করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট আসা মানেই কিন্তু সুস্থতা নয়
করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট আসা মানেই কিন্তু সুস্থতা নয় - ছবি সংগৃহীত
ভদ্রলোকের বয়স বছর চল্লিশ হবে। প্যাংক্রিয়াটাইটিস থেকে সেরে উঠেছিলেন বছর দশেক আগে। তার পরে খাওয়াদাওয়ার কিছু বিধিনিষেধ ছিল। কিন্তু শারীরিক কোনো সমস্যা ছিল না। আর পাঁচটা লোকের মতোই কাজকর্ম করছিলেন। কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। দুর্বলতা ছাড়া আর কোনো শারীরিক সমস্যা অনুভব করেননি।
কোভিড নেগেটিভ হওয়ার পরে সাত দিন বাড়িতেই ছিলেন। তার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। এক দিন বাজার করে ফেরার পথে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বাড়িতে খবর গেল। ডাক্তার এলেন। দেখা গেল প্যাংক্রিয়াটাইটিস মারাত্মক আকার নিয়েছে। চিকিৎসকের বক্তব্য, কোভিড-১৯ আসল ভিলেন।
৬০ বছর বয়সী মানুষটি ডায়াবিটিসের রোগী। কোভিড-১৯ ধরা পড়ার পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অক্সিজেন দিতে হয়েছিল। সাত দিন হাসপাতালে থেকে কোভিড নেগেটিভ হওয়ার পরে তখন বাড়ি ফিরলেন তখন অত্যন্ত দুর্বল। সাত দিন চিকেন স্টু, ফলফলাদি খেয়ে শরীরে শক্তি এনে পুজোর মুখে অফিসে গেলেন। নিজের সিটে বসেই এক দুপুরে ঘামতে শুরু করলেন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। আধা অচেতন।
করোনায় সুস্থ হয়ে ওঠার পরও ফের ভর্তি হতে পারে হাসপাতালে।
সহকর্মীরা নিয়ে গেলেন নার্সিংহোমে। দেখা গেল, ডায়াবিটিসের রোগীর রক্তে চিনির পরিমাণ অত্যন্ত কমে গেছে। পারিবারিক চিকিৎসক বললেন, হাসপাতালে থেকে ফেরার পরে নিয়মিত ব্লাড সুগার মাপা উচিত ছিল। কোভিড-১৯ শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম পুরো ওলটপালট করে দিয়েছে। কোন অঙ্গে ঢুকে পড়ে তারা যে কী কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছে কে জানে!
চিকিৎসক গবেষকেরা বলছেন, কোভিড-১৯ এমন কোনো অঙ্গ নেই যার ক্ষতি না করছে। ফুসফুসতো বটেই, এমনকি লিভার, হৃদপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ককেও ছাড়ছে না করোনা ভাইরাসের এ বারের প্রজাতি। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে— অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরের এই ক্ষতিটা বোঝা যাচ্ছে করোনা নেগেটিভ হওয়ার মাসখানেক পরে। অতি সন্তর্পণে কোষের মধ্যে ঢুকে তা আত্মগোপন করে থাকে। ধীরে ধীরে কোষগুলোর ক্ষতি করতে থাকে। তাই করোনা নেগেটিভ হওয়া মানে কিন্ত পুরোপুরি রোগমুক্তি নয়।
স্ট্রেস গবেষকেরা অনেকেই বলছেন, কোভিড -১৯ থেকে মৃত্যুভয় মরার আগেই অনেক রোগীকে শেষ করে দিচ্ছে। হাওড়ার এক সরকারি হাসপাতালের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানাচ্ছেন, "পরিবারের লোকজনের থেকে বিচ্ছিন্ন অনেক রোগী সামান্য শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাওয়ার পরেই ধরে নিচ্ছেন তিনি আর সুস্থ হতে পারবেন না। এই মত্যুভয়টা যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মকে প্রভাবিত করছে। এই স্ট্রেসের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে কোনও কোনও অঙ্গের স্থায়ী ক্ষতি করে দিচ্ছে। "ঠিকমতো কাউন্সেলিং না হলে ওই রোগী পাকাপাকি ভাবে ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন। কিংবা শিকার হতে পারেন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারেও, এমনই বলছেন চিকিৎসদের কেউ কেউ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বর্তমান শারীরিক অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়ে এক গবেষক চিকিৎসক বলেন, ‘‘উনি (সৌমিত্রবাবু) কোভিড নেগেটিভ হওয়ার সাত দিন পরেও অতি সঙ্কটজনক অবস্থা থেকে যে বেরোতে পারছেন না, তার মূল কারণ ওই ভাইরাস এ ক'দিনে তার শরীরের দুর্বল যে সব কোষ রয়েছে তাদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তার মাসুল গুনতে হচ্ছে অশীতিপর অভিনেতাকে।’’ ওই চিকিৎসকের মন্তব্য, কো-মর্বিডিটি (অর্থাৎ অন্য কোনও কঠিন অসুখে ভোগা) রোগীদের নিয়ে তাদের এত চিন্তা। কো-মর্বিড রোগীদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ হলে আনুষঙ্গিক অসুস্থতা কারো কারো ক্ষেত্রে প্রথম ১৫ দিনের মধ্যেই হয়। কারও ক্ষেত্রে শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয় বেশ কিছু দিন পরে। সেটাই বিপদের কারণ।
এক কোভিড আক্রান্ত মধ্য তিরিশের যুবক ১২ দিন কোয়রান্টিনে থাকার পরে ফের পরীক্ষা করানোর পরে হাতে নেগেটিভ রিপোর্ট পেলেন। তার উপসর্গ বলতে শুধু ছিল খাবারে স্বাদ চলে যাওয়া। কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট হাতে আসার পরে পর স্বাদও ফিরল। কিন্তু দিন সাতেকের মধ্যে দেখা দিল অন্য উপসর্গ। সব সময় পেটটা জয়ঢাকের মতো ফুলে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গ্যাস। ভয়ে খাওয়াদাওয়াই প্রায় বন্ধ। খাবারে রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে গিয়েছে যুবকটির।
উৎসবে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একদিন বেরিয়েছিলেন বটে, কিন্তু নামী রেস্তোরায় স্টার্টারে মুখ দিয়ে পেটে মোচরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ওই যুবক। হলোও তাই। পেট ফুলতে শুরু করেছে তার। জানা গেল, গ্যাস্ট্রিক আলসারের শিকার ওই যুবক। তার পর থেকে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছেন তিনি। শারীরিক সমস্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে মানসিক সমস্যা। পরিবারের লোকজন চিন্তিত। অফিস বন্ধ। ফের ওয়ার্ক ফ্রম হোম।
ওই যুবকের আগে কোনো মারাত্মক শারীরিক সমস্যা ছিল। খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম হলে অ্যাসিডিটি, গ্যাস, চোঁয়া ঢেঁকুর— বাঙালির এই জিনগত সমস্যাটি তারও ছিল। কিন্তু জীবনীশক্তি ছিল খুব। সেই চনমনে ভাবটাই যেন হারিয়ে গিয়েছে জীবন থেকে। এমতাবস্থায় চিকিৎসকদের পরামর্শ, কোভিড রোগীর রিপোর্ট নেগেটিভ আসা মানেই কিন্তু সুস্থ হওয়া নয়। রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরের প্রথম এক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কো-মর্বিডিটি থাকলে রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার পরে পুরনো রোগগুলোর সব প্যারামিটার বার বার পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। কো-মর্বিডিটির চিকিৎসা যে চিকিৎসক করে এসেছেন তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। আর থাকতে হবে বিশ্রামে। শরীরের কলকব্জাগুলো ঠিক করে নিতে হবে!
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা