‘মনুস্মৃতি’ নিষিদ্ধ করার দাবি ভারতে : তোলপাড়
‘মনুস্মৃতি’ নিষিদ্ধ করার দাবি ভারতে - ছবি : সংগৃহীত
সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রাচীন শাস্ত্র মনুস্মৃতি নিষিদ্ধ করার দাবিকে ঘিরে ভারতের রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
‘মনুস্মৃতিতে সব হিন্দু নারীকে বেশ্যা বলা হয়েছে’, তামিল রাজনীতিবিদ থল থিরুমাভালাভানের করা এমন একটি মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ার পর তামিলনাডুতে মনুস্মৃতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। আর এদিকে থিরুমাভালাভানের বিরুদ্ধে পাল্টা বিক্ষোভ জানাতে গিয়ে আবার পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন বিজেপি নেত্রী ও অভিনেত্রী খুশবু সুন্দর।
মনুস্মৃতিকে অনেকেই ভারতের হিন্দু সমাজে জাতপাতের প্রথা এবং পুরুষতান্ত্রিকতার দলিল হিসেবে দেখেন - আর নারীবাদী ও দলিত সংগঠনগুলোও এই বইটি পুড়িয়ে তাদের প্রতিবাদ জানান। বস্তুত ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে মনুস্মৃতিকে নিয়ে বিতর্ক নতুন নয় - আর এই মুহূর্তে সেটারই বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডুতে।
ওই রাজ্যের দলিত সংগঠন ভিদুথালাই চিরুথাইগাল কাচ্চি বা ভিসিকে মনুস্মৃতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে রাজ্যজুড়ে তীব্র আন্দোলন চালাচ্ছে।
ভিসিকের নেতা ও কুড্ডালোরের এমপি থল থিরুমাভালাভান এর আগে বলেছেন, ‘মনুস্মৃতি সব হিন্দু নারীর জন্যই অবমাননাকর - কারণ সেখানে তাদের সবাইকে পতিতা বা বেশ্যার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে।’
এই মন্তব্যের জন্য ভিসিকের নেতাকে ক্ষমা চাইতে হবে, সেই দাবিতে আবার পাল্টা আন্দোলন শুরু করেছে বিজেপি।
সেই আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে গ্রেফতারও হয়েছেন সদ্য দলে যোগ দেয়া মহিলা নেত্রী ও সাবেক ফিল্ম তারকা খুশবু সুন্দর। আর এর সূত্র ধরেই আবারো বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে হিন্দুধর্মের প্রাচীন এই আইনগ্রন্থটি।
সাম্প্রতিক অতীতে দিল্লির জেএনইউতেও ছাত্রছাত্রীরা মনুস্মৃতি পুড়িয়ে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘এই বইটিতে নারীদের যে রকম নিচু নজরে দেখা হয়েছে, তা কিছুতেই একটি আধুনিক প্রগতিশীল দেশে মানা সম্ভব নয়।’
ভারতে মনুস্মৃতির সবচেয়ে বড় সমর্থক বলে মনে করা হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসকে, যারা ক্ষমতাসীন বিজেপির আদর্শগত অভিভাবক বলে পরিচিত। দিল্লির ঝান্ডেওয়ালাতে আরএসএস দফতরের সামনেও প্রায়ই মনুস্মৃতি পোড়াতে আসেন নারীবাদীরা। তারা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভারতীয় সংবিধানের রূপকার বাবাসাহেব আম্বেডকরও সেই ১৯২৭ সালে মনুস্মৃতি পুড়িয়েছিলেন।
‘স্বাধীনতার পর হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্যে আরএসএসও দেশের সংবিধানের বদলে মনুস্মৃতিতেই আস্থা দেখিয়েছিল’, বলছেন এমনই একজন নারীবাদী নেত্রী নীলম কবীর।
এই পটভূমিতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও দার্শনিক নির্মলাংশু মুখার্জির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মনুস্মৃতিকে নিয়ে মূল সমস্যাটা ঠিক কোথায়? তিনি বলছিলেন,‘মনুস্মৃতি আসলে খুব অবমাননাকর একটি ডকুমেন্ট। ভারতে জাতপাত বা বর্ণভেদের লিখিত, আনুষ্ঠানিক বা প্রামাণ্য দলিল যদি কিছু থেকে থাকে - তাহলে সেটা হলো এই মনুস্মৃতি।’
‘জাতপাতের প্রথাটা আগে এদেশে অস্পষ্ট ছিল। মনুস্মৃতিতেই প্রথম এটা প্রতিষ্ঠা করা হয় যে সমাজে কারা কোন জাতে থাকবে, সামাজিক অধিষ্ঠানটা কার কেমন হবে। আর এর মধ্যে নারীদের জায়গাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল - যে তারা বিয়ের আগে পিতার ও বিয়ের পর স্বামীর অধীন থাকবে, তাদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম থাকবে না।’
ভারতে বর্ণভেদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া এই মনুস্মৃতি কিন্তু মহাভারত বা বেদ-বেদান্তের মতো আদৌ অত পুরনো নয়।
আজকের ভারতে মনুস্মৃতির বক্তব্য দেশের সংবিধানবিরোধী বলেও হিন্দু ধর্মীয় নেতারা অবশ্য ব্রাহ্মণ্যবাদের হয়ে সাফাই গাইতে গিয়ে এই গ্রন্থটিকেই ব্যবহার করেন, বলছিলেন অধ্যাপক মুখার্জি।
‘যে ধর্মীয় অনুশাসনগুলোকে সমাজে মেনে চলা হয়, তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিটা এই মনুস্মৃতিতে আছে। কাজেই ব্রাক্ষণ্যবাদের সমর্থনে যুক্তি খুঁজতে গিয়ে এই মনুস্মৃতির দিকেই হাত বাড়াতে হয়। তবে আজ তো আর এটা ফর্মালি কোথাও পড়ানো হয় না, এটা দেশের সংবিধানের পরিপন্থীও বটে। কাজেই এটা নিষিদ্ধ করার দাবিটা কিছুটা অর্থহীন বলেই মনে করি। তবে এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের একটা অনানুষ্ঠানিক, কিন্তু স্বীকৃত ডক্ট্রিন হিসেবে রয়ে গেছে। ধরুন কাঞ্চীপুরম মঠের প্রধান মোহন্ত, তিনিও সেখান থেকেই উদ্ধৃত করবেন। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে গেলে মনুস্মৃতিকেই আক্রমণ করতে হবে, আম্বেডকরও ঠিক সেটাই করেছিলেন।’
‘সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মনুস্মৃতি আজও ভারতে বিরাট একটা সমস্যা। ঠিক যেভাবে জার্মানিতে নাৎসি ডক্ট্রিন একটা বিরাট সমস্যা, যদিও সেটা ওদেশে এখন আর কোনো সরকারি ডকুমেন্ট নয়,’ বলছিলেন নির্মলাংশু মুখার্জি।
বহুজন সমাজ পার্টির মতো দলিত রাজনৈতিক দলও অন্য দলগুলোকে মনুস্মৃতির সমর্থক হিসেবে অভিযোগ করে বারবার 'মনুবাদী' বলে আক্রমণ করে এসেছে। উত্তর ভারতের সেই রাজনীতির রেশ এখন নতুন করে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণের তামিলনাডুতেও।
সূত্র : বিবিসি