মালদ্বীপে মার্কিন উপস্থিতি : ভারতের হিতে বিপরীত হবে?
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেইও - ছবি সংগৃহীত
তৃতীয়-দেশ সহযোগিতা খুবই জটিল,অননুমেয় বিষয়। এমনকি সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্ররা পর্যন্ত তা সহজে সামাল দিতে পারে না। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব লর্ড কার্জন ইরাক নীতিতে তেলের প্রভাবের কথা অস্বীকার করলেও আর্কাইভে দেখা যাচ্ছে, উত্তরাঞ্চলীয় তেল ক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্যই ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ সরকার দ্রুত মসুলে সৈন্য পাঠিয়েছিল। অথচ ১৯১৬ সালের প্রথম দিকে গোপন সাইকিস-পিকক চুক্তি অনুযায়ী, ওই এলাকা ফ্রান্সের পাওয়ার কথা।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ওয়াশিংটন ভাবতে শুরু করে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম শক্তির ও প্রভাবের দেশ ব্রিটেন কিভাবে বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড স্টেটিনিয়অস প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লিখেছিলেন, কখনো কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় খাপ খাইয়ে নিতে ইংরেজ চেহারায় কাঠিন্যকে কখনো অবমূল্যায়ন করবেন না।‘
বিষয়টি সামনে আছে ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সঙ্কটের সময়। এ সময় সুয়েজ দখল করার জন্য অভিযান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রকে না জানিয়েই সৈন্য পাঠায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স।প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে ক্ষমতা কতটা বদলে গেছে তা প্রদর্শন করতে পাল্টা আঘাত হানেন। তিনি হামলা বন্ধ না করলে আইএমএফকে ব্রিটেনের জরুরি ঋণ মঞ্জুর করা আটকিয়ে দেন।ব্রিটেন আর কখনো ওয়াশিংটনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়নি।
ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হওয়ার প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের এ ধরনের শিক্ষা কখনো ভোলা উচিত নয়।২০১৪ সালের মে মাসে মোদি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসাকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে উৎখাত করার জন্য ওয়াশিংটনের সাথে আলোচনা শুরু করার মধ্য দিয়ে ভারতের জায়মান ‘ব্লক মানসিকতা’র লক্ষণ দেখা যেতে থাকে।রাজাপাকসা খুবই তিক্ততার সাথে তাকে সরানোর ওই প্রকল্পে সমন্বিত যুক্তরাষ্ট্র-ভারতীয় রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করেছিল বলে জানিয়েছিলেন।
ওই ষড়যন্ত্রে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন দলকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল সিংহলা বৌদ্ধবাদী এস্টাবলিশমেন্টের পকেট সৃষ্টির করে।এতে করে রাজাপাকসার রাজনৈতিক ঘাঁটি দুর্বল হয়ে পড়ে, দুর্ভাগা জাফনার তামিলেরা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কঠিন রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও রাজাপাকসা হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পড়ে যান।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এই কায়দায় সরকার পরিবর্তন ঘটে শ্রীলঙ্কাতেই।তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের কাজ ল্যাতিন আমেরিকায় অনেকবার করেছে।
চীনের বিরুদ্ধে প্রবল বৈরিতার বিষয়টি অনেক দিন থেকেই ভারতের ক্ষমতাসীন এলিটদের মনে গেঁথে ছিল। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির প্লাটফর্মে পরিণত হওয়ার জন্য ছোট্ট প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাকে টেনে আনাটা ছিল ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন।বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার জোট নিরপেক্ষ ভূমিকার থাকার বিষয়টি যদি বিবেচনা করা হয়।
কলম্বোর বর্তমান ক্ষমতাসীন এলিট যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ব্যাপারে চরমভাবে উৎকণ্ঠিত রয়ে গেছে। পাশের দেশ মালদ্বীপের ঘটনাও সতর্ক ঘণ্টা বাজাচ্ছে।
