ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের অস্থিরতা
ইমরান খান ও জেনারেল বাজওয়া - ছবি সংগৃহীত
পাকিস্তানের দুই বৃহৎ বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে এমন একসময় সরকার পতনের ডাক দিচ্ছে যখন দেশটি করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে একটি স্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছেছে। যদিও সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গের ঝুঁকি এখনো আছে। ইমরান খান যখন সরকার গঠন করেন তখন পাকিস্তান এক ক্রমিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ছিল। আর সে অবস্থার মধ্য থেকে উত্তরণের জন্য ইমরান মিত্র দেশগুলোর কাছে ধরনা দিয়ে আশা অনুযায়ী ফল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত অপছন্দের আইএমএফ-এরও শরণাপন্ন হন। আইএমএফের কর্মসূচি বাস্তবায়ন ইমরান খান সরকারের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। কারণ তাতে কর যৌক্তিককরণ, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কথা রয়েছে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন না করলে আইএমএফ তাদের পরবর্তী অর্থ ছাড় দেবে না। অর্থনীতি যখন হিমশিম অবস্থায় তখন মূল্যবৃদ্ধি করা হলে আন্দোলনরত বিরোধীরা রাজপথে আগুন উসকে দেয়ার সুযোগ পাবে। সরকার নিশ্চিতভাবেই তা হতে দিতে চায় না।
ইমরান গত দুই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পারেননি। তবে অবনতিশীল পরিস্থিতি ঠেকিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণে অধিকাংশ দেশের অর্থনীতিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়। পাকিস্তানেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। পাকিস্তানি মুদ্রার মান কমে যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়ে। বেসরকারী খাতে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে যায়। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক জনশক্তি দেশে ফিরে আসে। আমদানি রফতানি এবং অর্থনীতির সার্বিক চাহিদার ওপর করোনার প্রভাব হয় স্পষ্ট। সার্বিকভাবে জনগণের আয়ের ওপর নেচিবাচক প্রভাব পড়ে। এক ধরনের অস্থির অবস্থা দেখা দেয় সামাজিকভাবে। স্বাভাবিকভাবে এটি সরকারের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে ক্ষোভও সৃষ্টি করে। দীর্ঘকাল ধরে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতাসীন দুই প্রধান বিরোধী দল এই সুযোগটিই নিতে চাইছে। তবে শুধু এই পরিস্থিতিই যে পাকিস্তানের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণ তা মনে হয় না।
পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে গত প্রায় ৫ দশক সময়কালের মধ্যে সবচেয়ে গভীর সঙ্কটসময় এখন পার করছে এখন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক সুরক্ষা বাতিল করার পর ভারতীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা পাকিস্তান ও চীন নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখলের ঘোষণা দেন। ভারতীয় লোকসভায় এ ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি ও সমরসজ্জার ভারতীয় পদক্ষেপে মনে হতে থাকে করোনা সংক্রমণ বা অর্থনৈতিক সঙ্কট দূরীকরণে মোদি সরকারের ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানো এর একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এর আগে পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করা এবং পাকিস্তান ও চীন সীমান্তের ভারতীয় অংশে অবকাঠামো উন্নয়নে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি প্রস্তুতি শুরু করা হয়। এতে স্পষ্ট হয় দিল্লির সামরিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এর মধ্যে বিজেপির একজন নেতার বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস বলেছে, চীন-পাকিস্তানের সাথে সামরিক সংঘাতের বিষয়ে মোদি দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছেন।
নিরাপত্তা হুমকি
ভারতের কাশ্মীর গিলগিট বাল্টিস্থান আর আকসাই চীন দখলের হুমকি এবং এ জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ পাকিস্তান ও চীন দু’দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এমন যে পাক-চীন নিরাপত্তা পরস্পরের সাথে বেশ খানিকটা সম্পর্কিত। আর স্নায়ুযুদ্ধকালে দুই পরাশক্তির যে বলয় বিভাজন ছিল তাতেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ব ও নিরাপত্তার মাতব্বরী ইসরাইলের হাতে সমর্পণ করে সেখানকার প্রত্যক্ষ মার্কিন ভূমিকা কমিয়ে আনতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশগুলোকে তাদের সরকার ও অখ-তার নিরাপত্তার গ্যারান্টির বিনিময়ে ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেছে। ইসরাইলের সাথে এই সম্পর্ক অন্য যে কোন দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মতো না হয়ে মিসর, আমিরাত ও বাহরাইনের ক্ষেত্রে এক ধরনের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নিয়ন্ত্রণে যাবার অবস্থা দেখা গেছে। সামগ্রিকভাবে অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এমনকি ইসরাইলের সাথে যেসব দেশের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে সেসব দেশের সাথেও সম্পর্ক বিন্যাস করতে হচ্ছে নতুন সম্পর্কে জড়ানো আরব দেশগুলোর। এক কথায় বলা যায়, আরব দেশগুলোকে এ জন্য মুসলিম উম্মাহর এজেন্ডা পরিত্যাগ করতে হচ্ছে।
পাকিস্তানের জন্য নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার উদ্বেগ রয়েছে এখানটাতেও। দ্বি-জাতি তত্ত্ব বা মুসলিম জাতিসত্ত্বার এজেন্ডার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে পাকিস্তান। কাশ্মীর ইস্যুটির সূত্রপাতও হয় মুসলিম জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে। আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর এবং সুদান সৌদি আরবসহ যেসব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে বা করার লাইনে আছে তারা মুসলিম উম্মাহর এজেন্ডা পরিত্যাগ করেছে। ফিলিস্তিন বা আল আকসা ইস্যু তাদের জন্য আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। অন্য দিকে, ফিলিস্তিন ইস্যু যখন গুরুত্ব হারাবে তখন এই ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) বা ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের যতটুকু কার্যকারিতা এতদিন ছিল তা আরো কমে যাবে। ফলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে দায়সারা গোছের কথা বলা ছাড়া ওআইসির কোনো ভূমিকা থাকবে না। আর কাশ্মীর প্রশ্নেও অবস্থান হবে একই। যার ফলে পাকিস্তান ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি সম্মেলন আহ্বান করে কোনো সাড়া পায়নি বলে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমনকি জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদিকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান করেছে।
ভারতের সাথে বিরোধ মীমাংসা করার জন্য সৌদি আরবের চাপে নতি স্বীকার না করায় ইসলাবাদের সাথে রিয়াদের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। প্রদত্ত ঋণ সহায়তা ফেরত দিতে চাপের মুখে ইসলামাবাদ ১ বিলিয়ন ডলার দায় পরিশোধ করেছে।