নেপাল নিয়ে মোদির নতুন হিসাব!
নেপাল নিয়ে মোদির নতুন হিসাব! - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান সামন্ত গোয়েলের ঝড়ো কাঠমান্ডু সফর সম্পন্ন হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। কিন্তু এর রেশ এখনো রয়ে গেছে।
পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক নেতারা প্রশ্ন করছেন, নয়া দিল্লি কি রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পাশে সরিয়ে তার নেপাল নীতি নির্ধারণ করার দায়িত্ব তার গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছে?
ভারতে নিযুক্ত সাবেক নেপালি রাষ্ট্রদূত লোকরাজ বরাল বলেন, কোনো দেশ তার রাষ্ট্রযন্ত্রকে কিভাবে ব্যবহার করবে, তা ওই দেশের নিজস্ব ব্যাপার।
তিনি বলেন, তবে কোন রাষ্ট্রয্ন্ত্রটি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কখন ও কোথায়- তা বিবেচ্য বিষয়। প্রশ্ন হলো ভারত সরকার কেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা সচিবকে দৌত্যকর্মে পাঠাল না?
নেপাল-ভারত সম্পর্ক নিয়ে গ্রন্থ রচনাকারী এই কূটনীতিক বলেন, গোয়েলকে বিশেষ ফ্লাইটে পাঠানোর কী এমন জরুরি তাগিদ ছিল?
নেপালি প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা নিয়ে নেপাল যান গোয়েল। গত বছরের নভেম্বরে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ সৃষ্টির পর থেকে গোয়েলই নেপাল সফরকারী ভারতের সবচেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তা।
সাধারণভাবে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়গুলো সামাল দেয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিদেশী দেশের সাথে আলোচনার জন্য কূটনীতিবিদেরাই দূতের দায়িত্ব পালন করেন।
কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে দূত হিসেবে পাঠানো হলো।
উপপ্রধানমন্ত্রী ঈশ্বর পোখরেল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গাইয়ালি, লুম্বানি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শঙ্কর পোখরেল, তিনি ওলির অত্যন্ত আস্থাভাজন, সামাজিক মিডিয়ায় লিখেছেন যে গোয়েল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির ‘দূত’ হিসেবে এসেছিলেন।
আন্তর্জাতিক কূটনীতির রীতি হচ্ছে, কোনো দেশ যদি অন্য কোনো দেশে ‘দূত’ পাঠায়, তবে কথাটি আগেই ঘোষণা করে। কিন্তু গোয়েল এ ধরনের কোনো ঘোষণা দিয়ে আসেননি।
প্রধানমন্ত্রী ওলির পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা রাজন ভট্টরাই বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যদি নেপালি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো বার্তা দিতে গোয়েলকে পাঠানোর প্রস্তাব করেন, তবে নেপাল তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না।
তবে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির কোনো সিদ্ধান্ত নেপালকে জানিয়েছে কিনা তা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান ভট্টরাই।
ভট্টরাই পোস্টকে বলেন, গোয়েন্দাপ্রধানের নেপাল সফরের কারণেই ভারত তার নেপাল নীতি র-এর কাছে হস্তান্তর করেছে, এমনটি আমি মনে করি না। তিনি আমাদের সরকারকে আগে জানিয়েই এসেছেন, অনুমতি নিয়েই বিশেষ বিমান ব্যবহার করেছেন। তাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। বৈঠকের সব রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
নেপাল-ভারত ফ্লাইট বন্ধ থাকায় গোয়েল ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমানে করে কাঠমান্ডু অবতরণ করেন। সূত্র জানায়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ভারত প্রথমে অনুরোধ করেছিল নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তারা তারা বিষয়টি স্থানান্তর করে নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে।
অবশ্য ওলি ও গোয়েলের মধ্যকার বৈঠকের কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানত না।
ওলির সাথে গোয়েল বৈঠক করেন দুই ঘণ্টা। এই বৈঠকটিকে ওলির ক্ষমতাসীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টিই কূটনৈতিক রীতি-বহির্ভূত হিসেবে অভিহিত করেছে। বৈঠকে ভারতীয় পক্ষে ছিলেন তিনজন। আর ওলি ছিলেন একা। নেপাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও কেউ ছিলেন না ওলির সাথে।
ওলি ও গোয়েলের মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে সে ব্যাপারে উভয় পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে নীরবতা পালন করছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরের সূত্র জানিয়েছে, ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ, সীমান্ত ইস্যুতে তাদের অবস্থান, অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ও অন্যান্য নিয়মিত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ওলির কাছে দেয়া বার্তায় মোদি উল্লেখ করেছেন, ভারত সংলাপের মাধ্যমে সীমান্ত বিরোধ ও অন্যান্য সমস্যার নিষ্পত্তি করতে চায়।
আর ওলি বলেন গোয়েলকে যে কাঠমান্ডু চায় সমঝোতার মাধ্যমে সীমান্তসহ সব সমস্যার সমাধান করতে।
গোয়েলের সম্মানে ওলি ডিনারের আয়োজন করেন। তিনি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিষয়াদি, কৌশলগত স্বার্থ ও মোদির সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পার ভারত সফর করে গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি সই করার কয়েক দিন আগে গোয়েলের এই সফরটি অনুষ্ঠিত হয়।
গোয়েলের সফর দিয়ে ভারতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নেপাল সফর শুরু হলো বলা যায়। আগামী সপ্তাহেই ভারতের সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দ নারাভানের নেপাল সফরের কথঅ রয়েছে। কাঠমান্ডুতে তার তিন দিনের অবস্থানের সময় নারাভানেকে নেপালি সেনাবাহিনীর সম্মানসূচক জেনারেল পদবিতে ভূষিত করা হবে। দুই দেশের সেনাবাহিনী ঐতিহ্যগতভাবেই এই পদবি বিনিময় করে থাকে।
সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের মধ্যেই আরো দুই থেকে তিনটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক বিবেচনাধীন রয়েছে।
২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর মোদি একই বছরের আগস্টে কাঠমান্ড এসেছিলেন। এটা ছিল ১৭ বছর পর কোনো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেপাল আগমন। তারপর একই বছর কাঠমান্ডু যান সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। তারপর ২০১৮ সালে আবার নেপাল সফর করেন।
তবে গত নভেম্বরে সীমান্ত বিরোধ সৃষ্টির পর থেকে নেপাল ও ভারতের মধ্যকার রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সফর বিনিময় স্থগিত রয়েছে।
এত দিন মনে করা হতো, নেপাল-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি সামাল দিয়ে থাকেন কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদেরা। কিন্তু গত সপ্তাহে গোয়েলের সফরের ফলে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে যে নেপালি বিষয়াদিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের নেপালের রাজনৈতিক পালাবদলের সময়ও নেপালের রাজনীতিকে র-কে সক্রিয় দেখা গিয়েছিল।
সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারায়ন কাজি শ্রেষ্ঠার মতে, মনে হচ্ছে নেপাল-ভারত ইস্যুগুলো সামাল দিতে উভয় পক্ষই র-কে চাচ্ছে।
তিনি বলেন, মনে হচ্ছে, ভারত দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব র-এর হাতে দিয়েছে। তাদেরকে স্বাগতও জানানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, অবশ্য, এই সফরের কথা আগে জানা ছিল না, দলের মধ্যেও এ নিয়ে আলোচনা হয়নি। এমনকি কো-চেয়ার পুস্প কমল দহলও এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না।
সূত্র : কাঠমান্ডু পোস্ট