ডিমের কি কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে?

দিদারে আলম মহসিন | Nov 02, 2020 04:25 pm
ডিমের কি কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে?

ডিমের কি কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে? - ছবি সংগৃহীত

 

৯ অক্টোবর ছিল বিশ্ব ডিম দিবস। ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক ডিম কমিশনের (আইইসি) ভিয়েনা সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর প্রতি বছর অক্টোবরের দ্বিতীয় গত শুক্রবার বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ কমিশনটি বিশ্বব্যাপী ডিম শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে। ডিমের উপকারিতা এবং মানুষের পুষ্টিতে এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য এ দিবস পালন করা হয়।

ডিম স্মরণাতীত কাল থেকে বাচ্চা-বুড়ো-যুবা নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষের পুষ্টির জোগানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের কাছে ডিম গ্রহণযোগ্য। এটি সর্বোচ্চ মানের প্রাকৃতিক প্রোটিন উৎস। এতে শরীরের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। এ ছাড়াও ডিমে সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় আরো অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যথা- লুটেইন এবং জেক্সানথিন যা চোখের জন্য উপকারী; কোলিন যা মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুর জন্য দরকারি ইত্যাদি; আরো আছে বিভিন্ন ভিটামিন (এ বি এবং ডি)। বস্তুত, ডিম সাশ্রয়ী মূল্যে শীর্ষ-মানের প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং বহুমুখী এমন একটি অনন্য ফুড প্যাকেজ অফার করে, সহজলভ্যতা ও এর অসাধারণ স্বাদ বিবেচনায় নিলে যার কোন তুলনা হয় না। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার আইটেম। বাংলাদেশে আপনি কদাচিৎ এমন কোনো পরিবার খুঁজে পাবেন যারা তাদের নিয়মিত খাবারের তালিকায় ডিম রাখতে চান না।
এই যে বহু গুণে গুণান্বিত ‘ডিম মহাশয়’, তিনি কি আপনার জন্য কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারেন?

সাধারণভাবে ডিম খেলে কিংবা অতিরিক্ত খেলে তা কি কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে? অন্যভাবে, বলতে পারেন, দিনে বা সপ্তাহে কয়টি ডিম খাওয়া নিরাপদ বিবেচিত হতে পারে? বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুকাল ধরে বিতর্ক চলে আসছে, যা এখনো শেষ হয়নি। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ডিমে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলের উপস্থিতি। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি আপনার রক্তের বাজে কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে? হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে কিংবা এহেন ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে? এসব বিবেচনায় দীর্ঘকাল এ ধরনের রোগ বা তার ঝুঁকিতে আছে এমন লোকদের জন্য ডিম, বিশেষ করে এর ‘হলুদ অংশ’ এক রকম অপাঙক্তেয়ই বিবেচিত হয়ে আসছিল। তবে, বহু বছরের গবেষণামূলে বিজ্ঞানীরা এ রকম অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, রক্তের কোলেস্টেরল প্রধানত খাদ্যের সম্পৃক্ত ফ্যাট ও ট্রান্স-ফ্যাট থেকে লিভারে তৈরি হয়, এখানে খাবারের মাধ্যমে নেয়া কোলেস্টেরলের ভূমিকা নেই বললেই চলে। বলা ভালো, ডিমে খুব সামান্য পরিমাণ সম্পৃক্ত ফ্যাট থাকে, কোনো রকম ট্রান্স-ফ্যাট থাকে না।

এর ফলে ডিমের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের চোখে সুদীর্ঘ কাল ধরে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত ডিমের এক রকম প্রত্যাবর্তন ঘটতে চলেছে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত আমাদের জ্ঞান যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তার সারনির্যাস হলো : বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে দিনে একটি করে ডিম হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা অন্য কোনো ধরনের কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ায় না। তবে, আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে, অন্য কোনো কারণে (যেমন ধূমপান) হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকেন, কিংবা ইতোমধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সপ্তাহে তিনটির বেশি ডিম খাওয়া উচিত হবে না।

হ্যাঁ, আপনি ডিমের সাথে আর কী কী খাচ্ছেন তা-ও গুরুত্বপূর্ণ। অন্য খাবারগুলোতে আপনি কতটা স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা ট্রান্স-ফ্যাট গ্রহণ করছেন তা বিবেচনায় নিতে হবে। তবে, মাত্রাতিরিক্ত ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতার বিকল্প নেই। যেমনটি সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক অতিরিক্ত অর্ধেক ডিম- অর্থাৎ সপ্তাহে সব মিলিয়ে তিন থেকে চারটি অতিরিক্ত ডিম- খাওয়ার ফলে একজন ব্যক্তির হৃদরোগের ঝুঁকি ৬% এবং অসময়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ৮% বৃদ্ধি পেতে পারে।

ডিম নিয়ে উদ্বেগের আরেকটি কারণ, এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে সালমোনেলার সংক্রমণ এবং তার ফলে ফুড পয়জনিং হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে, রোগীকে হসপিটালাইজ করা লাগতে পারে। এসব রোগীর ক্ষেত্রে, সালমোনেলা সংক্রমণ অন্ত্র থেকে রক্ত-প্রবাহে এবং পরে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরিশেষে, সময় মতো ও যথাযথ চিকিৎসা ও পরিচর্যা না পেলে এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।

ডিমের খামারে বা বাড়ির পেছনে তৈরি মুরগির ঘরে সম্ভাব্য অনেক সূত্রেই সালমোনেলা সংক্রমণ ঘটতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে যেসব লোক ডিমের কাজ করছে, ইঁদুর, হাঁস-মুরগির খাবার কিংবা ধুলা-বালু।

সাধারণত, রোগাক্রান্ত মুরগির মলমূত্র থেকেই এসব জীবাণু ডিমের গায়ে লাগে। পরবর্তীতে ডিমের খোলসে বিদ্যমান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছিদ্রপথে ভেতরে প্রবেশ করে বংশ বৃদ্ধিও করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সমস্যার সমাধান কি? কেউ হয়তো বলবেন, খামারিরা ডিম ভালো মতো ধুয়ে বাজারজাত করলেই তো হয়। তবে, এতে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। ডিমের গায়ে একটা পাতলা আবরণ থাকে, যা খোলসের সূক্ষ্ম ছিদ্রগুলো বন্ধ করে রাখে এবং এভাবে ডিমের বাহির থেকে ভেতরে জীবাণুর প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ডিম ধুলে এ আবরণটি চলে যায়, ফলে ডিমের ভিতরে জীবাণুর প্রবেশের দ্বার উন্মোচিত হয়। তাহলে উপায়?

এখানে খামারিদের দায়িত্বটা সবচেয়ে বেশি। মুরগির থাকার জায়গা, বিশেষ করে যেখানে ডিম পাড়ে, সেটা নিয়মিত ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা চাই। আর ভোক্তা হিসেবে আপনার করণীয় হলো, ডিম ধরার আগে-পরে আপনার হাত ও তৈজসপত্র ভালো মতো সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। ডিম ভালো মতো সিদ্ধ করে নিলে এসব জীবাণু মারা পড়ে। অর্ধসিদ্ধ কিংবা কাঁচা ডিম অথবা যেসব খাবারে এরূপ অবস্থায় ডিম ব্যবহার করা হয়েছে, তা পরিহার করতে হবে। বাচ্চা, বুড়ো, গর্ভবতী মহিলা এবং ডায়াবেটিস কিংবা অন্য কোন রোগের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন লোকদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) মতে, কক্ষ তাপমাত্রায় ডিমের গায়ে জলকণা ঘনীভূত হতে পারে, যা ডিমের খোলস ভেদ করে ভেতরে ব্যাকটিরিয়া প্রবেশের পথ সুগম করে দেয়। ডিম রেখে দিলে সময়ের সাথে এই ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, কারণ যত সময় গড়ায় ডিমের সুরক্ষাদানকারী বাঁধার প্রাচীর ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। কাজেই, আপনাকে ডিম ফ্রিজে রাখতে হবে এবং ‘সর্বোত্তম মেয়াদ’ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই খেয়ে ফেলতে হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিম বিপণনের ক্ষেত্রে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখের পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে বলে মনে হয় না।

যেহেতু পুরো সমস্যার প্রধান উৎস হচ্ছে খামার পর্যায়ে ডিমের জীবাণু-দূষণ, তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। খামারিদের সচেতন করার জন্য যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং তাদের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করা হয়, তাহলে ডিমের মাধ্যমে এ ধরনের সংক্রমণের আশঙ্কা বহুলাংশে কমে আসবে।

লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us