তাদের বেপরোয়া জীবন
ইরফান সেলিম - ছবি : সংগৃহীত
কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধির কারণে এমপি থেকে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পর্যন্ত গোটা দেশের জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ গম চুরি, চাল চুরি, চাঁদাবাজি, জমি ও বাড়ি দখল, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে লোকজনকে মারধর করাসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছেন। আবার কেউ কেউ চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের সাথে অনৈতিক কাজ করছেন। কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধির বিতর্কিত এসব কর্মকাণ্ডের কারণে ভালো ও সুনামধারী জনপ্রতিনিধিদের ভাবমর্যাদাও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
গত রোববার রাতে নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে মারধরের ঘটনায় পরদিন সোমবার গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ এরফান সেলিম ও তার এক বডিগার্ড। এরফান সেলিমের পিতা হাজী মোহাম্মদ সেলিম ঢাকা-৭ আসনের এমপি ও অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দিনভর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা হাজী সেলিমের চকবাজার দেবীদাস ঘাট লেনের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে দেশী ও বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র, মদ-বিয়ার এবং হ্যান্ডকাফ ও অনুমোদনহীন ওয়াকিটকি উদ্ধার করেন। এ ঘটনা এখন দেশের মানুষের মুখে মুখে।
কাউন্সিলর এরফানের শ্বশুর একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি আর শাশুড়ি কামরুন নাহার শিউলি কবিরহাট উপজেলার চেয়ারম্যান। ২০১৮ সালের ১৯ জুন রাজধানীর মহাখালীতে পথচারী সেলিমকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেন এমপিপুত্র সাবাব চৌধুরী। তিনি ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ন্যাম ভবনে চলে যান। ঘটনাস্থল থেকে তার গাড়ির পিছু নেয়া আরেক ব্যক্তিকে ভবনে প্রবেশ করতে দেখলে সাবাব চৌধুরী তাকে মারধর করেন এবং তার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে বের করে দেন। ওই ঘটনাও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর আগে ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে কালো রঙের প্রাডো গাড়ি থেকে তখনকার এমপি ও মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার রনি এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে রিকশাচালক ইয়াকুব আলী ও আবদুল হাকিমকে মেরে ফেলেন। জোড়া খুনের ঘটনাটি দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। সম্প্রতি ময়মনমিসংহ-৩ আসনের এমপি নাজিম উদ্দিনের ৭ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের একটি অনৈতিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তিনি এক মেয়ের সাথে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুরে এক নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগ গ্রেফতার হয়েছেন।
শুধু চড়-থাপ্পড় মারা, দাঁত ভেঙে দেয়া বা মেয়েদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ঘটনা ঘটছে এমন নয়, জনপ্রতিনিধিদের গম চুরি, চাল চুরি, টিআর, কাবিখার টাকা মেরে খাওয়া তো লেগেই আছে। করোনা মহামারীর মধ্যেও গম, চালসহ গরিবের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী লুটপাটের অভিযোগে অন্তত দেড় শতাধিক পৌরসভা মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বর এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বরখাস্ত হয়েছেন। কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছেন। এ ছাড়াও জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ অবৈধ পন্থায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন, নামে বেনামে সম্পত্তি কিনছেন। তা ছাড়া বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ডের মতো বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা অহরহ।
জনপ্রতিনিধিদের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, শুধু হাজী সেলিমের ছেলে এরফান সেলিম এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত তা নয়, এর আগে পিনু খানের ছেলে দুই রিকশাওয়ালাকে গুলি করে মেরে ফেলে, একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে এক পথচারীকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। এ রকম ঘটনা আরো আছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বিচার না হওয়ায় গডফাদাররা পার পেয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যদি প্রভাবশালীদের মধ্যে কেউ ঘটনার শিকার হয় তখন তোলপাড় হয়, বিচারও হয়। সাধারণ মানুষ ঘটনার শিকার হলে তো এসব ঘটনার বিচার হতো না, ধামাচাপা পড়ে যেত। ভুক্তভোগীদের আগ্রহ থাকলেও অনেক ঘটনার বিচার সামনের দিকে এগোতে পারে না। তা ছাড়া সিস্টেমই বড় সমস্যা। রাজনৈতিকভাবে পুরো সিস্টেমই পরিবর্তন করা দরকার। সিস্টেম পরিবর্তন না হলে এ ধরনের ঘটনা শেষ হবে না, বরং চলতে থাকবে। ড. মজুমদার আরো বলেন, এগুলোর সমাধান আওয়ামী লীগ একা করতে পারবে না, বর্তমানে দেশ যে অবস্থায় চলে গেছে তাতে আওয়ামী লীগ একা কিছুই করতে পারবে না। সেই অবস্থা আর নেই। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগুলো সমাধান করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে গণতন্ত্রহীনতা ও দুর্নীতির ফলে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে একধরনের ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব চলে এসেছে। যাদের কাছে অবৈধ টাকা আছে, অবৈধ অস্ত্র আছে তাদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। তারা দেখছে, রাস্তাঘাটে আইন ভঙ্গ করলেও কোনো শাস্তি হচ্ছে না। এর থেকে তাদের বড় ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা গড়ে উঠছে। তারা অহরহ আইন ভাঙছে; কিন্তু কোনো বিচার হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকার সমর্থক জনপ্রতিনিধিরা দেখছেন, ভোট করতে তো জনগণ লাগে না। টাকা হলেই হয়। ফলে রাস্তাঘাটে সাধারণ জনগণকে তারা কেয়ার করে না। এখন নৌবাহিনী কর্মকর্তার দুইটা দাঁত ভেঙেছে, এরাই সামনে আরো চারটা ভাঙবে, এরপর অন্য কেউ। রাজধানীতে বডিগার্ড ও বাহিনী নিয়ে চলে এ রকম অনেক প্রভাবশালী আছে। সরকার যদি আন্তরিক হয়, তাহলে এদের ধরে আইনের আওতায় আনলে, বিচার করলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।