পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার নেপথ্যে
পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার নেপথ্যে - ছবি সংগৃহীত
পাকিস্তানে হঠাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল নওয়াজ মুসলিম লীগ ও বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পিপিপি এক হয়ে মওলানা ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে ১৩ দল সমন্বয়ে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট-পিডিএম নামে মহাজোট গঠন করেছে। ইমরান খানের পিটিআই এবং তাদেরকে যারা ক্ষমতায় এনেছে তাদের উৎখাতের ডাক দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। ২০২১ সালের শুরুতে ইসলামাবাদ অভিমুখী লংমার্চ করে ইমরান সরকারের পতন ঘটাতে চাচ্ছে এ জোট। চলমান সরকার ক্ষমতায় আসার দুই বছরের মাথায় এ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে।
পিডিএম’র আন্দোলন ও ইমরান খান
ইমরানের পিটিআই সরকারের বিরুদ্ধে একীভূত প্রচেষ্টা হিসেবে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে পিডিএম। সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত পিডিএম-এর যাত্রা শুরু হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর। পরিকল্পনা অনুসারে জোটটি দেশব্যাপী সমাবেশ অনুষ্ঠানের পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে একটি ‘লংমার্চ’ করবে। ২০২১ সালের সিনেট নির্বাচনের আগে মার্চ মাসে কর্মপরিকল্পনা শেষ হবে। তারা ঘোষণা করে যে, লক্ষ্য অর্জনে তারা সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আনাসহ সব উপকরণ ব্যবহার করবে।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে আগের মত নমনীয় থাকছেন না। গত শুক্রবার তিনি বলেছেন, বিরোধী নেতাদের সাথে বৈঠক করা ‘বড় ভুল’ ছিল, এই বৈঠক থেকে কী লাভ হয়েছে তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। কারণ তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন ভাষা ব্যবহার করছে যা শত্রুরাও ব্যবহার করে না। গত ১৬ অক্টোবর এক সমাবেশে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তার অপসারণ এবং পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ভূমিকা পালন করেছিল। নওয়াজের মূল লড়াই তাদের বিরুদ্ধে। ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে পিএমএল-এন এবং পিপিপিকে জোট করলেও উভয়পক্ষই অন্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবসময় সতর্ক থাকে। ২০১৯ সালের মে মাসে উভয়পক্ষ দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার অঙ্গীকার করেছিল। তারা প্রতিবাদ শুরু করে এবং সিনেটে পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান সাদিক সানজরানিকে অপসারণের চেষ্টা করে। পিটিআই-নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে বিরোধীদের নেয়া প্রথম পদক্ষেপ ছিল এটি। তাদের সম্মিলিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও, দুটি বিরোধী দল সিনেট চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে পারেনি।
একইভাবে, ২০১৯ অক্টোবরে, পিপিপি এবং পিএমএল-এন, জেআইআই-এফের সাথে মিলে পিটিআই সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। যদিও পিপিপি এবং পিএমএল-এন জেআইআই-এফের নেতৃত্বাধীন প্রাথমিক আজাদি পদযাত্রায় যোগ দিয়েছে, তারা মাওলানা ফজলুর রেহমান এবং তার কর্মীদের একা রেখে চূড়ান্ত বৈঠকের সমর্থন করেনি।
পিএমএল-এন নেতারা জারদারির বিরুদ্ধে সতর্ক রয়েছেন, একই অবস্থা তার বিপরীত পক্ষের। পিপিপির প্রবীণ নেতা চৌধুরী আতাজাজ আহসান জোট সম্পর্কে তার দলকে সতর্ক করেছেন। অন্য দিকে পিডিএম-এর যাত্রা শুরুর পরে, পিএমএল-এন শীর্ষ নেতা খাজা আসিফ বলেছিলেন যে, জারদারির ওপর বিশ্বাস রাখা তার পক্ষে ‘কঠিন’ ছিল।
অদূরভবিষ্যতে সরকারকে নামিয়ে আনতে বা রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা দুর্বল করার ক্ষেত্রে কার্যকর কিছু পিডিএম করতে পারবে এমনটি মনে হয় না। পর্যবেক্ষকদের মতে, ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিরোধী দলের এই প্রয়াস আবারও নিষ্ফল হবে।
পিটিআই সরকার সেনাবাহিনীর ‘বদনাম’ করার জন্যই শুধু শরিফের সমালোচনা করেছে তা নয় বরং শরিফ দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
অন্তর্ঘাত ও চীনা টার্গেট
রাজনৈতিক ফ্রন্টের পাশাপাশি পাকিস্তানের অখ-তায় আঘাত হানার নানা ঘটনাও ঘটছে। অতি সম্প্রতি খনিজসম্পদ-সমৃদ্ধ বেলুচিস্তান প্রদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ১৪ সদস্যকে হত্যার মাধ্যমে চীনা স্থাপনা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে টার্গেট করা হয়। এ ঘটনায় বেলুচ বিদ্রোহে নতুন মাত্রা যোগ হয়। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) নিরাপত্তা মূল্য বেড়ে যাওয়ায় চীন উদ্বিগ্ন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৫ হাজার সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ নিরাপত্তা ডিভিশন সিপিইসি প্রকল্পগুলোতে কর্মরত চীনা নাগরিকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। এ ছাড়াও চীনা কর্মকর্তারা নিজস্ব ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ করছেন।
বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের (বিএলএফ) ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ৬৭টি হামলা চালিয়ে ১৩১ জনের বেশি সৈন্যকে হত্যা ও শতাধিককে আহত করেছে। এসব অভিযানে একটি সাজোয়াঁ যান, ১০টি সামরিক যান, তিনটি মোবাইল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিরপেক্ষ সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্ট (এসিএলইডি) দাবি করেছে, বেলুচিস্তানে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সঙ্ঘবদ্ধ হামলায় মারা গেছে ৯৫ জন। এসিএলইডি জানায়, ২০২০ সালের প্রথম সাত মাসে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর সহিংস তৎপরতা বেড়েছে।
বেলুচিস্তানে চীনা ও সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির প্রতি বৈরী সশস্ত্র জাতীয়তাবাদীরা ২০১৮ সালের নভেম্বরে বালুচ রাজি আজোহি সাঙ্গার (বালুচ ন্যাশনাল ফ্রিডম মুভমেন্ট) গঠন করলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। বেলুচ জাতীয়তাবাদী-বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ বেলুচিস্তান রিপাবলিকান আর্মি (বিআরএ), বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) ও বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) তাদের অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে জোট গঠন করেছে। বিআরএএস বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা চায়। তারা চীন ও পাকিস্তানসহ বাইরের শক্তির সেখানে উপস্থিতির বিরোধিতা করছে। তারা এখান থেকে সম্পদ আহরণেরও বিরোধিতা করছে। এসব ঘটনা ঘটছে মূলত জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পর।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
পাকিস্তানের দুই বৃহৎ বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে এমন একসময় সরকার পতনের ডাক দিচ্ছে যখন দেশটি করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে একটি স্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছেছে। যদিও সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গের ঝুঁকি এখনো আছে। ইমরান খান যখন সরকার গঠন করেন তখন পাকিস্তান এক ক্রমিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ছিল। আর সে অবস্থার মধ্য থেকে উত্তরণের জন্য ইমরান মিত্র দেশগুলোর কাছে ধরনা দিয়ে আশা অনুযায়ী ফল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত অপছন্দের আইএমএফ-এরও শরণাপন্ন হন। আইএমএফের কর্মসূচি বাস্তবায়ন ইমরান খান সরকারের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। কারণ তাতে কর যৌক্তিককরণ, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কথা রয়েছে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন না করলে আইএমএফ তাদের পরবর্তী অর্থ ছাড় দেবে না। অর্থনীতি যখন হিমশিম অবস্থায় তখন মূল্যবৃদ্ধি করা হলে আন্দোলনরত বিরোধীরা রাজপথে আগুন উসকে দেয়ার সুযোগ পাবে। সরকার নিশ্চিতভাবেই তা হতে দিতে চায় না।
ইমরান গত দুই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পারেননি। তবে অবনতিশীল পরিস্থিতি ঠেকিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণে অধিকাংশ দেশের অর্থনীতিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়। পাকিস্তানেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। পাকিস্তানি মুদ্রার মান কমে যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়ে। বেসরকারী খাতে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে যায়। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক জনশক্তি দেশে ফিরে আসে। আমদানি রফতানি এবং অর্থনীতির সার্বিক চাহিদার ওপর করোনার প্রভাব হয় স্পষ্ট। সার্বিকভাবে জনগণের আয়ের ওপর নেচিবাচক প্রভাব পড়ে। এক ধরনের অস্থির অবস্থা দেখা দেয় সামাজিকভাবে। স্বাভাবিকভাবে এটি সরকারের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে ক্ষোভও সৃষ্টি করে। দীর্ঘকাল ধরে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতাসীন দুই প্রধান বিরোধী দল এই সুযোগটিই নিতে চাইছে। তবে শুধু এই পরিস্থিতিই যে পাকিস্তানের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণ তা মনে হয় না।
পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে গত প্রায় ৫ দশক সময়কালের মধ্যে সবচেয়ে গভীর সঙ্কটসময় এখন পার করছে এখন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক সুরক্ষা বাতিল করার পর ভারতীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা পাকিস্তান ও চীন নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখলের ঘোষণা দেন। ভারতীয় লোকসভায় এ ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি ও সমরসজ্জার ভারতীয় পদক্ষেপে মনে হতে থাকে করোনা সংক্রমণ বা অর্থনৈতিক সঙ্কট দূরীকরণে মোদি সরকারের ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানো এর একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এর আগে পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করা এবং পাকিস্তান ও চীন সীমান্তের ভারতীয় অংশে অবকাঠামো উন্নয়নে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি প্রস্তুতি শুরু করা হয়। এতে স্পষ্ট হয় দিল্লির সামরিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এর মধ্যে বিজেপির একজন নেতার বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস বলেছে, চীন-পাকিস্তানের সাথে সামরিক সংঘাতের বিষয়ে মোদি দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছেন।
নিরাপত্তা হুমকি
ভারতের কাশ্মীর গিলগিট বাল্টিস্থান আর আকসাই চীন দখলের হুমকি এবং এ জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ পাকিস্তান ও চীন দু’দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এমন যে পাক-চীন নিরাপত্তা পরস্পরের সাথে বেশ খানিকটা সম্পর্কিত। আর স্নায়ুযুদ্ধকালে দুই পরাশক্তির যে বলয় বিভাজন ছিল তাতেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ব ও নিরাপত্তার মাতব্বরী ইসরাইলের হাতে সমর্পণ করে সেখানকার প্রত্যক্ষ মার্কিন ভূমিকা কমিয়ে আনতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশগুলোকে তাদের সরকার ও অখ-তার নিরাপত্তার গ্যারান্টির বিনিময়ে ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেছে। ইসরাইলের সাথে এই সম্পর্ক অন্য যে কোন দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মতো না হয়ে মিসর, আমিরাত ও বাহরাইনের ক্ষেত্রে এক ধরনের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নিয়ন্ত্রণে যাবার অবস্থা দেখা গেছে। সামগ্রিকভাবে অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এমনকি ইসরাইলের সাথে যেসব দেশের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে সেসব দেশের সাথেও সম্পর্ক বিন্যাস করতে হচ্ছে নতুন সম্পর্কে জড়ানো আরব দেশগুলোর। এক কথায় বলা যায়, আরব দেশগুলোকে এ জন্য মুসলিম উম্মাহর এজেন্ডা পরিত্যাগ করতে হচ্ছে।
পাকিস্তানের জন্য নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার উদ্বেগ রয়েছে এখানটাতেও। দ্বি-জাতি তত্ত্ব বা মুসলিম জাতিসত্ত্বার এজেন্ডার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে পাকিস্তান। কাশ্মীর ইস্যুটির সূত্রপাতও হয় মুসলিম জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে। আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর এবং সুদান সৌদি আরবসহ যেসব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে বা করার লাইনে আছে তারা মুসলিম উম্মাহর এজেন্ডা পরিত্যাগ করেছে। ফিলিস্তিন বা আল আকসা ইস্যু তাদের জন্য আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। অন্য দিকে, ফিলিস্তিন ইস্যু যখন গুরুত্ব হারাবে তখন এই ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) বা ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের যতটুকু কার্যকারিতা এতদিন ছিল তা আরো কমে যাবে। ফলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে দায়সারা গোছের কথা বলা ছাড়া ওআইসির কোনো ভূমিকা থাকবে না। আর কাশ্মীর প্রশ্নেও অবস্থান হবে একই। যার ফলে পাকিস্তান ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি সম্মেলন আহ্বান করে কোনো সাড়া পায়নি বলে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমনকি জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদিকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান করেছে।
ভারতের সাথে বিরোধ মীমাংসা করার জন্য সৌদি আরবের চাপে নতি স্বীকার না করায় ইসলাবাদের সাথে রিয়াদের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। প্রদত্ত ঋণ সহায়তা ফেরত দিতে চাপের মুখে ইসলামাবাদ ১ বিলিয়ন ডলার দায় পরিশোধ করেছে।
ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়ার সাথে সাথে সৌদি-আমিরাত বলয়ের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্কের উন্নয়ন শুরু হয়। ভারতের কাছে শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন সৌদি প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান। আমেরিকান বাজারের উদ্বৃত্ত তেল ভারতে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেন তিনি। আমিরাতও ভারতে ব্যাপক বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেয়। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে আমিরাত। এভাবে ভারতের সাথে সৌদি আমিরাত বলয় যতই কৌশলগতভাবে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে ততই পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক হালকা হতে থাকে।
