নূর ইনায়েত খান : স্পাই কুইন

উসাইদ সিদ্দিকি | Nov 04, 2020 05:49 pm
নূর ইনায়েত খান

নূর ইনায়েত খান - ছবি সংগৃহীত

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত নাৎসিদের হাতে ধরা পড়ে নিহতও হয়েছিলেন। কিন্তু তবুও ১৮ শতকের মহিশুর রাজ্যের মুসলিম শাসক টিপু সুলতানের বংশধর এই নারী কয়েক দশক ধরে প্রায় বিস্মৃতির আড়ালেই ছিলেন।
যুদ্ধে তার অবদানের সামনে আসে ২০০৬ সালে শ্রাবণী বসুর লেখা নূরের জীবনী স্পাই প্রিন্সেস প্রকাশিত হওয়ার পর।

চলতি বছর ব্রিটেন নূরকে ব্লু প্লাকে পুরস্কৃত করে। ফ্রান্সে স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ (এসওই) হিসেবে আত্মত্যাগের জন্য প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে এই পুরস্কারে ভূষিত হলেন তিনি।তাকে প্যারিসে নাৎসি জার্মানির গোপন পুলিশ বাহিনী গেস্টাপো আটক করে জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হয়।১৯৪৪ সালে সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়।
তার সম্মানে ২০১৪ সালে একটি স্ট্যাম্প ইস্যু করা হয়। এছাড়া খবর পাওয়া গেছে, শিগগিরই তার চেহারা দেখা যাবে ব্রিটিশ মুদ্রায়।
বীরোচিত প্রয়াসের কারণে নূরকে মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক জর্জ ক্রসে ভূষিত করা হয় ১৯৪৯ সালে ফ্রেঞ্চ ক্রইক্স ডি গ্রয়ের, এবং ১৯৪৬ সালে ফরাসি সরকার সামরিক সম্মানে ভূষিত করে।

অ্যা কল টু স্পাই নামের একটি বায়োপিক ২ অক্টোবর প্রকাশিত হয়।এতে নূরসহ তিন নারী ব্রিটিশ গোয়েন্দার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার অবদানের কথা স্মরণ করা হয়।
উল্লেখ্য, নূর কেবল গুপ্তচরই ছিলেন না, সেইসাথে শিশু সাহিত্যিক ও শান্তিবাদীও ছিলেন।
নূরের চরিত্রে অভিনয়কারী রাধিকা আপ্তে লন্ডন থেকে আল জাজিরাকে জানায়, আমি এখন পর্যন্ত যা দেখেছি, তাতে মনে হয়, নূর ইনায়েত খানই অনন্যসাধারণ লোক।

শ্রাবণী ২০১২ সালে নূরের নামে একটি মেমোরিয়াল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি লন্ডন থেকে আল জাজিরাকে বলেন, নূরের যুদ্ধে লড়াই করার দরকার ছিল না। কিন্তু তিনি যুদ্ধ করেছেন অহিংসার জন্য, ধর্মের বিশ্বজনীনতার জন্য, ফ্যাসিবাদ ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।
যুদ্ধের আগে নূর অনেকটাই শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতেন। তিনি শিশু সাহিত্যিক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন, স্থানীয় ফরাসি রেডিও ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত অংশ নিতেন।
তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে ছিল টুয়েন্টি জাতকা টেলস। এটি ছিল বৌদ্ধের পুনর্জন্ম নিয়ে কাহিনীর অনুবাদ।

সহজাত স্বার্থপরতাহীন
নূরের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি, রুশ রাজধানী মস্কোতে। তার বাবা ইনায়েত খান ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ ও সুফি সাধক। মা আমিনা বেগম (আগের নাম ওরা রে বাকের)। তার পরিবার ওই বছরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লাগলে ইংল্যান্ডে চলে আসেন।
ইনায়েত খান তার ভারতপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্রমবর্ধমান হারে ব্রিটিশদের নজরে ছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালে পরিবার নিয়ে প্যারিসে চলে যান। এখানে তিন ছোট ভাইবোনকে নিয়ে ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত কাটিয়েছিলেন নূর। তার প্র-প্র-প্র-প্রপিতামহ টিপু সুলতান ১৭৯৯ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় মারা গিয়েছিলেন।

নাৎসিরা ১৯৪০ সালে ফ্রান্স দখল করলে নূরের জীবনে ব্যাঘাতের সৃষ্টি হয়। তিনি আরো হাজার হাজার ফরাসি অধিবাসীর সাথে দ্বিতীয়বারের মতো ব্রিটেনে চলে যান।
পৌঁছেই তিনি যুদ্ধকাজে জড়িয়ে পড়েন, ওমেন্স অক্সিলারি এয়ার ফোর্সে যোগ দেন। ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে ইউকের রয়্যাল এয়ার ফোর্সে তিনি ছিলেন নারী স্বেচ্ছাসেবক। শ্রাবণী জানিয়েছেন, এখানে তিনি দারুণ কাজ করেছেন।

শ্রাবণী তার স্পাই প্রিন্সেসে লিখেছেন, নূরের মতো নাৎসি মতাদর্শ ও ইহুদিদের বিরুদেধ তাদের পগ্রম জঘন্য ধরনের বীভৎস এবং তার পিতা যে ধর্মীয় সম্প্রীতির নীতির আলোকে তাদের গড়ে তুলেছেন, তার পরিপন্থী।
শ্রাবণী বলেন, তিনি জন্মসূত্রে মুসলিম ছিলেন, তবে তিনি এক ইহুদিকে ভালোবাসতেন। আর নূর মনে করতেন, যুদ্ধকাজে কিছু করা দরকার।

নূরের বাবা ইনায়েত ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক।
শ্রাবণীর স্পাই প্রিন্সেসের মতে, ইনায়েত ছিলেন অহিংসার দৃঢ় বিশ্বাসী। তিনি সব ধর্মের একত্বে বিশ্বাস করতেন এবং ওই বিশ্বাসেই নূরকে গড়ে তুলেছিলেন। তার বাবা ভারত সফরকালে মারা যান ১৯২৭ সালে। তখন তার সবচেয়ে বড় সন্তান নূরের বয়স ছিল ১৩ বছর। মায়ের সহায়তায় তিনি তার ভাইবোনদের মানুষ করেন।

নূরের ভাতিজা ও ইনায়েতি তরিকার নেতা পীর জিয়া ইনায়েত খান আল জাজিরাকে বলেন, একেবারে শৈশব থেকে নূর ছিলেন স্বার্থপরহীন, আত্মত্যাগী।
তিনি বলেন, নূর সবসময় নির্যাতিতের পক্ষে দাঁড়াতেন, সে যেই হোক না কেন।
তিনি বলেন, নূর সবসময় চাইতেন নিযাতিতের পক্ষে আত্মত্যাগ করতে। তিনি ব্রিটিশ না হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য কাজ করেছেন, আবার ভারতের স্বাধীনতার পক্ষেও ছিলেন।
কাজটির জন্য নিখুঁত
নূর ছিলেন ফরাসি ভাষায় সাবলীল। তাকে স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ (এসওই)হিসেবে নিয়োগ করে ব্রিটিশ গোপন সংস্থা। এই সংস্থাটি অধিকৃত ইউরোপে স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর সহায়তায় গুপ্তচর পাঠাত।

অ্যাসাইনমেন্টটি ছিল খুবই বিপজ্জনক। তবে তিনি সাথে সাথে তা গ্রহণ করেন।
১৯৪৩ সালে মেডেলিন কোড নামে তাকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। তিনিই ছিলেন প্রথম নারী ওয়্যারলেস অপারেটর, যাকে যুক্তরাজ্য নিয়োগ করেছিল। তিনি লে ম্যান্স সিটিতে নেমে সেখান থেকে প্যারিস যান। সেখানে তার ফরাসি প্রতিরোধ নেটওয়ার্ক প্রসপারের সাথে কাজ শুরু করার কথা।

নিয়োগ লাভের কয়েক দিনের মধ্যেই নাৎসিরা প্রসপারের সব উচ্চপদস্থ এজেন্টকে আটক করে। তাদের ওয়্যারলেস সেটগুলো জব্দ করা হয়। ফলে পরের কয়েক মাস পর্যন্ত নূরই ছিলেন মাঠে একমাত্র অপারেটর।
খুব সম্ভবত তার কোনো এক সহকর্মী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তিনি ধরা পড়েন।অক্টোবরে গেস্টাপো তাকে আটক করে পরের মাসে জার্মানিতে নিয়ে যায়।

গেস্টাপো নূরকে খুবই বিপজ্জনক বন্দী মনে করত। তিনি তাদের নজরদারি থেকে দুবার পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। এক বছরের মতো সময় আটক থাকার সময় তাকে নির্যাতন করা হতো, শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। পরে তাকে কার্লশুহে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই আরো এসওই এজেন্টের সাথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

স্বীকৃতি বাড়ছে
ভারতীয় অভিনেত্রী আপ্তে আল জাজিরাকে বলেন, তিনি অনেক দিন আড়ালে থাকার পর নূর এখন সামনে চলে আসছেন।তাকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে ওই সময়ে ভারতীয়দের অবদানকেই আসলে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে।

সূত্র : আল জাজিরা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us