শার্লির ধৃষ্টতা ক্ষমার অযোগ্য
ফরাসি প্রেসিডেন্ট - ছবি সংগৃহীত
আমাদের প্রিয় নবীজী হজরত মুহাম্মদ সা:। আমরা তাঁকে ভালোবাসি। তিনি আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়।
গত ৩০ অক্টোবর ছিল ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা:। মহানবী সা:-এর জন্ম ও ওফাতের পুণ্য স্মৃতিময় দিন। আবার এই দিনেই তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। তাই এই ঐতিহাসিক দিনটিকে বিশ্বের ২০০ কোটিরও বেশি ধর্মপ্রাণ মুসলমান মহিমান্বিত দিন হিসেবে বিবেচনা করে।
আর মুসলমানদের এই আবেগের জায়গায় আঘাত করার জন্যই পবিত্র রবিউল আউয়াল মাস সামনে রেখে ফ্রান্সের ব্যঙ্গ সাপ্তাহিক শার্লি এবদো মহানবী সা:কে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেছে। শুধু এবারই নয়, এর আগেও ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি শার্লি একই কাজ করেছিল। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরেও পত্রিকাটি মহানবী সা:-এর অবমাননাকর ছবি ছেপেছিল। এবার পত্রিকাটি প্রচ্ছদে ছেপেছে ১২টি ব্যঙ্গকার্টুন। এর সাধারণ প্রচার সংখ্যা ৬০ হাজার। কিন্তু এ সংখ্যাটি তারা ছেপেছে ৩০ লাখ কপি। শার্লি শুধু মহানবী সা:কেই অবমাননা করেনি, বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এবং যারা নবীজীকে ভালোবাসে তাদের হৃদয় ও অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। এর তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাই।
শার্লির ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের পর প্যারিসের উপকণ্ঠের একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ক্লাসে ওই কার্টুন দেখিয়ে তথাকথিত ‘বাক-স্বাধীনতার’ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তব্য দেন। এর আগে তিনি ভালো না লাগলে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। একজন শিক্ষক হয়েও তিনি চিন্তা করেননি যে, এটা শিক্ষার্থীদের মনে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। মুসলিম শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্যদের কেউও তো এটাকে নেতিবাচক মনে করতে পারে। কিন্তু তিনি মহানবী সা:-এর বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্মাতে কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের মাঝে জঘন্য প্রচার চালান। এ ঘটনার পর ১৬ অক্টোবর ১৮ বছরের এক চেচেন তরুণ স্যামুয়েলকে খুন করে।
ফরাসি সরকারের যেখানে ধৈর্যের সাথে এ পরিস্থিতি সামাল দেয়া দরকার ছিল, তা না করে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ স্বয়ং আগুনে ঘি ঢালেন। তিনি ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড ও মহানবী সা:-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন রাষ্ট্রীয়ভাবে অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন এবং সরকারি বহুতল ভবনে তা ঝুলিয়ে দেন। শার্লি বিশ্বের ২০০ কোটিরও বেশি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে যে চরম আঘাত হেনেছে, সে দিকে না তাকিয়ে ফ্রান্সের তথাকথিত ‘বাকস্বাধীনতার’ যুক্তি দেখিয়েছেন ম্যাক্রোঁ। ফলে ওআইসিসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এসব দেশে বিক্ষোভ চলছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদসহ বিশ্বনেতারাও জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোতে ফরাসি পণ্য বর্জন শুরু হয়েছে। আরববিশ্ব বিশেষ করে কুয়েত, জর্দান ও কাতারের বড় বড় সুপার মার্কেট থেকে ফরাসি পণ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
ফ্রান্সের আয়ের প্রধান উৎস ট্যুরিজম। করোনা মহামারীর কারণে তা এখন পুরোপুরি বন্ধ। এমন মুহূর্তে পণ্য বয়কট আন্দোলন ফ্রান্সের জন্য বড় আঘাত হয়ে দেখা দিয়েছে। সেটা বোঝা যাচ্ছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে। তারা মধ্যপ্রাচ্যকে পণ্য বয়কট তুলে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। সহজেই অনুমেয় এই ঘটনায় বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছে ফ্রান্স। অনেকের মতে, পণ্য বয়কট আন্দোলন কয়েক মাস এভাবে চালাতে পারলে ফরাসিরা ও প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ তাদের ভুল বুঝতে সক্ষম হবে। ভুল শিক্ষা নিয়ে মুসলমানদের কাছে ম্যাক্রোঁ দুঃখ ও ক্ষমা চাইবেন এটা সবাই আশা করে।
