ফ্রান্স কেন এত ইসলামবিদ্বেষী
ফ্রান্স কেন এত ইসলামবিদ্বেষী - ছবি সংগৃহীত
সম্প্রতি ‘ইসলাম-ইন-ক্রাইসিস’ বলে এক বক্তব্য দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ, এ কারণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান তাকে সাবধান করে দিয়েছেন। ইসলাম নিয়ে ম্যাক্রোঁ শুরু থেকেই বাতিকগ্রস্ত। তিনি সবসময় মুসলমান ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এসব বক্তব্যে এতটুকু বোঝা যায় যে, ইসলাম সম্পর্কে তার জ্ঞানের পরিধি কম! আর্মেনিয়া যুদ্ধে বেকাদায় পড়ে যাওয়ায় তিনি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। ফরাসি আর্মেনিয়ানরাও দল বেঁধে ছুটছে যুদ্ধ করার জন্য। যুদ্ধে আজারীদের অভাবিত জয়ে ম্যাক্রোঁ বিভিন্ন স্থানে তুরস্ক ও ইসলামবিরোধী বেসামাল বক্তব্য দিতে থাকেন। ইসলামের বিরুদ্ধে ম্যাক্রোঁর অবস্থান বহু পুরনো, এমনকি তার পূর্বসূরি সারকোজিও চরম ইসলামবিদ্বেষী ছিলেন। ফরাসিরা সব সময় মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে ও ইসলামের নতুন রূপ দিয়ে ‘ফরাসি ইসলাম’ বানানোর চেষ্টা করছে। অথচ একসময় মুসলিম দেশগুলোকে কলোনি বানিয়ে সম্পদ চুরি করে প্যারিসকে চকচকে বানিয়েছে।
ফরাসি সরকার মনে করে মসজিদ ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ইসলামের শিক্ষা দেয়া হয়। তাই ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে ইমামরা ‘মধ্যপন্থী ইসলাম’ ধারণায় সমৃদ্ধ হয়ে মানবাধিকার ও রিপাবলিকান কোডের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। সরকার ইসলামকে ‘অর্গানাইজ’ করে সত্যিকার ‘ফরাসি ইসলাম’ বানাতে চায়। যাতে ঘৃণা, মানবাধিকার ও রেসিজম থেকে দূরে থাকে। নতুবা ‘এদের’ ফ্রান্স থেকে বের করে দেয়ার কর্মসূচিও সরকারের আছে। ২০০১ সাল থেকে ফরাসি ‘মূল্যবোধ বিরোধী’ প্রায় ৪০ জন ইমামকে ফ্রান্স থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
ফরাসি সরকারগুলো ১৯৮০ সাল থেকে নতুন ব্র্যান্ডের ইসলাম চালু করতে চায়। ম্যাক্রোঁও সেটি চান। দেশের মুসলিম সংখ্যালঘু ও ইসলামী চরমপন্থীকে লক্ষ্য করে ফরাসি ইসলাম চালু করা যেটি সেকুলারিজম অনুসরণ করবে এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মতো জেহাদি সংগঠন হিসেবে কোনো কাজ করবে না। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হলান্দে মরক্কোর রাবাতের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ইমামদের প্রশিক্ষণের জন্য ২০১৫ সালে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
ফ্লোরেন্সে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ওলিভিয়ার রয় ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ফরাসি ইসলাম হলো মধ্যপন্থী ইসলাম, সন্ত্রাসবাদের বিপরীত।’ তিনি সমস্যাও তুলে ধরেন, ‘ধর্মকে মধ্যপন্থী করা মানে কি?’ ১৯০৫ সালে ফ্রান্সের লিগাল সিস্টেম চার্চকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে ফেলেছে। তাহলে ইসলাম নিয়ে কেন এত টানাটানি! সরকারের অনেকে বলছেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করতে হলে ‘ইসলামের চরমপন্থা’ দূর করতে হবে। বাস্তবে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৮০০ ফরাসি নাগরিক ইরাক, সিরিয়ার যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য আইএসে যোগ দিয়েছে। এতে ফরাসিরা শঙ্কিত।
২০০৩ সালে নিকোলাস সারকোজি ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অব মুসলিম গঠন করেছিলেন। ইসলামকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তখন তিনি ধর্মীয় বিষয়াদি আউট সোর্সিং করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র তো বিধানানুসারে এটা করতে পারে না। অথচ ৩০ বছর ধরে ফরাসিরা সেটাই করছে, এটি সরকারের দ্বিমুখিতা। অনেক আইন প্রণেতা এই প্রচেষ্টার সমালোচনা করেন।
