ভালো লোক উসআদ ইবনে উযাইর, ভালো লোক সাবিত ইবনু কায়স, ভালো লোক আমর ইবনুল জামুহ ও ভালো লোক মুআজ ইবনু জাবাল!’ [আদাবুল মুফরাদ]। সুতরাং এটিই হচ্ছে ব্যক্তি প্রশংসার একমাত্র সঠিক রীতি, যা রাসূল সা: থেকে প্রকাশ পেয়েছে। এমনিভাবেই মানুষকে সত্যিকারভাবে অণুপ্রাণিত করা হয় এবং মূল্যায়ন করা হয়। অথচ এতে ব্যক্তির কোনো ক্ষতি করা হয় না।
লেখক : গবেষক