মুক্তিযুদ্ধের বার্তাবাহক হাসির মা
মুক্তিযুদ্ধের বার্তাবাহক হাসির মা - ছবি : সংগ্রহ
আমি তখন খুবই ছোট। তারপরও কেন যেন মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দেখার স্মৃতি, মনে পড়ে যায় সেই হৃদয় দেবার তিথি। হালকা-পাতলা শ্যামলা বর্ণের এক তরুণী বাঙালির আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ফরিদপুর ছেড়ে এসেছিলেন আমাদের গ্রামে স্বামীর হাত ধরে, সাথে ফুটফুটে ছোট্ট একটি কন্যা শিশু। সম্পর্কে দাদি হলেন তিনি, দাদি তো সবাই বয়স হলে হয় কিন্তু এ তরুণী মহিলা দূর-সম্পর্কে দাদার বউ হবার কারণে হলেন আমার দাদি। শুরুতেই বলেছি, বয়স আমার বেশি না তবে দাদির সঙ্গে রং-তামাশা করা যায় এতটুকু বয়স হয়ে গেছে। তা একবার দাদিকে বলেছিলাম, ও দাদি তুমি কি বাঙালি? দাদি কড়া উত্তরে তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন ‘হ্যাঁ আমি বাঙালি আর তোরা হলি সব পাঞ্জাবি’।
যাই হোক প্রতিবেশী দাদা আমাদের তেমন স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন না, দিনমজুরের কাজ করতেন। দাদি তার মেয়েকে নিয়ে আমার মাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। দাদির মেয়ের নাম ছিল হাসি, সেক্ষেত্রে হাসির মা বলেই অনেকে তাকে ডাকতেন। মূলত আমরা তাকে দাদি বলে সম্বোধন করাকে তিনি পছন্দ করতেন না। করবেনই বা কী করে অল্প বয়সের একজন নারীকে দাদি বললে নিশ্চয় মন খারাপ হবারই কথা তখন। আর আমি তো তখন ছোট, অতো কিছু বুঝি নাকি? তবে আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা যে সেটা বুঝতেন, সেটা গতকাল টের পেলাম যখন ভাইকে দাদির ব্যাপারে কিছু বলতে বলেছিলাম। বড় ভাই সবসময় হাসির মা পরে দাদি শব্দটি যোগ করলেন।
যাইহোক হাসির মা দাদি সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে বড় ভাই দাদিকে ফ্লাইং বার্ড বলেছেন, বলেছেন ফ্রি ল্যান্সার, বলেছেন অলস, বলেছেন প্রতিবাদি, বলেছেন বার্তা বাহক। কারণ এগুলোই নাকি মূলত বাঙালির বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে ফরিদপুর, যশোর এবং কুষ্টিয়ার মানুষের পুরনো ইতিহাস ঘাটলে সত্যিকারার্থে তখনকার মনীষীদের জীবনী এমনটিই ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুচিত্রা সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শেখ মুজিবসহ হাজারও উদাহরণ রয়েছে যারা কোনো এক সময় চাপে এবং তাপে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে নানাভাবে বিপ্লবমুখর হয়েছিলেন এবং এরা সবাই কিন্তু তাঁর নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজস্ব মেধার গুণেই আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে দেশ তথা গোটা বিশ্বকে আলো দান করেছেন, যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি চিত্রজগত, পেয়েছি বাঙালির বাঙালিত্ব, পেয়েছি সোনার বাংলা, পেয়েছি বিশ্ব কবি, পেয়েছি জাতির পিতা।
