ইসরাইলকে স্বীকৃতি : কেমন হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য?
নেতানিয়াহু ও মোহাম্মদ বিন সালমান - ছবি সংগৃহীত
ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানকারী আরব রাষ্ট্র ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরব আমিরাত এবং বাহরাইন তৃতীয় ও চতুর্থ আরব দেশ যে দুটি রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। এর আগে ১৯৭৯ সালে মিসরের পরে ১৯৯৪ সালে জর্দান ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা রয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন মধ্যস্থতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সাথে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত একটি সরকারি অনুষ্ঠানে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ইসরাইল। ওই অনুষ্ঠানে ইসরাইল এবং আমিরাত একটি শান্তি চুক্তি করেছে আর বাহরাইনের সাথে শান্তি চুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এই চুক্তির পর সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনে ইসরাইল দূতাবাস স্থাপন করবে আর এই দুটি দেশও ইসরাইলে তাদের দূতাবাস খুলবে। এসব দেশের মধ্যে বিমান চলাচলও শুরু হবে। একই সাথে শান্তির বন্ধনে জড়ানো আরব দেশগুলো মৌলিক ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা শুরু করবে। এই চুক্তির পর ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আরব দেশগুলোর অর্থনৈতিক বয়কট এবং নিষেধাজ্ঞার সমাপ্তি ঘটবে; পারস্পরিকভাবে দেশগুলোর সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে অবাধ সহযোগিতা শুরু হবে। চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটি কমিশন গঠন করা হবে; ব্যাংকগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা এবং অর্থপাচার রোধের জন্য যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
চুক্তিস্বাক্ষরকারী দেশগুলো এক দেশ অন্য দেশে দূতাবাস খোলার পাশাপাশি, ইসরাইল জর্দান উপত্যকাকে একীভূতকরণের বিষয়টি স্থগিত রাখবে। নিরাপত্তা ক্ষেত্রে দেশগুলো গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে। প্রতিরক্ষা প্রশ্নে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা একে অন্যের সাথে ইতোমধ্যে যে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন সেটিকে আরো সামনে এগিয়ে নেবেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাইটেক অস্ত্র প্রাপ্তিতে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা ওয়াশিংটন তুলে নেবে। পর্যটন ও সংস্কৃতি খাতে সহযোগিতার অংশ হিসেবে এক দেশ অন্য দেশে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চালু করবে; একই সাথে, নিয়মিত বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
স্বাস্থ্যসেবা এবং বিজ্ঞান খাতে সহযোগিতার অংশ হিসেবে চুক্তিকারী দেশগুলোর স্বাস্থ্য ও বৈজ্ঞানিক কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয়গুলো পরস্পরের মধ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা আদান-প্রদান করবে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই চুক্তির বিচিত্র মতের অনুরণন রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন, কেউ কেউ চুক্তি সম্পাদনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সার্বভৌম অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। কিছু রাষ্ট্র এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। আর অন্য দেশগুলো এই চুক্তিকে ‘ফিলিস্তিনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর তীব্র সমালোচনা করেছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন ছাড়াই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে কার্যত এখন নতুন এক রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে। মিসর ও জর্দানের পর মধ্যপ্রাচ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। এরপর স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছে সুদান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের নেতারা বলেছেন, সৌদি আরব ওমানসহ ১০টি দেশ সম্পর্কে ইসরাইলের সাথে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।