ফরাসি একাডেমিকরা তর্কে জড়িত হয়েছে এই প্রশ্নে যে, মৌলবাদের উৎস কী? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এখানে ধর্মীয় বিষয় জড়িত নেই। আবার মৌলবাদ বা সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে ইসলামের কোনো ভূমিকা নেই। মধ্যপন্থী ইমাম দিয়ে চরমপন্থী ইমামদের পরিবর্তন করা হলে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কী? আবার একই প্রশ্ন আইনগত প্রতিবন্ধকতার কারণে ফরাসি সরকার এটা করতে পারে কি না? হলেন্দের সময় প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভলস, নিরাপত্তার নামে সমুদ্রপাড়ে মুসলিম মহিলারা যে বুরকিনি পরত সেগুলো নিষিদ্ধ করেন। তার মতে ‘ইসলাম একটি সমস্যা।’ ম্যাক্রোঁ ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসেন। তিনি মুসলমানদের সব ধরনের বিদেশী ফান্ডিং বন্ধ করতে চান অথচ খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের ফান্ডিং নিয়ে তার কোনো নির্দেশনা নেই।
২০১০ সালে মুসলিম মহিলাদের হিজাব ও পর্দা বেআইনি ঘোষণা করা হয়। মুসলিম সমাজ মনে করতে থাকে ‘ফ্রেঞ্চ ইসলাম’ মানে কি তাহলে ইসলামকে দূরে সরিয়ে রাখা? বিশেষজ্ঞরা সাবধান করেছেন এই বলে যে, ম্যাক্রোঁ যদি ফরাসি-ইসলাম করতে চান তার অর্থ এটি হবে না যে নতুন একটি ইসলাম তৈরি করবেন। ফরাসিদের ৪৩ শতাংশ মনে করে ইসলাম ফরাসি রিপাবলিকের মূল্যবোধের সাথে মিল খায় না। ২০১৬ সালে এই মান ৫৬ শতাংশ ওঠে। তার পরও ইসলাম ফরাসিদের জীবনে ও রাজনীতিতে অপ্রতিরোধ্যভাবে ঢুকে পড়ছে। এর কারণ কি? রয় বলেন, ‘আমাদের কাজ করতে হবে, ৬০ লাখ ফরাসি মুসলমান যেখানে হয়তো ২০০ ‘টেররিস্ট’ রয়েছে, মুসলমানদেরকেই বিষয়টি সুরাহার জন্য অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
ফ্রান্সে ৬০ লাখের বেশি মুসলমান রয়েছে, ইউরোপের সবচেয়ে বেশি। ইমামের সংখ্যা ১৫০০। সরকার বলছে, তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ ফ্রান্সের নাগরিক। ইমামদের ৪০ শতাংশ মরক্কোর, ২৪ শতাংশ আলজেরিয়ার, ১৬ শতাংশ তুরস্কের, ৬ শতাংশ তিউনিসিয়ার তারা সবাই ‘মৌলবাদী ইসলামকে’ পছন্দ করে ফলে সেকুলার ফরাসি মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সরকার মনে করে। দলিল বোবাকের, প্যারিস গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম বলেন, ‘স্ত্রীদের ধরে পেটানোর ধর্ম ইসলাম নয়।’ তিনি বাউজিয়ানের বক্তব্যের সমালোচনা করেন’ তবে তিনি ইমামদের আরো প্রশিক্ষণের বিষয়টিতে সম্মতি দিয়েছেন। ফান্সের সংবিধানে স্টেট থেকে চার্চ পৃথক। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। ইসলামের ব্যাপক চর্চা নিয়েও ফ্রান্স ভুগছে। অনেকে মনে করেন ‘মৌলবাদী ইসলাম’ ফ্রান্সে শিকড় বিস্তার করছে! ডজন খানেক ইমামকে গোয়েন্দা পুলিশ শনাক্তও করেছে।
ফ্রান্সের ৩০০ জন ব্যক্তিত্ব কুরআনের কিছু আয়াত মুছে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের দাবি আয়াতগুলো ইহুদি-খ্রিষ্টানদের হত্যা ও শাস্তির কথা বলেছে। ফরাসি পত্রিকা লি পারিশিয়ান, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে একটি মেনিফেস্টো ছাপায়। ৩০০ জন ফরাসি গণ্যমান্য ব্যক্তি ওখানে স্বাক্ষর করেন। ওই তালিকায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস, সেরা গায়ক চালর্স আজনাভোর প্রমুখও ছিলেন। এখনো এসব কার্যক্রম মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত রয়েছে। প্যারিসে আগুন বোমা ও শূকরের মাথা মসজিদে নিক্ষেপ করা, বোরাকা বা হিজাবধারী মহিলাদের রাস্তায় অপমান ও গুলি করে হত্যা করা চলছেই। রম্য ম্যাগাজিন শার্লি এবদোতে আক্রমণের পর মুসলমানদের ওপর এই সহিংসতা বেড়ে গিয়েছিল। তুরস্ক সরকারিভাবে এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন।
