করোনার স্বাস্থ্যবিধি : কী বলে ইসলাম
মসজিদ - ছবি সংগৃহীত
ইসলামের প্রতিটি বিধান ও নিয়ম-নীতির নিজস্ব কিছু নজরিয়্যাত বা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। যা না জানা বা না বোঝার কারণে ইসলাম সমর্থন করে না, বা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এমন বিষয়কেও অনেকে ইসলামের সাথে জুড়ে দেন। এটা ঠিক নয়। এ কারণে সাধারণ মানুষ ইসলামকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন।
মানুষের জীবন রক্ষাকে ইসলাম সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। যেকোনো মূল্যে জীবন বাঁচাতে হবে। ইসলামের চমৎকার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, অনেক কঠিন বিধানও সমস্যা দেখা দিলে স্বাভাবিক করে দেয় ইসলাম।
ধরুন, আপনি এমন জায়গায় আবদ্ধ হয়ে আছেন। যেখানে ইসলাম সম্মত কোনো খাবার নেই। আপনার জীবনও সঙ্কটাপন্ন। তখন আপনার জন্য হারাম জিনিসও জান বাঁচানো পরিমাণ খাওয়া বৈধ হয়ে যাবে। এই নিয়ম প্রতিটি বিধানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে বিধান পালন করা আপনার জন্য অসাধ্য, সেখানে ইসলাম সহজ কোনো উপায় বাতলে দেয়। এটা ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনেও একথা স্পষ্ট করে বলা আছে। 'কারো ওপর অসাধ্য বিষয় চাপিয়ে দেয়া হয় না।'
বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে কমবেশি সবার জীবন পর্যুদস্ত। এ অবস্থায় সর্বোচ্চ সতর্কতা কাম্য। সামান্য অসতর্কতা বা গাফিলতির অবকাশ আমাদের নেই। ইসলামও এমন ক্ষেত্রে উদাসীনতার সুযোগ দেয়নি।
নবীজি সা. ও সাহাবায়ে কেরামের যুগ যদি দেখেন, তাহলেও দেখতে পাবেন মহামারী দেখা দিলে তারা কত সতর্ক হতেন। করোনাভাইরাস একটি প্রাণঘাতী মহামারী। যা পুরো পৃথিবীকে আতঙ্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও করোনা নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো ফলই পাওয়া যাচ্ছে না।
এককথায়, করোনায় যেসব দেশ আক্রান্ত হয়েছে আর যারা এখনো আক্রান্ত হয়নি- কেবল আশঙ্কা করছে; তারাও সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করছে। এসব বিবেচনায় সচেতনতা ও সতর্কতার দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। করোনা নিয়ে আমাদের সচেতনতা হতাশাব্যঞ্জক।
স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলেও, যে উদ্দেশে বন্ধ রাখা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন বা কার্যকারিতা এখনও লক্ষ্য করা যায়নি। বিভিন্ন স্থানে গণজমায়েত বন্ধ হয়নি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে আমারা অনেক পিছিয়ে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া।
বর্তমানে দেশে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা গড়ে সাত হাজারের বেশি। এ রোগে মারা যাচ্ছে দিনে কমপক্ষে ৭০ জন।
অনেকে মনে করছেন, আমরা করোনায় আক্রান্ত হবো না। হলেও বেশি দিন থাকবে না। অদৃশ্য কেউ যেন তাদের এই ছাড়পত্র দিয়ে গেছে। আবার অনেকেই দৃশ্যমান কোনো ধরনের সতর্কতা অবলম্বন না করে আল্লাহতায়ালার ওপর নির্ভরতার কথা বলছেন। বাহ্যিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন না করে রোগ মুক্তির ক্ষেত্রে এভাবে আল্লাহর ওপর ভরসার শিক্ষা তারা কোথায় পেলেন- আল্লাহ মালুম।
একবার এক সাহাবি উটে সওয়ার হয়ে হুজুরে আকরাম সা.-এর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। হুজুর সা. তখন মসজিদে ছিলেন। আগত সাহাবি মসজিদের সামনে নিজের উটটি রেখে ভেতরে গিয়ে হুজুর সা.-এর সঙ্গে দেখা করলেন এবং দীর্ঘক্ষণ পর যখন ফিরে যাওয়ার জন্য বাইরে এলেন, দেখতে পেলেন মসজিদের সামনে তার উটটি নেই। তখন তিনি অস্থির হয়ে গেলেন এবং নবী করিমকে সা. জিজ্ঞেস করলো, হুজুর! আমার উট কোথায়? নবী কারীম সা. জানতে চাইলেন, তোমার উট কি তুমি বেঁধে রেখেছিলে? সাহাবি উত্তর দিলেন- না, তাতো রাখিনি। আমি আল্লাহতায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল করেছিলাম। একথা শুনে আল্লাহর রাসূল সা. বললেন, উট আগে বেঁধে রাখবে। এরপর তাওয়াক্কুল করবে।
এ ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, ইসলামে উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা নিষিদ্ধ কিছু নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসবাব গ্রহণ করা জরুরি।
আবার অনেকে ভাবছেন, আমার এত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। করোনা আমাকে স্পর্শ করবে না। কারণ- আমি নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, জাকাত দিই। দেখুন, আপনি নামাজ-রোজা নিয়মতি করলেও আল্লাহতায়ালা চাইলে করোনা আপনাকে আক্রান্ত করতে পারে। কথাটা কাউকে ভয় দেখানোর জন্য নয়, সতর্কতার জন্য বলা। ইসলাম সব বিষয়ে মানুষকে হুঁশিয়ার থাকতে বলে, প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, ইসলাম কোনো অলৌকিক ধর্ম নয়, ইসলাম বাস্তবসম্মত ধর্ম।
এ জন্য সবখানে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত, সামনে রমজান। আমরা অনেকটা সময় এখন ব্যয় করবো মসজিদে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও তারাবি-তাহজ্জুদসহ অনেক ধরনের নফল নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াত এবং জিকির-আজকারের জন্য মসজিদে যাবো। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা চাই।
অনেকে এমন আছেন, যাদের বাজারঘাটে, পথে-গাড়িতে স্বাস্থ্যবিধি পালনের কোনো খবর থাকে না। মসজিদে গেলে তাদের স্বাস্থ্যবিধির খবর হয়। ভাবখানা এমন, যেন করোনা শুধু মসজিদেই থাকে। অন্য খানে থাকে না। এমনটাও ঠিক নয়। এক্ষেত্রে ইমাম-খতিব সাহেবরাই এগিয়ে আসতে পারেন। মসজিদে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে মুসল্লিদেরকে সবখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি উৎসাহ দেবেন।
এই স্বাস্থ্যবিধি মানা ইসলাম-বহির্ভূত কোনো কাজ নয়। বরং ইসলাম সম্মত। তবে, এগুলোকে চূড়ান্ত মনে করা যাবে না। এমন মনে করা যাবে না যে, স্বাস্থ্যবিধি মানলে কোনোভাবেই আমি করোনা আক্রান্ত হবো না। এমন ধারণা করলে ঈমানের মধ্যে ত্রুটি চলে আসতে পারে। মূল বিষয় হলো, আল্লাহর হুকুম। আল্লাহ যা চান, তা-ই হবে। আর যা চান না তা কোনোভাবেই হবে না।
লেখক : তরুণ আলেম ও সংবাদকর্মী
muhammadbinwahid60@gmail.com