আর ২৮ অক্টোবর কলম্বোতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইওর সফরের সময় বিষয়টি পরিষ্কারভাবেই দেখা গেছে। তিনি সংবাদ সম্মেলনের বলেন, সার্বভৌম, মুক্ত, স্বাধীন দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রনীতি স্বতন্ত্র, জোটনিরপেক্ষ ও বন্ধুপ্রতীম থাকা উচিত।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসার সাথে পম্পেইওর বৈঠকের পর প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রনীতি নিরপেক্ষতার ভিত্তিতেই প্রণীত। শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য দেশের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ কিছু শর্তের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। এসবের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, উন্নয়ন সহযোগিতা।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়,প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেছেন, শ্রীলঙ্কা তার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা প্রশ্নে কোনো আপস করবে না।চীনা সহায়তার কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ অবসানের পর থেকে চীন উন্নয়ন খাতে সহায়তা করে যাচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ছে না শ্রীলঙ্কা।
অর্থাৎ এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে মালদ্বীপের পর শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভারত মহাসাগরের সেকেন্ড আইল্যান্ড চেইন স্ট্র্যাটেজিতে পড়বে বলে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত যে কল্পনায় বিভোর ছিল, তা আর বাস্তবে পরিণত হচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালে যখন মালদ্বীপকে সোফা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল, তখন ভারত অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে তারা বরং একে স্বাগতই জানিয়েছে।
ভারত মনে করছে, ১,১৯০টি দ্বীপ ও ২৬টি অ্যাটলে ছড়িয়ে থাকা মালদ্বীপে ১৬ হাজার মাইল দূর থেকে আসা যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করলে তা ভারতের দীর্ঘ মেয়াদি উপকারেই আসবে।
ভারত আসলে স্মৃতিভ্রমে ভুগছে। তারা দিয়াগো গার্সিয়ার ট্রাজিক কাহিনী ভুলে গেছে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিয়াগো গার্সিয়া ছিল মরিসাসের অংশ। ওই সময় তা ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ওশ্যান টেরিটরি হিসেবে গৃহীত হয়। তারপর ১৯৬৭ সালে আমেরিকান ঘাঁটির জন্য যুক্তরাষ্ট্র তা লিজ নেয়।
ভারতসহ ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলো এর তীব্র বিরোধিতা করছিল।তারা এই অঞ্চলকে অসামরিক অঞ্চল হিসেবে বহাল রাখার দাবি জানিয়েছিল।অথচ যুক্তরাষ্ট্র ওই দ্বীপের আদিবাসীদের বেঁধে গাদাগাদি করে সিশেলস ও মরিসাসের বিচে নামিয়ে দেয়া হয়।
জাতিসঙ্ঘ ব্যাপকভিত্তিক প্রস্তাবে দিয়াগো গার্সিয়াকে এর বৈধ মালিকের হাতে ফিরিয়ে দিতে আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি সোচ্চার ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল।তারা কিন্তু এই প্রস্তাব স্রেফ নাকচ করে দেয়।
ভূতাত্ত্বিক হিসাবে দেখা যায়, এখানে রয়েছে বিশ্বের ৬২ ভাগ তেলের মজুত, ৩৫ ভাগ গ্যাস, ৪০ ভাগ র্স্বণ, ৬০ ভাগ ইউরেনিয়াম, ৮০ ভাগ হীরা। কোনো সন্দেহ আছে, রূপকথার এসব সম্পদের একচ্ছত্র মালিক কে হবে?
আমেরিকা সর্বোচ্চ যা করতে পারে তা হরো ব্যাগভর্তি হীরা পালিশ করার পর সুরাটে পাঠাতে পারে, তারপর তারা সেগুলো ম্যানহাটনের ডায়মন্ড মার্কেটে বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারে।
কোনো সন্দেহ নেই যে মালদ্বীপে সামরিক ঘাঁটি ভারতকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমেরিকা বড় সম্পদে পরিণত হবে। তারা অবশ্যই অনুমান করেছে যে একদিন নয়া দিল্লির ক্ষমতার করিডোরে সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী এলিটের আবির্ভাব ঘটবে। তারা হয়তো ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিতে ফিরে এসে উড়ে এসে জুড়ে বসাদের হটিয়ে দিতে চাইতে পারে।
ভূরাজনীতির রহস্য হলো, আপনি কখনো জানবেন না যে সময়ের গর্ভে কী লুকিয়ে আছে। স্নায়ুযুদ্ধের ঘটনার কথাও বলা যায়।
মার্গারেট থ্যাচার ও ফ্রাসোয়াঁ মিতেরাঁ ওয়ারশ প্যাক্ট ভেঙে দেয়ার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচভের বিচক্ষণতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাকে কাজটি দ্রুত করার তাগিদ দেয়।
অথচ মাত্র ৩০ বছর আগে লর্ড ইসমে ভেবেছিলেন যে ন্যাটো গঠিত হয়েছে রাশিয়াকে বাইরে রাখতে, আমেরিকাকে ভেতরে রাখতে ও জার্মানিকে লো প্রফাইলে রাখতে। অথচ ১৯৮০-এর দশকের মধ্যে ওই হিসাব ব্যাপকভাবে বদলে গিয়েছিল।
সূত্র : ইন্ডিয়ান পাঞ্চ