এর মধ্যে পবিত্র মক্কা-মদিনা নিয়ন্ত্রণকারী দেশ হিসেবে সৌদি আরব হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র যেটি কার্যত মুসলিম দেশগুলোর নেতা হিসেবে ওআইসি, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকসহ বহুজাতিক ইসলামী সংস্থা নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকা পালন করে আসছিল। সৌদি আরব বিমান চলাচলের জন্য নিজ আকাশসীমা ইসরাইলকে খুলে দেয়াসহ অনেকগুলো পদক্ষেপ নিলেও দেশটিকে স্বীকৃতি দানের কথা সরাসরি বলেনি। রিয়াদ এখনো পর্যন্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক না করার কথাই জানিয়েছে যদিও সৌদি মিত্রদেশগুলো একে একে সবাই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। সর্বশেষ, সুদানের ইসরাইলের সাথে সম্পর্র্ক প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে সন্ত্রাসী দেশের তালিকা থেকে খার্তুমকে বাদ দেয়ার আমেরিকান শর্ত হিসেবে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানের অর্থও সৌদি আরব দেয়ার কথা জানিয়েছে। আর সৌদি আরবের আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য ইসরাইলের কাছে আয়রন ডোম কেনার প্রস্তাবও করেছে রিয়াদ।
পাঠকরা এ কলাম যখন পড়বেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে ফলাফল প্রকাশ পেতে শুরু হবে। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনকারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরো চার বছরের জন্য আমেরিকার ক্ষমতায় থাকবেন কি না তা নির্ধারিত হবে। চার বছর আগে ট্রাম্প যখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হন তখন যে দৃশ্যপট মধ্যপ্রাচ্যে ছিল তা আমূল পাল্টে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছেন ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা ও সিনিয়র উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার। ট্রাম্পের মেয়েও অর্থোডক্স ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং তার পরিবারের সন্তানরাও সবাই ইহুদি হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। ট্রাম্প নিজে এই যোগসূত্রের জন্য গর্ব অনুভব করেন। তিনি নিজ সরকারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রশাসন ও ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন ফিলিস্তিন অ্যাজেন্ডাকে বাদ দিয়ে ইসরাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শান্তি প্রতিষ্ঠাকে সামনে রেখে। সেটি তিনি অনেকখানি শেষ করে এনেছেন।
সাধারণভাবে দুটি দেশের মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয় সমমর্যাদা ও সুবিধার ভিত্তিতে। ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি বেশ খানিকটা আলাদা। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে এ অঞ্চল ছিল ওসমানীয় মুসলিম খিলাফতের অধীনে। তখনকার প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স তুর্কি খিলাফতের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সহায়তা দিয়ে একেকটি অঞ্চলে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এ সব অঞ্চলকে এই দুই উপনিবেশবাদী দেশ মিলে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীন বানিয়ে একেকটি ব্যক্তি ও পরিবারকে শাসক বানিয়ে দেয়। এর বিপরীতে, তাদের সাথে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার চুক্তি সম্পাদন করে।
বৈশ্বিকভাবে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ায় এ সব দেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব এসে পড়ে পশ্চিমা শক্তির নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি নেতাদের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালে ‘বালফোর ঘোষণা’ বাস্তবায়ন হিসেবে ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন ঘটানো হয় ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ডে। এরপর থেকে আরবদের সাথে প্রতিটি সঙ্ঘাতে ইসরাইলকে নিরাপত্তা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ছায়া দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা।
