ইরানে কৌশলগত বিপর্যয়ে ভারত
ইরানে কৌশলগত বিপর্যয়ে ভারত - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের মোদি সরকারের অধীনে নয়াদিল্লী যে সব বড় বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, তার অন্যতম হলো ইরানের ফারজাদ-বি গ্যাস ক্ষেত্র হারানো।
ইরানে চীনের ক্রমবর্ধমান সংশ্লেষ্টতা এবং চাবাহার বন্দরের সাথে গোয়াদরকে যুক্ত করার সম্ভবনার কারণে ইরান হয়ে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে পৌঁছানোর ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা এরই মধ্যে বাতিল হয়ে গেছে।
ফারজাদ-বি ধাক্কাটাই হয়তো শেষ নয়, কারণ এই বাধাগুলোর সাথে ভারতের গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি জড়িত; কাশ্মীর উপত্যকা ও এর আশেপাশের পুরো অঞ্চলকে ভারতের সাথে যুক্ত করার আসক্তি তাদের রয়েছে, আর সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সমর্থনের কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে তাদের।
এই বিশৃঙ্খলা থেকে কিভাবে বের হওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে মোদি সরকারের কোন ধারণা নেই। এটা থেকেই বোঝা যায়, চাবাহার বন্দরের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা না থাকার পরও ভারত কেন এখন পর্যন্ত সেই প্রকল্পে অর্থ সরবরাহ করতে পারেনি। সে কারণে, ইরানের ব্যাপারে ভারতের দ্বিধা-দ্বন্দের প্রশ্ন এটি নয়। এটা হয়েছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিবর্তনশীল বাস্তবতা সম্পর্কে ভারতের ভুল হিসাবের কারণে, এবং স্বাধীনভাবে ভারতের পররাষ্ট্র নীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মোদি সরকারের অক্ষমতার কারণে।
তেহরান এটা উপলব্ধি করেছে। এই কারণেই সাম্প্রতিককালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা ইরান সফর করলেও সেই সফর ফলপ্রসূ হয়নি এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ভারতের নেতারা ইরানের নেতাদের ভারতের ‘কৌশলগত প্রয়োজন’ এবং ‘বাধাগুলো’ বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তেহরানের দিক থেকে দেখলে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের ‘গভীর সম্পর্ক’ তাদেরকে ২০১৩ সালের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ‘তেহরান ঘোষণা’ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, যে ঘোষণা বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা পক্ষপাতহীন অবস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত সৃষ্টির জন্য সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংলাপের’ প্রস্তাব দিয়েছিল, যেটা গঠনমূলক বিনিময় ও কার্যকর সহযোগিতার একটা ভিত্তি দিয়েছিল…”
তেহরান ঘোষণায় বলা হয়েছিল যে, উভয় পক্ষই রাজনৈতিক, কৌশলগত, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, এবং বাণিজ্য, শিল্প, প্রযুক্তি, জ্বালানি, পরিবহন ও কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু চাবাহার ও ফারজাদ-বি থেকে ভারতের পিছিয়ে যাওয়া প্রমাণ করে যে ২০১৩ সালের ঘোষণার ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি ছিল।
তেহরানের জন্য এর অর্থ হলো ইরান-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটা শেষ পর্যায়ে চলে গেছে। আর সে কারণেই তেহরান ভারতের বাধ্যবাধকতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার অক্ষমতাকে বিবেচনায় নিতে অস্বীকার করেছে। সে কারণে, ভারতের জন্য এই প্রকল্পের দরজা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে – এই কথাটি সরাসরি না বলে ইরানিয়ান সূত্রগুলো বলেছে যে, নয়াদিল্লী তাদের সুযোগটা হারিয়েছে, কারণ ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং এর পরিণতির আশঙ্কায়’ তারা ভীত ছিল।
ইরানি কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়ার সাথে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দাবির কোন মিল নেই। ভারতের মন্ত্রী ইরান থেকে ফিরে বলেন যে, ইরানের নেতাদের সাথে তার ‘ফলপ্রসূ বৈঠক’ হয়েছে এবং তেহরানের কাছে এই আশ্বাস চাওয়া হয়েছে যাতে ভারত গ্যাস ও বন্দর প্রকল্পগুলোতে উপস্থিত থাকে।