আমার মেমোরিতে যতটুকু তথ্য রয়েছে তাতে মনে হয় হাসির মা দাদি দারিদ্র্য মোচনে নয়, বরং ভালেবাসার টানে ফরিদপুর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন নবগঙ্গা নদীর তীরে নহাটা গ্রামে, গ্রামটি বর্তমান মাগুরা জেলাধীন। দাদি বাঙালির বাঙালিত্বকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের এলাকায় এবং বিদ্রোহের বার্তাবাহক হিসেবে হুঁশিয়ারি সংকেত দিয়েছিলেন সেদিনের সেই প্রথম দেখায় যখন আমার কথার উত্তরে বলেছিলেন 'তোরা পাঞ্জাবি'। এই মুহূর্তে স্মৃতির জানালা খুলে চেয়ে দেখছি, যতোটুকু আলো আসছে মনে, সে আলোয় দাদির সে রাগান্বিত বার্তা দেখতে পারছি। ভাবছি! তাই বুঝি সেই অল্প বয়সে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিলাম শুধু আজীবনের মতো পাঞ্জাবি শব্দটাকে মুছে ফেলতে। যে কথা সেই কাজ, সরিয়েছিলাম সেই শাসক গোষ্ঠীকে, মুক্ত করেছিলাম বাঙালির বাঙালিত্বকে। দাদি আজো বেছে আছেন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, কারণ, হতে পারে আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের বংশ পরিচয়- অতীতে কী ছিলাম আর বর্তমানে কী হয়েছি।
আমাদের দাদি অতিসাধারণ একজন মানুষ। তার জীবনের ছোটখাটো ঘটনার সাথে আমি মোটামুটি সচেতন। তবে আমার মা-বাবা মারা যাবার পর কিছুটা হালকা হয়েছে সম্পর্কের। আমার লাস্ট ভ্রমণ সম্ভবত ২০১৪ সালে, দু'দিন নহাটাতে ছিলাম। তখন কিন্তু বলতে গেলে পুরো সময়টুকু তার সাথে কেটেছিল আমার। সুখ-দুঃখের অনেক কথা শেয়ার করেছিলেন তখন। কেন যেন মনে আসেনি তখন দেশ স্বাধীন হলো, কেউ পেলো, কেউ শুধু হারালো। ৭১ এর যুদ্ধে হারালেন দাদি তার বাড়ি, ১২-১৩ বছরের মেয়ে হাসিকে এবং পরে তার স্বামীকে পাঞ্জাবিদের নির্মম অত্যাচারের কারনে। দাদির হারানোর গল্পের শেষ হয়নি বা সমাজ তথা দেশ থেকে তেমন কিছু পায়নি, কিন্তু কেন? সে আলোচনা হয়নি। আমার বাবা-মা হারানোর ব্যথা আমার মনে তখন যেভাবে হাহাকার করে ব্যস্ত রেখেছিল আমাকে, দাদি সেটা লক্ষ করেছিলেন তাই হয়তো তার দুঃখের কথা শেয়ার করে আমার দুঃখের বোঝা বাড়াতে চেষ্টা করেননি সেদিন! হঠাৎ দাদির ছোট্ট একটি ভিডিও দেখে মনে হলো তার দারিদ্র্য চরমে। দিনে কোনোক্রমে দু-এক বেলা খেয়ে না-খেয়ে থাকেন। নহাটা বাজারে গিয়ে তার চিকিৎসা করানোর কোনো সাধ্য নেই। তাঁকে চিকিৎসা করাতে না পারলেও তাঁকে অবহেলা করা আমাদের ঠিক হবেনা।
আমি মনে-প্রাণে আশা করি রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সবাই যেন আমাদের এই বেঁচে থাকা বাঙালি দাদির জন্য কিছু করি এক সঙ্গে। আমরা যদি সোনার বাংলায় আবারও একটি পয়লা বৈশাখ পাই, যেন বৈশাখের মেলায় অনেক মানুষের ভিড়ে দাদিকে দেখতে পাই। দাদির মুখে যেন শুনতে পাই মেলায় গিয়েছিলাম শুনলাম একটা ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে, কী দারুণ! বাঁশি যে আসলেই ডাকাতিয়া হয়, এর আগে বিশ্বাস করিনি। এই শীতেই যেন আমরা দাদিকে একটি বিশেষ উপহার দিতে পারি। দাদির জন্য আমরা সবাই ছোট্ট একটি ভালোবাসার সুখের ঘর তৈরির কাজ শুরু করেছি। দাদির মুখে যেন এবারের বৈশাখে হাসির কখা শুনতে পাই।
শেষে বলতে চাই, হে বাংলাদেশ!
আজও প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তোমায় মনে পড়ে। আজ আমার জীবনে অনেক কিছু আছে, তবু মনে হয় কী যেন নেই! আমার এই হৃদয়জুড়ে আজ অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে আছে, তোমাকে না পাওয়ার শূন্যতা। তোমার ফেলে যাওয়া স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে নিঃস্ব হয়ে আজও বেঁচে আছি। বিধাতার কাছে আমার একটাই চাওয়া, জীবনের শেষবেলায় হলেও যেন দেখতে পাই তুমি সত্যিকার সোনার বাংলা হয়েছো, যেখানে হাসির মা দাদির মতো কেউ পরের দুয়ারে আর হাত না পাতে শুধু একটু অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থানের জন্য! আমিন।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com