শার্লি এবদো পত্রিকায় আক্রমণের পর ইসলামী বই পুস্তকের বিক্রি হঠাৎ বেড়ে যায়। কুরআন-বিষয়ে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা দ্রুত বিক্রি হতে থাকে। ফ্রান্সের লোকজন ইসলাম সম্পর্কে নানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য বইয়ের দোকানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফ্রান্সের পুস্তক সমিতি এসব তথ্য প্রকাশ করে। চেইন শপ লা প্রকিউর জানায়, আসলে ইসলাম কি এবং আইএস তাহলে কি করছে এসব জানার জন্য বই বিক্রি বেড়ে যায়। শার্লি এবদো পত্রিকা ও ইহুদিদের সুপার মার্কেটে আক্রমণের পর ইসলাম সম্পর্কে জানতে ফরাসিদের আগ্রহ বাড়ে। অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। একজন ক্যাথলিক মহিলা কুরআন কিনতে আসেন। তিনি নিজে পড়ে দেখতে চান আসলে ‘ভায়োলেন্স’ সম্পর্কে কুরআনে কি লেখা আছে। ইসলামের প্রতি উৎসর্গীকৃত বই খ্রিষ্টানদের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণে বাজারে আসতে থাকে। একাডেমিশিয়ান ও স্কলাররাও কুরআন সম্পর্কে উৎসাহ দেখায়। মার্চে ফ্রান্সের বই মেলায় একটি বইয়ের স্টলে হাজার হাজার কপি বিক্রি হলে স্টল শূন্য হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে “A Christian Reads The Quran,” বইটি ছাপা হলেও তেমন বিক্রি হয়নি কিন্তু বই মেলায় একটি স্টলে শুধু এই বইটি বিক্রি হয়েছে, হাজার হাজার কপি। এ ছাড়া “The Silent Qur'an, the Talking Quran” এবং “May Allah bless France.” বই দু’টিও বেস্ট সেলারের তালিকায় উঠে আসে। আবদুন নূর বিদারের “Plea for Fraternity” বইটিও প্রচুর বিক্রি হয়।
ম্যাক্রোঁ শার্লি এবদোতে পুনঃপ্রকাশিত মোহাম্মদ সা:-এর ব্যঙ্গচিত্রের কোনো সমালোচনা করেননি ম্যাক্রোঁ। তিনি পত্রিকা রক্ষা করতে গিয়ে বলেন, ‘ফ্রান্সে মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে এবং বিশ্বাসের অধিকার রয়েছে।’ তবে ঘৃণা যেন না ছড়ায় সেজন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধেরও প্রয়োজন রয়েছে। ২০১৫ সালে পত্রিকা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ শুরু করে। এর আগে ২০০৭ সালে আদালত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ আনতে অস্বীকার করে।
প্যারিসে প্রেস কনফারেন্সে এনজিও কর্মী জনাব ইদ্রিস সিহামী বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৭৩টি মসজিদ, প্রাইভেট স্কুল ও কর্মক্ষেত্র মৌলবাদের অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ম্যাক্রোঁ দাবি করেন তিনি -এর বিরুদ্ধে কাজ করছেন। তিনি প্রচার করছেন, মৌলবাদীরা ফরাসি রিপাবলিকের আইনের চেয়ে তাদের আইনকে বড় মনে করে। এটা একটি সমস্যা। ইদ্রিস সিহামি ম্যাক্রোঁর এই কাজকে প্রতিহত করার জন্য মুসলমানদের ঐক্য বদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। পুলিশ তাকে ১৪ অক্টোবর ২০২০, বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে মারধর করে। ম্যাক্রোঁ সামনের ডিসেম্বরে সংসদে বিল উত্তাপন করছেন। ১৯০৫ সালে ফ্রান্সে রাষ্ট্র থেকে চার্চকে আলাদা করা হয়েছিল। সেই আইনকেই এখন আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে। তাই অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ইসলামের জন্য রাষ্ট্রীয় বাজেট কেন?
ম্যাক্রোঁর ইসলাম ও তুর্কি স্বার্থবিরোধী কাজকর্মের জন্য এর আগেও এরদোগান সাবধান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ম্যাক্রোঁ ‘ব্রেন ডেথ’ সমস্যায় আক্রান্ত, তার চিকিৎসা দরকার। এবার প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ম্যাক্রোঁ ইসলাম রিফর্ম করার ব্রত গ্রহণ করেছেন এবং বিভিন্নভাবে ইসলামকে আক্রমণ করছেন ফলে ফ্রান্সে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।” ইসলামের উত্থান ম্যাক্রাঁর পছন্দ নয়, তাই ইসলামফোবিয়াকে তিনি দাঁড় করিয়েছেন। ২ অক্টোবর তিনি নতুন বিল এনেছেন, যেখানে মুসলমানদের কোন প্রতীক-নিদর্শন প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা যাবে না। এতে মুসলিম মহিলাদের হিজাব ও পুরুষদের টুপি-পাগড়ি পরিধান করাকে আঘাত করা হবে, যা আগে থেকে চলে আসছে। ম্যাক্রোঁর এই কাজ ফ্রান্সের মুসলমানদের আহত করেছে তারপর শার্লি এবদোর ‘ব্যঙ্গচিত্র’ বিশ্ব মুসলিম সমাজের বুকে আঘাত হেনেছে। ম্যাক্রোঁ এটিকে বলেছে ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’। মুসলিমরা কি চিরকাল মুখ বুজে এসব সহ্য করবে?
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার