কুরআনের প্রামাণ্যতা ও পিঁপড়া-কাহিনী
কুরআনের প্রামাণ্যতা ও পিঁপড়া-কাহিনী - ছবি সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যের রাজধানী সিডনির একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে মহিউদ্দিন রাব্বানি। তার খ্রিষ্টান বন্ধু ক্যাডম্যান প্রায় সময় তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। ধর্মে খ্রিষ্টান হলেও আদতে ক্যাড একজন কট্টর নাস্তিক। মহিউদ্দিনের ভাষায় ‘গোঁড়া ইসলামবিদ্বেষী’। সময়ে-অসময়ে ইসলাম ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্কজুড়ে দেয়া এবং কুরআন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করাই তার কাজ।
ক্যাডম্যান তার ফেসবুকে পোস্ট করে- ‘কুরআন শুধু একটি অবৈজ্ঞানিক গ্রন্থ নয়, বরং এটি রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।’
পরদিন ক্যাম্পাসে মহিউদ্দিনের সাথে ক্যাডের দেখা হলে জানতে চায়, ‘কুরআন রূপকথার গল্পকেও হার মানায় বলে তুমি যে দাবি করছ তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে? ক্যাড তার স্মার্ট ফোনটি বাড়িয়ে দিলো।
মহিউদ্দিন দেখল সূরা নামলের ১৮ নম্বর আয়াতের ইংরেজি অনুবাদ মার্ক করা, যার বাংলা তরজমা- ‘যখন সোলায়মান এবং তার বাহিনী পিঁপড়ার উপত্যকায় পৌঁছল, তখন এক নারী পিঁপড়া বলল, হে পিঁপড়ারা! তোমাদের গর্তে প্রবেশ করো। এমন যেন না হয়, সোলায়মান এবং তার সেনারা তোমাদের পিষে ফেলবে, তোমরা তা টেরও পাবে না। সোলায়মান আ: পিঁপড়ার কথায় মৃদু হাসলেন।’
ক্যাড বলল, এটা কি রূপকথার গল্প নয়? পিঁপড়া কথা বলছে, সে কথা আবার নবী শুনল এবং হাসল। এসব তো রূপকথার গল্পেই ভালো মানায়। কাজেই কুরআন একটি রূপকথার গল্প ছাড়া আর কিছু নয়।
রাতে মহিউদ্দিন আমাকে সব জানাল। বলল, এ ব্যাপারে কুরআন ও বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা জানতে চাই। সারা রাত ইন্টারনেট, ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি ঘেঁটে ক্যাডের আপত্তির জুতসই একটি জবাব তৈরি করলাম।
কুরআন নিয়ে ক্যাড যে আপত্তি তুলেছে, সম্প্রতি অনেকেই এ ধরনের আপত্তি করে কুরআনকে রূপকথার বই বলে প্রমাণের চেষ্টা করেছে। মজার ব্যাপার হলো- কুরআন যে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক একটি গ্রন্থ এবং কোনো রূপকথার গল্প নয়, সূরা নামলের ওই ১৮ নম্বর আয়াতই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
আরবি ভাষায় বিবেকসম্পন্ন প্রাণীর জন্য পুংলিঙ্গ আর বিবেকবর্জিত ও জড় পদার্থের জন্য স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করার নিয়ম আছে। মহান আল্লাহপাক পিঁপড়ার সংলাপ বর্ণনা করতে গিয়ে পুংলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা প্রমাণ করে বুদ্ধি ও জীবনযাত্রার দিক থেকে পিঁপড়া এবং মানুষ সমান বা কাছাকাছি পর্যায়ের প্রাণী।
যেমন ‘কালাত নামলাতু’ মহিলা পিঁপড়াটি বলল, ‘ইয়া আইয়ুহান নামলু’ হে পিঁপড়ার দল, ‘উদখুলু মাসাকিনাকুম’ তোমরা তোমাদের গর্তে প্রবেশ করো।
পবিত্র কুরআনের অসংখ্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা নবীকে সম্বোধন করে ‘ইয়া আইয়ুহা’ এবং বান্দাকে সম্বোধন করে ‘উদখুলু’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং কুরআনের শব্দ বিশ্লেষণ এবং আরবি ভাষারীতি বলছে, মানুষ যেমন বিবেকসম্পন্ন প্রাণী, পিঁপড়াও তেমনি বোধসম্পন্ন প্রাণী।
কিছুদিন আগেও বিজ্ঞান কুরআনের এ গূঢ় রহস্য স্বীকার করত না। পবিত্র কুরআনের এ আয়াতকে অসার প্রমাণ করার জন্য একদল চৌকস বিজ্ঞানী পিঁপড়ার জীবন-পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার একপর্যায় তারা পিঁপড়া সম্পর্কে কুরআনের নির্ভুল ও নিখুঁত তত্ত্বজ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যান।
ইন্টারনেটভিত্তিক মুক্ত বিশ্বকোষ ‘উইকিপিডিয়া’ থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে ২২ হাজার প্রজাতির পিঁপড়া রয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞানীরা ১২ হাজার ৫০০ প্রজাতির পিঁপড়ার শ্রেণিবিন্যাস করতে পেরেছেন।
পতঙ্গ বিজ্ঞানীদের মতে- পিঁপড়াই একমাত্র সামাজিক পতঙ্গ। মানুষের মতো পিঁপড়ার সমাজ, সংসার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা রয়েছে। নিজস্ব বাজার এবং উন্নত মানের যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে তাদের মধ্যে। তারা খাদ্য সঞ্চয় করে। পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে শীতের দিন তা রোদে শুকাতে দেয়। তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটে এবং মানুষের মতোই তারা চরম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে থাকে। পিঁপড়ারা শত্রুকে হুমকি-ধমকি দেয় এবং প্রয়োজন হলে খুন করতেও দ্বিধা করে না। অবশ্য পিঁপড়াদের মধ্যেও আইন-আদালত এবং পুলিশের ভয় কাজ করে।
পিঁপড়া মানবখ্যাত পতঙ্গ বিজ্ঞানী ড. উইলসন পুরো পৃথিবী ঘুরে ৫০০ প্রজাতির পিঁপড়ার ওপর পর্যবেক্ষণ করে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, পিঁপড়ারা মানুষের মতোই তাদের মৃতদেহ কবর দেয়। আমাদের মতো পিঁপড়ার মধ্যেও রয়েছে চোর পিঁপড়া। মজার ব্যাপার হলো- পিঁপড়ার মধ্যেও ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ স্বভাব রয়েছে।
বিজ্ঞানের আলোকে সূরা নামলের ১৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা : ‘যখন সোলায়মান এবং তার বাহিনী পিঁপড়ার উপত্যকায় পৌঁছল, তখন একটি নারী পিঁপড়া বলল, হে পিঁপড়ারা! তোমাদের গর্তে প্রবেশ করো। এমন যেন না হয়, সোলায়মান এবং তার সেনারা তোমাদের পিষে ফেলবে আর তোমরা তা টেরও পাবে না। সোলায়মান আ: তার কথায় মৃদু হাসলেন।’
এ আয়াত থেকে পিঁপড়াবিদ্যার চারটি সূত্র পাওয়া যায়-
১. পিঁপড়া মানুষের মতোই কথা বলতে পারে : আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, ফেরোমন নামে একটি রাসায়নিক পদার্থের প্রতি পিঁপড়ারা সংবেদনশীল। এর মাধ্যমে তারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। এক ধরনের পিঁপড়া ‘নিয়ার-ফিল্ড’ পদ্ধতিতে শব্দ সৃষ্টি করে কথা বলে। একই পদ্ধতিতে একটি পিঁপড়া একাধিক পিঁপড়ার সাথে ভাববিনিময় করে। যেমন আয়াতে বর্ণিত মহিলা পিঁপড়াটি অন্যদের সাথে করেছে।