ট্রাম্প প্রশাসন আসার আগ পর্যন্ত এই সহযোগিতা দানের ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি বাহ্যিক আবরণ এ সংক্রান্ত আলোচনায় ছিল। সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনার মূল ভিত্তি ছিল দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ফর্মুলা। সৌদি আরবের অপেক্ষমান যুবরাজ থাকাকালে আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের দেয়া মধ্যপ্রাচ্য শান্তি অর্জনের এই ফর্মুলায় ইসরাইল ও ফিলিস্তিন- এই দুটি স্বাধীন দেশ পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়ে পাশাপাশি থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় পর্যন্ত এই ফর্মুলাকে ভিত্তি ধরেই শান্তি আলোচনা এগিয়ে গেছে।
ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সবকিছু পাল্টে যায়। পশ্চিম তীরে অবৈধ ইসরাইলি বসতিগুলোকে স্বীকৃতি দেয় ট্রাম্প প্রশাসন। শান্তি আলোচনার পক্ষ হিসেবে ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়েই জেরুসালেমকে একতরফাভাবে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। সিরিয়ার গোলান হাইটসে ইসরাইলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেয় ওয়াশিংটন। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ব যে ভূ-খণ্ডে ফিলিস্তিনিরা ছিল সেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক প্রস্তাবকে বাদ দিয়ে পশ্চিম তীর ও জর্দান উপত্যকায় ইসরাইলের দখলদারিত্বের স্বীকৃতি দেয়া শুরু করে ট্রাম্প প্রশাসন। সর্বশেষ, আরব দেশগুলোকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমেরিকার নিরাপত্তা আশ্রয়ে থাকা দেশগুলোকে একের পর এক বাধ্য করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো- আরব দেশগুলো কেন মুসলিম উম্মাহর অভিন্ন অ্যাজেন্ডা পরিত্যাগ করে ইসরাইলকে এভাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছে? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে মধ্যপ্রাচ্যে যেসব রাষ্ট্র গঠন করা এবং যেসব পরিবারকে ক্ষমতা দেয়া হয় তা একেবারে শর্তহীন ছিল না। এসব দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও শাসক পরিবারের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদি এমনকি কোনো কোনো রাজপরিবারের সাথে শত বছরের গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই অঞ্চলের নেতা হিসেবে চিহ্নিহ্নত সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে চুক্তির মূল শর্ত ছিল রিয়াদ ওয়াশিংটনের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অন্যান্য রাজনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করবে আর কৌশলগত ক্ষেত্রে মিত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। অন্যদিকে, আমেরিকা সৌদি অখণ্ডতা ও ক্ষমতার নিরাপত্তা দেবে।
আশির দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একক নিয়ন্ত্রক পরাশক্তিতে পরিণত হয়। এর মধ্যে আমেরিকার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমে যায়। ২০৫০ সাল নাগাদ সময়ে বিশ্ব বিকল্প জ্বালানিনির্ভর হওয়ার আগে আমেরিকা নিজস্ব মজুদ থেকে জ্বালানি উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। আর একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আগের কৌশলের পরিবর্তনও শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে উদার গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা প্রদানের বিষয় আমেরিকার কৌশলে স্থান লাভ করে। এর পথ ধরে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হয়। তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, লিবিয়ার সরকারের পতন ঘটে। অন্য দেশগুলোতেও শাসন পরির্তনের ঢেউ লাগে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব শাসকরা এই ঢেউকে থামিয়ে দেয়ার জন্য কথিত ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে সামনে হাজির করেন। অবাধ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী দলগুলো ক্ষমতায় আসতে শুরু করলে রাজতান্ত্রিক পাল্টা প্রতিরোধ ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের একটি অংশের সমর্থন লাভ করে। মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ড. মুরসির গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর রিভার্স বিন্যাস শুরু হয়।