পাকিস্তান এই বলয়ের চাহিদা অনুসারে কাশ্মীরে ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে সম্পর্ক নমনীয় করতে রাজি না হওয়ায় চাপ সৃষ্টির কৌশল নিতে শুরু করে সৌদি-আমিরাত উভয়ে।
সৌদি নিরাপত্তা এখনো বেশ খানিকটা পাকিস্তানের সহযোগিতানির্ভর হওয়ায় প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাতে যেতে চাইছে না রিয়াদ। কিন্তু এ ব্যাপারে আমিরাতের অতি সক্রিয়তাবাদী পদক্ষেপে সহযোগিতা রয়েছে সৌদি আরবেরও। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৌদি আরব ও আমিরাতের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। দুই প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সুপ্রিম প্রধান আসিফ আলী জারদারির সব ব্যবসা বাণিজ্য ও স্থাপনা আমিরাতকেন্দ্রিক। অন্য দিকে মুসলিম লীগ নওয়াজের বিপুল ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে সৌদি আরবে। জারদারি ক্ষমতায় থাকাকালে আমিরাতের মাধ্যমে আর নওয়াজ শরিফ সরকার থাকাকালে সৌদি আরব ইসলামাবাদকে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য চাপ দেয়। জারদারির সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাজেট এতটাই সঙ্কুচিত হয়ে যায় যে সংস্থাটি বেশ খানিকটা কার্যকর নেটওয়ার্ক হারায়। মুখ ফসকে হোক বা ইচ্ছাকৃতভাবে জারদারি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই কাশ্মীরী যোদ্ধাদের জঙ্গী বলে উল্লেখ করেন একবার। অন্য দিকে নওয়াজ শরীফ ডিপ স্টেটের ইচ্ছার বাইরে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণের অভিষেকে হাজির হন। প্রতিদান হিসাবে মোদি লাহোরে গিয়ে নওয়াজের মাকে প্রণাম করে আসেন। নওয়াজের সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক অনেক বেশি সুসংহত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। নওয়াজ শরিফের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সুগার মিলে ভারতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ধরা পড়ে। এ নিয়ে পাকিস্তানের ‘ডিপ স্টেটের’ সাথে নওয়াজের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যার ফলে নওয়াজকে আদালতের রায়ে সরকারের পদ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিদায় নিতে হয়। তিনি এর প্রতিশোধ নিতে গেলে রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে যাবে তার প্রচেষ্টা। সেটি সফল হবার মতো নয়।
হঠাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা
পাকিস্তানের এখন যে হঠাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা তার গভীর তাৎপর্য জানতে হলে এই পটভূমি বাদ দেয়া যাবে না। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-ইসরাইল অক্ষের সাথে যখন পাক-চীন অক্ষের কৌশলগত লড়াই চলছে আর আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তালেবানের সাথে সমঝোতা একটি পরিণতি লাভের দিকে যাচ্ছে তখন সৌদি ও আমিরাতপন্থী দলগুলোর জোট সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেছে। একই সাথে বেলুচিস্তান ও খায়বার পাকতুন খোয়ায় হঠাৎ করে অন্তর্ঘাতী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা বেড়ে যাওয়া একই সূত্রে বাঁধা এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-
একটি প্রশ্ন এ সময়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, পাকিস্তান কি পারবে সৌদি-আমিরাতের ইচ্ছানুযায়ী ভারত ও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে? এটি করা হলে মিসরের ভূ-খ-ে আজ যেভাবে মিসরবাসীদের ইচ্ছা আকাক্সক্ষা বা স্বার্থের কোনো মূল্য নেই সেই একই অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে পাকিস্তানেও। পাকিস্তানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ইসলামী চেতনার যে শিকড় রয়েছে তা থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করার এক গভীর প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমেরিকান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ভিত শুধু নড়বড়ে করে দেয়নি একই সাথে সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করে সমাজে দ্বিধাবিভক্তিও সৃষ্টি করেছে। এখন রাজনৈতিক ও সামাজিক এই দ্বিধাবিভক্তিকে চাঙ্গা করে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করার একটি প্রয়াস চলছে বলে মনে হয়। পাকিস্তানের ডিপ স্টেট এ বিষয়ে সচেতন বলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অন্তর্ঘাত সৃষ্টির প্রচেষ্টা এবং কৌশলগত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিনির্মাণে সতর্ক কর্মপন্থা অনুসরণ করতে পারে ইসলামাবাদ। পাকিস্তান নিশ্চয়ই সৌদি-আমিরাতের চাপে নতি শিকার করে ইসরাইল-ভারতের গোয়েন্দা তৎপরতার চারণভূমিতে পরিণত হবে না।
mrkmmb@gmail.com