২. পিঁপড়ার প্রধান নারী : পুরুষ পিঁপড়া ঘরে, নারী পিঁপড়া বাইরে আর রানী পিঁপড়া প্রজননকাজে- এ হলো পিঁপড়া সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রানী পিঁপড়ার জন্য খাবার ব্যবস্থা করবে নারী পিঁপড়া আর সেই খাবার এবং রানীকে পাহারা দেবে পুরুষ পিঁপড়া। পতঙ্গবিদদের ভাষায়- পুরুষরা সৈনিক আর নারীরা শ্রমিক। বিজ্ঞানীদের ধারণা, খাদ্য সংগ্রহ অথবা বাইরের কোনো কাজে নারী পিঁপড়ারা যখন ব্যস্ত ছিল, ঠিক তখনই সোলায়মান আ: এবং তার বাহিনী এসে পড়েন। ফলে তাদের রানী সবাইকে নিজ নিজ ঘরে প্রবেশ করার নির্দেশ দেয়। নির্দেশের ধরন থেকে বোঝা যায়- নির্দেশদানকারী রানী পিঁপড়াই ছিল। তবে এটা অন্য মহিলা পিঁপড়াও হতে পারে।
৩. পিঁপড়া আলাদা করে মানুষ চিনতে পারে : পিঁপড়ার মতো মানুষের শরীর থেকেও ফেরোমন পদার্থ নিঃসরণ হয়। ফলে সোলায়মান আ:-এর ফেরোমন সিগনেচারের মাধ্যমেই নারী পিঁপড়াটি তাকে চিনতে পেরেছিল। ঠিক একই কারণে কুকুরও প্রত্যেক মানুষকে আলাদা করে চিনতে পারে।
৪. পিঁপড়া বিপদসঙ্কেত বুঝতে পারে : জার্মানের পতঙ্গবিজ্ঞানী উলরিশ বলেন, পিঁপড়ারা আগাম বিপদসঙ্কেত বুঝতে পারে এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। তবে উলরিশের দাবি শুধু লালচে বিশেষ শ্রেণীর নারী পিঁপড়াই এমনটি করতে পারে। আয়াতে আমরা দেখেছি, হাজার হাজার পিঁপড়া থেকে শুধু একটি নারী পিঁপড়া সোলায়মান আ:-এর আগমন এবং বিপদসঙ্কেত বুঝতে পেরেছিল।
প্রযুক্তির রাজধানীখ্যাত জাপান এবং জার্মানি তাদের আধুনিক সব শক্তিশালী প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েও যখন ভূমিকম্প রোধে সফল হলো না, তখন তারা প্রকৃতির দিকে আরো গভীর মনোযোগী হলো। জার্মানের খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা দুই বছর ধরে অনবরত ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে পিঁপড়ার গতিবিধি লক্ষ করেন। তারা দেখেন, ভূমিকম্পের ঠিক আগ মুহূর্তেই পিঁপড়ার অস্থিরতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে যায়। পাল্টে যায় তাদের গতিবিধিও।
ডুইসবুর্গ এসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ শ্রাইবার বলেন, ‘পিঁপড়ার মধ্যে যারা আগাম বিপদসঙ্কেত বুঝতে পারে শুধু তারাই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার আশপাশে বাসা বাঁধে। কারণ এসব অঞ্চল এদের জন্য কমফোর্টেবল। এদের বেঁচে থাকার জন্য অতিরিক্ত আদ্রতা ও উষ্ণতা প্রয়োজন, যা শুধু ওইসব এলাকার বাসাগুলোতেই পাওয়া যায়।
আজকের মুসলমানদের মূর্খতার কথা ভাবলে আফসোস হয়। তারা বিজ্ঞান পড়ে না। শুধু মুখে মুখেই বলে, কুরআন বিজ্ঞানময় গ্রন্থ, ইসলাম বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্ম। গবেষণা করে দেখার সময়-সুযোগ-আগ্রহ এ যুগের মুসলমানদের মধ্যে তেমন আর দেখা যায় না। হায়! দুনিয়ামুখী মুসলমানকে কে ফেরাবে বিজ্ঞানময় কুরআনের আলোয়।
লেখক : সাংবাদিক
Email: alfatahmamun@gmail.com