এই প্রক্রিয়া চলাকালে ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসেন। ট্রাম্পকে যারা ক্ষমতায় আসতে সহযোগিতা করে তার প্রধান শক্তি ছিল আন্তর্জাতিক ইহুদি নিয়ন্ত্রক ‘ফ্রি ম্যাসন’ আন্দোলন।
এই শক্তিটি বিশেষভাবে চেয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বিন্যাস ঘটাতে আর যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহারের যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেখানে ইসরাইলকে স্থলাভিষিক্ত করতে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রটি যখন প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন চারপাশের সবগুলো রাষ্ট্র ছিল সুন্নি আরব দেশ। সঙ্গত কারণে ইসরাইলের সাথে সব কটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় এসব দেশের সাথে। এর মধ্যে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিসর, ইরাক, লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ায় সামরিকজান্তা ক্ষমতায় আসে। এসব দেশের বেশির ভাগ আমেরিকান বলয় থেকে সোভিয়েত বলয়ে চলে যায়। তবে গণতন্ত্রের কার্যকর চর্চা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে সেভাবে ঘটেনি।
১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে পরিবর্তনের পর ‘ইসলামী বিপ্লব’ রফতানির ঘোষণায় আরব দেশগুলো নিরাপত্তা সঙ্কটে পড়ে যায়। এরপর তারা ইরাক-ইরান যুদ্ধ বাধিয়ে দশককাল ইরানি প্রভাব সম্প্রসারণ ঠেকিয়ে রাখে। যুদ্ধ অবসানের পর পুনর্গঠন কাজে আরো কিছুকাল সময় লেগে যায় তেহরানের। এরপর ইরান তার প্রভাব সম্প্রসারণের জন্য দুটি কেন্দ্রকে বেছে নেয়। এর একটি হয় বায়তুল মোকাদ্দাস আর অন্যটি মক্কা-মদিনা। এই লক্ষ্যবস্তু করা ইসরাইল ও তার পৃষ্ঠপোষকদের জন্য একটি সুযোগ অবারিত করে দেয়। ইরান সিরিয়া লেবানন হয়ে ইসরাইলি সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অন্যদিকে সাদ্দামের পতনের পর ইরাকের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের দক্ষিণের সীমান্ত, অন্যদিকে ইয়েমেনে হাউসিদের মাধ্যমে ইয়েমেন সীমান্ত পর্যন্ত প্রভাব সম্প্রসারণ করে। ইরানের এই প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সম্ভবত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষকরা করে দিয়েছে।
ইরানের এই নিরাপত্তা হুমকিকে সামনে রেখে ইসরাইল সুন্নি আরব রাষ্ট্রগুলোকে অভিন্ন নিরাপত্তা বলয়ে নিয়ে আসার জন্য কাছে ডাকে। এদিকে ২০০২ সালে ন্যাটো দেশ তুরস্কে ক্ষমতায় আসে ইসলামী পটভূমি থেকে তৈরি হওয়া রক্ষণশীল দল একে পার্টি। দলটি তুরস্কের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শক্তি অর্জন করার পর এটি মধ্যপ্রাচ্যে নৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিরাজ করা ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি হয় তুরস্কের। এর আগে ব্রাদারহুডের সাথে সমঝোতা ছিল সৌদি আরবকেন্দ্রিক উপসাগরীয় দেশগুলোর। আরব বসন্তের সময় তুরস্ক ও কাতারের সমর্থনপুষ্ট হয়ে এই শক্তিটি আরব জাগরণে মুখ্য ভূমিকা রাখার পর রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তিগুলোর সামনে ইরান বলয়ের পাশাপাশি আরেক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয় তুর্কি বলয়। ইরানের প্রভাব বিস্তারে শক্তির উৎস হয় শিয়া মুসলিম শক্তি। অন্যদিকে তুর্কি বলয়ের প্রভাব বিস্তারে ছায়াশক্তি হয় ব্রাদারহুড ও তার মিত্ররা।
এই দুই শক্তিকে দমন ও নিশ্চিহ্নহ্ন করার কর্মসূচি হাতে নেয় রাজতান্ত্রিক আরব রাষ্ট্রগুলো। তাদের এই তৎপরতা গত অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখা গেছে। এখন রাজতান্ত্রিক প্রভাব ধরে রাখার শক্তিমত্তা ও অভ্যন্তরীণ জনসমর্থন ক্ষীণ হতে শুরু করায় উপসাগরীয় এসব দেশ নিরাপত্তা আশ্রয় পেতে চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনই এসব দেশকে নিরাপত্তার ছায়া দিতে চাইছে ইসরাইলি ছাতার নিচে। আমিরাত, বাহরাইন, সুদান, ওমান ও সৌদি আরব এবং অন্য দেশগুলো ইসরাইলের সাথে আজ যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে শুরু করেছে সেটি রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য তাদের সর্বশেষ অবলম্বন। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বলয়ের কৌশলগত ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে হয়েছে এসব দেশকে। এখন তাদের আকাক্সক্ষা ও স্বার্থ পূরণ করতে হবে ইসরাইলকে।
লেখার প্রথমে উল্লেখ করা ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সাত দফা চুক্তি ও সমঝোতা অবলোকন করলে দেখা যাবে- অর্থনীতি, রাজনীতি, স্বাস্থ্য ও পর্যটন থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে ইসরাইলের সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে এসব দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আগের শতবর্ষব্যাপী চুক্তিতে দেয়া-নেয়ার মধ্যে যে এক ধরনের ভারসাম্য ও কৌশলগত স্বায়ত্বশাসনের ব্যবস্থা ছিল ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির মধ্যে সেটি রক্ষিত হবে বলে মনে হয় না।
ইসরাইলের একটি বৃহত্তর মানচিত্র প্রতিষ্ঠার মতবাদ রয়েছে। এই মতবাদ হলো মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এ কারণে ইসরাইল কখনো তার স্বীকৃত মানচিত্র প্রকাশ করে না। আর একই কারণে ইসরাইল স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে দেয়ার আলোচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। যে সব আরব রাষ্ট্র- ট্রাম্পের বক্তব্য অনুসারে ১০টি দেশ- ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে তারা এক ধরনের ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ করতে চলেছে ইহুদি রাষ্ট্রটির সাথে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আরেক মেয়াদের জন্য আমেরিকার ক্ষমতায় এলে আরব দেশগুলোর এই অধীনতামূলক মিত্র হওয়ার ব্যবস্থাটি আরো সুদৃঢ় হতে পারে। আর জো বাইডেনের প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কিছুটা রাখডাক সৃষ্টি হতে পারে। সৌদি আরব ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো প্রাপ্তি ছাড়াই ইসরাইলের বন্ধু হওয়ার জন্য যে চাপের মুখে পড়েছে সেটি শিথিল হতে পারে। তবে এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, মধ্যপ্রাচ্য যা কিছু হচ্ছে তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেট তথা প্রকৃত ক্ষমতার বলয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
আরেকটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দেবে, সেটি হলো ইসরাইলের অধীনতামূলক মিত্র হয়ে আরব শাসকরা নিজ নিজ দেশে কি ক্ষমতা বজায় রাখতে পারবেন? এই প্রশ্নের জবাব হতে হবে অনুমান বা পর্যবেক্ষণনির্ভর। এক সময়ের প্রভাবশালী, এখন ক্ষমতার বাইরে থাকা, প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আরো ১০০ বছর ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে সৌদি রাজ পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বোঝাপড়া হয়েছে। রিয়াদের অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, সৌদি গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান ইচ্ছাকৃতভাবে একটি শূন্য হয়তো বেশি বলেছেন। বর্তমান সমঝোতা অনুসারে আরো ১০ বছর হয়তো বর্তমান অবয়বে সৌদি আরব ও উপসাগরীয় মিত্রদেশগুলো টিকে থাকতে পারে। এর পর নতুন বিন্যাস অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। সৌদি পরিবারের শাসন এলাকা থেকে পবিত্র ভূখণ্ডগুলো বেরিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠন হওয়াও বিচিত্র নয়।
মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক ও ইরান বলয়ের যে উত্থান চলছে সেটিকে দমিয়ে দিতে আমিরাত সৌদি বলয়ের প্রচেষ্টা ইসরাইলের সহযোগিতায়ও খুব বেশি দূর যাবে বলে মনে হয় না। মধ্যপ্রাচ্যে একটি আদর্শিক শক্তির উত্থান ঘটছে। সেই শক্তিকে অবদমন করা কঠিন হতে পারে। বিশেষত করোনা-উত্তর যে বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে সেটি বৈশ্বিক ব্যবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সে জন্য সতর্ক মন ও পর্যবেক্ষণী চোখ দিয়ে আবলোকন করতে হবে সব কিছু।
mrkmmb@gmail.com