প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দেয়ার তেহরানের সিদ্ধান্ত থেকে পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সফর ছিল বড় ধরনের পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতা। প্রায় দুই দশকের মধ্যে ভারতের কোন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রথমবারের মতো ইরান সফরে গেলেন।
ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ভি মুরালিধরন পার্লামেন্টে যে দাবি করেছেন, সেটার সাথেও এটার কোন মিল নেই। তিনি পার্লামেন্টে বলেছেন যে, ভারত আর ইরান ইরানের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে এবং এমনকি ১.৬ বিলিয়ন ডলারের চাবাহার-জাহেদান রেলওয়ে প্রকল্পটিতে ‘সঠিক পথে’ ফিরে এসেছে।
এই বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার ফারাক অনেক। ইরান ভালোভাবেই বুঝেছে যে, ভারতের ইরান নীতি মূলত ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ছায়াতেই পরিচালিত হয়।
এই কথাটি ভেবে দেখুন: ২০০৮ সালে ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানির একটি কনসোর্টিয়াম মিলে এই গ্যাস ফিল্ডটি আবিষ্কার করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে এটাতে কাজ শুরু করে ভারত। কিন্তু ২০১২ সালে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তীব্র হলে ভারত হঠাৎ করেই কাজ বন্ধ করে দেয় । ২০১৫ সালে ইরান আর পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ঘোষণা দেয়, তখনই কেবল ভারত এই প্রকল্পের ব্যাপারে আবার আগ্রহের কথা জানায়। কিন্তু ২০১৮ সালের মে মাসে আবারও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ভারত আবারও তাদের প্রকল্পের বিষয়ে ঢিল দেয়। ফলে ২০২০ সালে এসে ইরানকে শেষ পর্যন্ত প্রকল্প থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এমন সময় এটা ঘটছে যখন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চীন ইরানে বহু বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছে এবং আরও করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক চাপ সত্বেও ইরানের উপর জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ইউরোপ (যে নিষেধাজ্ঞা ২০২০ সালের অক্টোবরে শেষ হয়েছে)।
অন্যভাবে বললে আন্তর্জাতিক পরিবেশ যখন বদলাতে শুরু করেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে ইরান, এ অবস্থাতেও ভারত এখনও তাদের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকে চেয়ে আছে, এবং লাদাখে নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য চীনকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র পাশে রাখতেই জেনেবুঝে তারা ইরানের সাথে সম্পর্ককে শেষ করে দিচ্ছে।
মোদি সরকারের জন্য তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের বিষয়টি হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভোট ব্যাংকের সাথে জড়িত, এবং ইরানের সাথে ‘ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্কের’ চেয়ে সেটাকে তারা গুরুত্ব দেয় বেশি।
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের প্রয়োজন, সে কারণে ইচ্ছা করেই ভারত সেই সব দেশে সক্রিয় হচ্ছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ। এমনকি ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে যখন ফারজাদ-বি থেকে বাদ দেয়া হলো, তখনও তারা মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরাইলের সঙ্গে একই ধরনের প্রকল্পে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানিগুলো যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখছে, সেখানে ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির গতি প্রকৃতিটাও অনেকটাই স্বচ্ছ হয়ে যায়।
কিছু প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ‘ওএনজিসি বিদেশ’ ভারতীয় সরকারী কোম্পানিগুলোর কনসোর্টিয়ামের অংশ হিসেবে ২৫ শতাংশ কর্তৃত্বের শর্তে ইসরাইলে অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছে।
সূত্র : এসএএম