পবিত্র কোরআনে আছে যে ২৬ নবী-রাসূলের কথা
পবিত্র কোরআনে আছে যে ২৬ নবী-রাসূলের কথা - ছবি সংগৃহীত
আদম আ:-কে দুনিয়ায় আসার কথা বলা হলে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে আশ^স্ত করে বলা হয়, আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তার অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই। সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আল্লাহ পাক যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেন। আদম আ: প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল হলেন মুহাম্মদ সা:।
আল্লাহ পাক প্রতিটি জনপদে রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁর বাণী, ‘প্রতিটি জাতির জন্য পথ-প্রদর্শনকারী রয়েছে’- সূরা আর রাদ-১৩। তিনি আরো বলেন, ‘আমি রাসূল প্রেরণ না করে কাউকে শাস্তি দেই না’- বনি ইসরাইল-১৬৫। আমরা আপনার আগে এমন অনেক রাসূল পাঠিয়েছি যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনিয়েছি এবং এমন অনেক রাসূল পাঠিয়েছি, যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনাইনি- সূরা নিসা-১৬৪। সঠিক সংখ্যা আল্লাহই ভালো জানেন। জনশ্রুতি আএ সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। এর মধ্যে ২৫ জনের নাম কুরআন মজিদে পাওয়া যায়। সূরা আন’আমের ৮৩-৮৬ আয়াতে ১৮ জনের নাম পাওয়া যায়।
‘ইবরাহিমকে তাঁর জাতির মোকাবিলায় আমি এ যুক্তি-প্রমাণ প্রদান করেছিলাম। আমি যাকে চাই উন্নত মর্যাদা দান করি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, তোমার রব প্রজ্ঞাময় ও জ্ঞানী। তারপর আমি ইবরাহিমকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি এবং সবাইকে সত্য পথ দেখিয়েছি, (সে সত্য পথ যা) ইতোপূর্বে নূহকে দেখিয়েছিলাম। আর তাঁরই বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সোলাইমান, আইউব, ইউসুফ, মুসা ও হারুনকে (হেদায়াত দান করেছি)। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের তাদের সৎ কাজের বদলা দিয়ে থাকি। (তাঁরই সন্তানদের থেকে) যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা ও ইলিয়াসকে (সত্য পথের পথিক বানিয়েছি)। তাদের প্রত্যেকে ছিল সৎ। (তাঁরই বংশ থেকে) ইসমাঈল, আল ইয়াসা, ইউনুস ও লুতকে (পথ দেখিয়েছি)। তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেককে আমি সমস্ত দুনিয়াবাসীর ওপর মর্যাদাসম্পন্ন করেছি’। (সূরা আন’আমে: ৮৩-৮৬)।
নিঃসন্দেহে আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইব্রাহিম ও আলে ইমরানকে নির্বাচিত করেছেন, যারা একে অপরের বংশধর ছিল। (আলে ইমরান ৩৩-৩৪)। আলে ইব্রাহিম বলতে ইসমাইল ও ইসহাক এবং আলে ইমরান বলতে মুসা (আ) ও তাঁর বংশধর বোঝানো হয়েছে।
নবী রাসূলদের মধ্য থেকে ২৬ জনের নাম নিচে দেয়া হলো। তাঁদের ধারাবাহিকতা কুরআন-হাদিস নির্ভর না হয়ে অনেকটা ইতিহাস-আশ্রিত।
১.আদম আ:। প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী। মানবজাতির শুরু তিনি ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া আ: থেকে। কুরআনে তাঁর সম্পর্কে ২৫ জায়গায় আলোচনা আছে। তাঁর পেশা ছিল কৃষি।
২. শিস আ:। আল্লামা ইবনে কাসির রহ: বলেন, শিস আ: আদম আ:-এর পুত্র এবং তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁরও পেশ ছিল কৃষি। কুরআনে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
৩.ইদ্রিস আ:। সূরা মারিয়াম ৫৬-৫৭ ও সূরা আম্বিয়া ৮৫ আয়াতে ইদ্রিস আ: সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। তাঁর পেশা ছিল কাপড় সেলাই করা (দর্জি)।
৪.নূহ আ:। তাঁর আয়ুষ্কাল ছিল ৯৫০ বছর। কুরআনে ৪০ বার তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং মাত্র ৮০ জন নারী-পুরুষ দাওয়াত কবুল করেন। ‘আমি নূহকে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাই এবং সে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর। শেষ পর্যন্ত তুফান তাদেরকে ঘিরে ফেলে এমন অবস্থায় যখন তারা জালেম ছিল’- (আনকাবুত: ১৪)। তিনি ছিলেন পেশায় কাঠমিস্ত্রি। তিনি ৩০০ হাত দীর্ঘ, ৫০ হাত প্রস্থ, ৩০ হাত উচ্চতাসম্পন্ন নৌকা তৈরি করেন।
৫.হূদ আ:। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ আদ জাতির কাছে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয় হূদ আ:-কে। কুরআনে সাতটি আয়াতে এ নবীর আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
৬.সালেহ আ:। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সামুদ জাতির কাছে নবী হিসেবে প্রেরিত হন হজরত সালেহ আ:। ৯ জায়গায় এই নবীর আলোচনা হয়েছে। তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
৭.ইবরাহিম আ:। সামুদ সম্প্রদায়ের পর সাবিয়া সম্প্রদায়ের কাছে নবী হিসেবে প্রেরিত হন হজরত ইব্রাহিম আ:। এই নবীর নাম কুরআনে ৬৯ বার উল্লেখ হয়েছে। তার জাতি চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র পূজা করত। সেই সময়ের শাসক নমরুদ চন্দ্র দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে দাবি করত। ইবরাহিম আ: মূর্তি ভেঙে নমরুদের রোষানলে পড়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে তাঁকে হত্যা করতে চাইলে আল্লাহপাক তাঁকে হেফাজত করেন। কুরআন মজিদে তাঁর ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে নানাভাবে বর্ণনা এসেছে। হজ ও কুরবানির মাধ্যমে তাঁর ও তাঁর পরিবারের স্মরণ কিয়ামত পর্যন্ত জারি রয়েছে। আল্লাহ পাক তাঁকে মুসলিম উম্মাহর পিতা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ব্যবসা ও পশু পালন ছিল তাঁর পেশা।
৮.লুত আ:। ইবরাহিম আ:-এর পরেই তাঁর ভাইপো লুত আ: নবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কুরআনে ২৭ বার তাঁর উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর সময়ে তাঁর জাতি সমকামিতায় লিপ্ত হওয়ায় সেই জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তাঁর স্ত্রী স্বামীকে নবী হিসেবে না মেনে বিরোধীদের কাতারে থাকায় ধ্বংসপ্রাপ্তদের দলে তাঁর স্ত্রীও ছিল।
৯.ইসমাঈল আ:। ইবরাহিম আ: ও হাজেরা আ:-এর ঘরে জন্ম হয় হজরত ইসমাঈল আ:। কুরআনে মোট ১২টি আয়াতে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। শিশুকালে আল্লাহপাক ইব্রাহিম আ:-কে কুরবানি পেশ করার কথা বললে তিনি তাঁর কলিজার টুকরো ইসমাঈল আ:-কে কুরবানি করতে উদ্যত হন আর আল্লাহ পাক তাঁকে এক পশু যবেহর মধ্য দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে দেন। নবী মুহাম্মদ সা: ছিলেন তাঁরই বংশধর। পশু শিকার করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
১০. ইসহাক আ:। ইবরাহিম আ: ও সারাহ আ:-এর ঘরে জন্ম নেন হজরত ইসহাক আ:। ১৭ বার আলোচিত হয়েছে তাঁর নাম। তাঁর বংশধারা থেকে অনেক নবীর আগমন ঘটে।
১১. ইয়াকুব আ:। তাঁর আর এক নাম ইসরাইল। ১৬টি আয়াতে তাঁর নাম আলোচিত হয়েছে। নিজে নবী হওয়ার সাথে সাথে তাঁর অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে হজরত ইউসুফ আ: ছিলেন আল্লাহর নবী। কৃষিকাজ, ব্যবসা ও পশু পালন ছিল তাঁর পেশা।
১২. ইউসুফ আ:। কুরআনে ২৭ আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। পিতা ইয়াকুব, দাদা ইসহাক ও পরদাদা ইব্রাহিম আ:। তাঁর সম্পর্কে একটি সূরা রয়েছে এবং সেখানে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহ পাক তাঁকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের আসনে আসীন করেছিলেন।
১৩. আইয়ুব আ:। কুরআনে চার জায়গায় তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আইয়ুব আ:-কে আল্লাহ পাক রোগ-ব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছিলেন এবং পরম ধৈর্য অবলম্বনের বিনিময়ে আল্লাহ পাক তাঁকে সুস্থতাসহ সব নেয়ামত আবার দান করেন। তাঁর পেশা ছিল গবাদি পশু পালন।
১৪. ইউনুস আ:। মোট ২টি আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। মাছের পেটে গিয়ে আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনার বিনিময়ে তিনি মুক্তি পান। তাঁর পেশা ছিল চাষাবাদ।
১৫. শোয়াইব আ:। চমৎকার বাগ্মিতার কারণে তিনি খাতিবুল আম্বিয়া (নবীগণের মধ্যে সেরা বাগ্মী) নামে খ্যাত ছিলেন।
১৬.মুসা আ:। কুরআনে সবচেয়ে বেশিবার তাঁর নাম আসছে। মোট ১৩৭ বার। তাঁর সময়কালের শাসক ফিরাউন ছিল একজন অত্যাচারী, তার অত্যাচারের বর্ণনা কুরআনে বিস্তারিত রয়েছে এবং তাকে নীলনদে ডুবিয়ে মারা হয়। তিনি পশু চরাতেন এবং মাদায়েনে শ্বশুরালয়ে (হজরত শোয়াঈব আ:) ৮ বছর পশু চরিয়েছেন। তাঁর অনুসারীরা বর্তমানে ইহুদি নামে পরিচিত।
১৭.হারুন আ:। মুসা আ:-এর সহোদর ভাই। ২০টি আয়াতে তাঁর প্রসঙ্গে এসেছে। তাঁরও পেশা ছিল পশু পালন।
১৮.ইলিয়াস আ:। মোট ৩ বার উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাম। সূরা আনয়াম ৮৫ ও সূরা ছাফফাত ১২৩-১৩২ ইলিয়াস আ:-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ফিলিস্তিনে তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রম চলে। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
১৯. আল ইয়াসা আ:। অন্য নবীদের সাথে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়, মোট ২ বার। সূরা আনয়াম ৮৬ ও ছোয়াদ ৪৮ নং আয়াতে। তিনি ইয়াকুব আ:-এর বংশধর ও ইলিয়াস আ:-এর চাচাতো ভাই। তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।
২০. জুলকিফল আ:। সূরা আম্বিয়া ৮৫-৮৬ ও ছোয়াদ ৪৮ নং আয়াতে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি পুরো পৃথিবীর বাদশাহ ছিলেন। পশু পালন ছিল তাঁর পেশা।
২১.দাউদ আ:। ১৬টি আয়াতে উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাম। যবুর কিতাব তার উপর অবতীর্ণ। মনোমুগ্ধকর সুরের অধিকারী ছিলেন। তিনি একদিন রোযা রাখতেন ও একদিন রাখতেন না। তিনি ছিলেন বাদশাহ ও নবী। লৌহ দ্বারা বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করতেন।
২২. সোলাইমান আ:। দাউদ আ:-এর ছেলে। মোট ১৭ বার উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাম। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শাসক। সমগ্র সৃষ্টির ভাষা তিনি জানতেন এবং তাদের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল।
২৩. জাকারিয়া আ:। মোট ৭বার উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাম। মরিয়ম আ:-এর খালু এবং তিনি তাঁর লালনপালনকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন কাঠমিস্ত্রি।
২৪. ইয়াহইয়া আ:। জাকারিয়া আ:-এর ছেলে ইয়াহইয়া ছিলেন ঈসা আ:-এর আপন খালাতো ভাই। ৫টি আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। তিনি জনহীন ও জঙ্গলে কাটিয়েছেন এবং বৃক্ষের ফল ও লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন।
২৫. ঈসা আ:। কুরআন মজিদে মোট ২৫ বার আলোচনা হয়েছে। পিতা ছাড়া মরিয়মের গর্ভে তাঁর জন্ম। তাঁর অনুসারীরা খ্রিষ্টান হিসেবে পরিচিত এবং সংখ্যায় এখন সর্বোচ্চ পরিমাণ। তাঁর কোনো নির্দিষ্ট পেশা ছিল না। ফিলিস্তিনে জন্ম এবং ফলমূল খেয়ে বড় হয়েছেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তাঁর শত্রুরা তাঁকে ফাঁসি দিতে উদ্যত হলে আল্লাহ পাক তাঁকে উঠিয়ে নেন। নবীদের বেশির ভাগই বনি ইসরাঈলের প্রতি প্রেরিত হয়।
২৬. মুহাম্মদ সা:। সর্বশেষ নবী ও রসূল। তাঁর আগমনের মধ্য দিয়ে নবী প্রেরণের সিলসিলা শেষ হয়ে গেছে।
লেখক : উপাধ্যক্ষ অব: কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