বিশ্বজগতের রহমত মহানবী সা:
মহানবী সা: সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বোত্তম সৃষ্টি। মহত্তম আদর্শের অধিকারী। তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য শ্রেষ্ঠতম পথিকৃৎ এবং বিশ্বজগতের রহমত। বিশ্ব সভ্যতায় তাঁর অবদান সর্বাধিক এবং সমগ্র বিশ্ব মানবের কল্যাণের জন্য তিনি প্রেরিত।
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা: শুধু শ্রেষ্ঠ মানুষই নন, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে হজরত ঈসা আ: পর্যন্ত যত নবী ও রাসূল দুনিয়ায় এসেছেন, তিনি তাঁদের সবার নেতা, সাইয়িদুল মুরসালিন।
মানবজাতির জন্য মহানবী সা: ‘উসওয়াতুন হাসানা’... সুন্দরতম আদর্শ। তিনি এসেছিলেন দুনিয়ায় এক যুগসন্ধিক্ষণে, জাহেলি যুগের বর্বরতায় সীমাহীনতায় আলোর মশাল হয়ে। ওই সময় পাশবিকতা, হিংস্রতা, পৌত্তলিকতা, কুসংস্কার নানা অপকর্মে ডুবে ছিল মানুষ। কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। বহু দেবতার পূজারি ছিল (‘তারা যেন পশুর মতো বরং পশুর চেয়েও বিপথগামী।’ সূরা ফুরকান, আয়াত ৪২)। মহান আল্লাহ ঠিক এ সময়ে মহানবী সা:কে মানবজাতির মুক্তির, সুন্দর জীবনযাপনের পথপ্রদর্শক বা ত্রাণকর্তা হিসেবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন।
নবীজী সা: ছোটবেলা থেকেই সৎ চরিত্র, সত্য বলা এবং নিঃস্বার্থ সমাজসেবার জন্য পরিচিত ছিলেন। এ জন্য কৈশোরেই তিনি নিজ সমাজের লোকদের কাছ থেকে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত এবং ‘আস-সাদিক’ বা সত্যবাদী উপাধি পেয়েছিলেন।
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়শা রা: রাসূল সা: সম্পর্কে বলেন, ‘পবিত্র কুরআনই তাঁর চরিত্র। মহান আল্লøাহ বিশ্বনবী সা:কে এমন মর্যাদা দিয়েছেন, এমন গুণাবলি ও চরিত্র মাধুর্য দিয়েছেন যা আর কাউকে দেয়া হয়নি।
মহান আল্লøাহ পবিত্র কুরআনে বিশ্বনবী সা:-এর মর্যাদা ও সম্মান ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। ‘আর আমি আপনার জন্য আপনার চর্চাকে (খ্যাতি) সুউচ্চ করেছি।’ (সূরা আলাম নাশরাহ, আয়াত-৪) মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানা, অর্থাৎ- তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহজাব, আয়াত ২১)
পৃথিবীর মানুষকে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবের সর্বোত্তম গুণের কথা জানিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতুল্লিল আলামিন’, অর্থাৎ- (হে নবী), আমি আপনাকে বিশ্বজাহানের জন্য করুণার নিদর্শন হিসেবে পাঠিয়েছি।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭) বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে প্রেরিত মহামানবের কুরআনে উল্লিখিত অপর গুণটি হলো তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ‘ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকুল আজিম’, অর্থাৎ- হে রাসূল, আপনি সর্বোত্তম চারিত্রিক মাধুর্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছেন।’ (সূরা কলম, আয়াত ৪) কুরআনে সূরা আহজাবের ৪৬ নম্বর আয়াতে মহানবী সা:কে বলা হয়েছে, ‘সিরাজাম মুনিরা’, অর্থাৎÑ আলোকবর্তিকারূপে পাঠানো হয়েছে।’ একই সূরার ৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী, আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে।’ মহানবী সা: বলেন, ‘ইন্নামা বুইসতু মুআল্লিমুন’, অর্থাৎ ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে মানবতার শিক্ষকরূপে।’
হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন একজন আদর্শ পিতা, আদর্শ স্বামী, আদর্শ যোদ্ধা, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক এবং আদর্শ ধর্মপ্রচারক। তাঁর জীবন ও চরিত্র ইতিহাসে এত স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, তাঁর কথা ও কাজের বিবরণ সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ’ বলেন, ‘আমি মুহাম্মদকে অধ্যয়ন করেছি। আমার বিশ্বাস, তাঁকে মানবজাতির ত্রাণকর্তা বলাই কর্তব্য। যদি তাঁর মতো কোনো ব্যক্তি আধুনিক বিশ্বের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন তবে তিনি এর সমস্যাগুলো এরূপভাবে সমাধান করতে পারতেন যাতে বহু অনাকাক্সিক্ষত শান্তি ও সুখ অর্জিত হতো।’
মহানবী সা: জীবনের শেষ ভাষণে (বিদায় হজের ভাষণ) বলে গেছেন, মানুষে মানুষে কোনো ভেদ নেই। আরবের ওপর কোনো অনারবের কিংবা অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার ওপর কালোর কিংবা কালোর ওপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সেই ব্যক্তিই সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহকে ভালোবাসে। ঈর্ষা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিয়ে তিনি বলেছেন, ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সব সৎ গুণকে ধ্বংস করে। নারীদের ওপর অত্যাচার না করতে বলেছেন তিনি। অধীনস্থ বা কাজের মানুষদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তা খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে, তাদেরকে তা পরাবে।’ শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার পাওনা পরিশোধ করতে বলেছেন তিনি। বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বা কৌলিন্যপ্রথা বিলুপ্ত করে তিনি বলেছেন, কুলীন বা শ্রেষ্ঠ সে-ই, যে বিশ্বাসী ও মানুষের উপকার করে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে তিনি বলেছেন, অতীতে বহু জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।
নবীজী সা: কতটা উদার ও ক্ষমা প্রদর্শনকারী ছিলেন তা মক্কা বিজয়ের ঘটনা থেকেই প্রমাণিত। তাঁকে জন্মভূমি থেকে যথেষ্ট কষ্ট দিয়ে হিজরত করতে বাধ্য করা হয়েছিল। অথচ মক্কা বিজয়ের পর বিশ্বনবী সা: ক্ষমার এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
মহানবী সা:কে অবমাননার পরিণতি
মানুষের হেদায়েতের জন্য মহান আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ। কিন্তু দ্বীন প্রচার করতে গিয়ে তাঁরা বিভিন্ন প্রকার বাধা-বিপত্তি ও অবমাননার শিকার হয়েছেন। মহানবী সা:কেও এমন বাধা ও অবমাননার শিকার হতে হয়েছে। নবীর প্রতি হিংসার কারণেই অমুসলিমরা এ কাজ করে থাকে। মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘তাদের অন্তরে আছে শুধু অহঙ্কার, যা সফল হওয়ার নয়।’
(সূরা মুমিন, আয়াত-৫৬) বুখারির হাদিসে আছে, নবী সা: বলেন, ‘তোমরা কি দেখনি যে, আল্লাহপাক আমাকে কুরাইশদের অবমাননাকর গালি, অভিসম্পাত থেকে পুতপবিত্র রাখেন, তারা আমাকে খারাপ ভাষায় অবমাননা করে আর আমি মুহাম্মদ প্রশংসিত।’ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজানে ও ইকামতে নবীজী সা:-এর নাম উচ্চারিত হয়, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। অবমাননাকারীর অবমাননা থেকে আল্লাহই যথেষ্ট। কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘অবমাননাকারীদের জন্য আমি আপনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট।’(সূরা হিজর, আয়াত-৯৫)
রাসূলুল্লাহ সা:কে অবমাননা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।’ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:কে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকাল ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।’(সূরা আহজাব, আয়াত-৫৭)
ফ্রান্সের ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি এবদো ও সে দেশের সরকার মহানবী সা:কে নিয়ে কার্টুন প্রকাশ করে যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তা ক্ষমার অযোগ্য। এর শাস্তি তারা অবশ্যই পাবে। আমরা তাদের এ ধৃষ্টতার প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানাই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব