যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে বাধা রাশিয়া!
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে বাধা রাশিয়া! - ছবি : সংগৃহীত
মার্কিন বিশেষজ্ঞ রবার্ট ক্যাপলান ২০০৯ সালে ভারত মহাসাগরকে ২১ শতকের কেন্দ্রীয় মঞ্চ হিসেবে অভিহিত করে বিশ্ব রাজনীতিতে এই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান তাৎপর্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এশিয়া-প্যাসিফিক কৌশলের ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যাসিফিক ও ভারত মহাসাগরকে একত্রিত করে ইন্দো-প্যাসিফিক করার সিদ্ধান্ত নেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই অঞ্চল এখন প্রধান দেশগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।এই প্রতিযোগিতা কিভাবে প্রকাশিত হবে তা এই অঞ্চল ও এর বাইরের এলাকার স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নির্ধারণ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ২+২ মন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপের সন্ধিক্ষণে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাইগান বলেন, আমরা একটি সহজাত ও গভীরতর অংশীদারিত্বের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেখেছি, এটা যুদ্ধপরবর্তী মডেলের জোট নয়, বরং অভিন্ন নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য, অভিন্ন স্বার্থ, অভিন্ন মূল্যবোধ নিয়ে মৌলিক জোট। বাইগানের কথায়, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই এসব কাজের কিছু কিছু শুরু করে দিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সামরিক বিক্রি ও ভারতের সাথে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়। তবে আমরা আরো কিছু করতে পারি। এসবের মধ্যে রয়েছে, ভারতকে তার আত্মরক্ষার শক্তি বাড়াতে সহায়তা করা এবং নিয়মিত মহড়া ও বিনিময়, অভিন্ন প্রতিরক্ষা প্লাটফর্ম ও সহ-উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের সামরিক বাহিনীগুলোর মধ্যে আন্তঃনির্ভরতা গড়ে তোলা।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যকার ২+২ সংলাপ আয়োজন করার চাপ দেয়ার মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসন কোন লক্ষ্য হাসিল করতে চায়? ওয়াশিংটন ডিসি থেকে যে বার্তা পাওয়া যাচ্ছে তা হলো এই যে এই সভার লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের উপলব্ধির আলোকে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদার করা। বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় দুটি লক্ষ্য হাসিলের কথা বলা হয়েছে। প্রথমটি হলো কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে ভারতকে মিত্রতে পরিণত করা। বাইগানের বিবৃতি এবং যুক্তরাষ্ট্র-ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে অনেক গুঞ্জন থাকলেও তাদের জোট নিয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি।
কোনো কোনো মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এই অংশীদারিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য আঞ্চলিক মিত্রদের সাথে সহযোগিতার মাত্রায় পৌঁছাবে না। অধিকন্তু, যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ও অংশীদারদের সাথে অপারেশনগত মিত্রতা জোরদারের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ভারতের উদ্দেশ্যের সাথে মেলে না। কারণ ভারত তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন সংরক্ষণ করতে চায়। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো কোয়াডের বিকাশ। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে এই অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা গ্রুপিং গঠিত। যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত এতে আরো ঘনিষ্ঠভাবে যোগ দিক।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব ও কোয়াড হলো চীনকে টার্গেট করে করা প্রধান হাতিয়ার। চীনের বিরুদ্ধে এই অংশীদরিত্ব আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র।যুক্তরাষ্ট্র এর মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের তৎপরতা সীমিত করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাধার সৃষ্টি করতে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় কৌশলগত লক্ষ্য হলো রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা। রাশিয়ার জন্য ভারত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ২০ বছর আগে ভারত সফরের সময় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারতের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্বের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৮ সালে রাশিয়া-ভারত বাণিজ্য ১১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০১৯ সালে উভয় দেশ ১৪.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তিতে সই করেছে। এর মাধ্যমে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত সামিরক সরঞ্জাম কিনবে। এর মধ্যে রয়েছে রুশ বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এস-৪০০, রণতরী, গোলাবারুদ। কুদানকুলামে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ আরো কিছু প্রকল্পও আছে।
অর্থাৎ রাশিয়ার সাথে দীর্ঘ মেয়াদি সহযোগিতার মাধ্যমে ভারত লাভবান হচ্ছে এবং মার্কিন চাপের মুখে তা বাতিল হওয়ার নয়। আর ভারতকে আরো কাছে টানার জন্য নয়া দিল্লিকে ব্রিকস, এসসিও-এর মতো আন্তর্জাতিক সব ফোরাম থেকে সরিয়ে এনে কোয়াডে সামিল করার চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। মনে হচ্ছে না, রুশ-ভারত সম্পর্ক সঙ্কটে পড়ে, এমন পর্যায়ে চলে যাবে ভারত। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার দিকেই যাবে ভারত।
একইসময় সব পক্ষের বোঝা উচিত, বর্তমান মার্কিন কৌশল খুব সম্ভবত হিতে বিপরীত হবে এবং এই অঞ্চলে উত্তেজনার সৃষ্টি করবে।বরং সঙ্কট ব্যবস্থাপনা, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও পারস্পরিক পরিপূরক সহযোগিতার দিকে নজর দেয়াই কল্যাণকর।
লেখক : ভাইস-রেক্টর অব রিসার্চ, মস্কোভিত্তিক ডিপ্লোমেটিক অ্যাকাডেমি।
সূত্র : গ্লোবাল টাইমস