পাকিস্তানে হঠাৎ কেন রাজনৈতিক অস্থিরতা

মাসুম খলিলী | Oct 27, 2020 06:15 pm
ইমরান খান

ইমরান খান - ছবি সংগৃহীত

 

নিরাপত্তা হুমকি
ভারতের কাশ্মীর গিলগিট বাল্টিস্থান আর আকসাই চীন দখলের হুমকি এবং এ জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ পাকিস্তান ও চীন দু’দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এমন যে পাক-চীন নিরাপত্তা পরস্পরের সাথে বেশ খানিকটা সম্পর্কিত। আর স্নায়ুযুদ্ধকালে দুই পরাশক্তির যে বলয় বিভাজন ছিল তাতেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ব ও নিরাপত্তার মাতব্বরী ইসরাইলের হাতে সমর্পণ করে সেখানকার প্রত্যক্ষ মার্কিন ভূমিকা কমিয়ে আনতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশগুলোকে তাদের সরকার ও অখ-তার নিরাপত্তার গ্যারান্টির বিনিময়ে ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেছে। ইসরাইলের সাথে এই সম্পর্ক অন্য যে কোন দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মতো না হয়ে মিসর, আমিরাত ও বাহরাইনের ক্ষেত্রে এক ধরনের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নিয়ন্ত্রণে যাবার অবস্থা দেখা গেছে। সামগ্রিকভাবে অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এমনকি ইসরাইলের সাথে যেসব দেশের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে সেসব দেশের সাথেও সম্পর্ক বিন্যাস করতে হচ্ছে নতুন সম্পর্কে জড়ানো আরব দেশগুলোর। এক কথায় বলা যায়, আরব দেশগুলোকে এ জন্য মুসলিম উম্মাহর এজেন্ডা পরিত্যাগ করতে হচ্ছে।

পাকিস্তানের জন্য নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার উদ্বেগ রয়েছে এখানটাতেও। দ্বি-জাতি তত্ত্ব বা মুসলিম জাতিসত্ত্বার এজেন্ডার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে পাকিস্তান। কাশ্মীর ইস্যুটির সূত্রপাতও হয় মুসলিম জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে। আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর এবং সুদান সৌদি আরবসহ যেসব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে বা করার লাইনে আছে তারা মুসলিম উম্মাহর এজেন্ডা পরিত্যাগ করেছে। ফিলিস্তিন বা আল আকসা ইস্যু তাদের জন্য আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। অন্য দিকে, ফিলিস্তিন ইস্যু যখন গুরুত্ব হারাবে তখন এই ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) বা ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের যতটুকু কার্যকারিতা এতদিন ছিল তা আরো কমে যাবে। ফলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে দায়সারা গোছের কথা বলা ছাড়া ওআইসির কোনো ভূমিকা থাকবে না। আর কাশ্মীর প্রশ্নেও অবস্থান হবে একই। যার ফলে পাকিস্তান ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি সম্মেলন আহ্বান করে কোনো সাড়া পায়নি বলে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমনকি জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদিকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান করেছে।
ভারতের সাথে বিরোধ মীমাংসা করার জন্য সৌদি আরবের চাপে নতি স্বীকার না করায় ইসলাবাদের সাথে রিয়াদের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। প্রদত্ত ঋণ সহায়তা ফেরত দিতে চাপের মুখে ইসলামাবাদ ১ বিলিয়ন ডলার দায় পরিশোধ করেছে।

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়ার সাথে সাথে সৌদি-আমিরাত বলয়ের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্কের উন্নয়ন শুরু হয়। ভারতের কাছে শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন সৌদি প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান। আমেরিকান বাজারের উদ্বৃত্ত তেল ভারতে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেন তিনি। আমিরাতও ভারতে ব্যাপক বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেয়। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে আমিরাত। এভাবে ভারতের সাথে সৌদি আমিরাত বলয় যতই কৌশলগতভাবে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে ততই পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক হালকা হতে থাকে।
পাকিস্তান এই বলয়ের চাহিদা অনুসারে কাশ্মীরে ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে সম্পর্ক নমনীয় করতে রাজি না হওয়ায় চাপ সৃষ্টির কৌশল নিতে শুরু করে সৌদি-আমিরাত উভয়ে।

সৌদি নিরাপত্তা এখনো বেশ খানিকটা পাকিস্তানের সহযোগিতানির্ভর হওয়ায় প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাতে যেতে চাইছে না রিয়াদ। কিন্তু এ ব্যাপারে আমিরাতের অতি সক্রিয়তাবাদী পদক্ষেপে সহযোগিতা রয়েছে সৌদি আরবেরও। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৌদি আরব ও আমিরাতের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। দুই প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সুপ্রিম প্রধান আসিফ আলী জারদারির সব ব্যবসা বাণিজ্য ও স্থাপনা আমিরাতকেন্দ্রিক। অন্য দিকে মুসলিম লীগ নওয়াজের বিপুল ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে সৌদি আরবে। জারদারি ক্ষমতায় থাকাকালে আমিরাতের মাধ্যমে আর নওয়াজ শরিফ সরকার থাকাকালে সৌদি আরব ইসলামাবাদকে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য চাপ দেয়। জারদারির সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাজেট এতটাই সঙ্কুচিত হয়ে যায় যে সংস্থাটি বেশ খানিকটা কার্যকর নেটওয়ার্ক হারায়। মুখ ফসকে হোক বা ইচ্ছাকৃতভাবে জারদারি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই কাশ্মীরী যোদ্ধাদের জঙ্গী বলে উল্লেখ করেন একবার। অন্য দিকে নওয়াজ শরীফ ডিপ স্টেটের ইচ্ছার বাইরে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণের অভিষেকে হাজির হন। প্রতিদান হিসাবে মোদি লাহোরে গিয়ে নওয়াজের মাকে প্রণাম করে আসেন। নওয়াজের সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক অনেক বেশি সুসংহত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। নওয়াজ শরিফের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সুগার মিলে ভারতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ধরা পড়ে। এ নিয়ে পাকিস্তানের ‘ডিপ স্টেটের’ সাথে নওয়াজের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যার ফলে নওয়াজকে আদালতের রায়ে সরকারের পদ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিদায় নিতে হয়। তিনি এর প্রতিশোধ নিতে গেলে রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে যাবে তার প্রচেষ্টা। সেটি সফল হবার মতো নয়।

হঠাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা
পাকিস্তানের এখন যে হঠাৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা তার গভীর তাৎপর্য জানতে হলে এই পটভূমি বাদ দেয়া যাবে না। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-ইসরাইল অক্ষের সাথে যখন পাক-চীন অক্ষের কৌশলগত লড়াই চলছে আর আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তালেবানের সাথে সমঝোতা একটি পরিণতি লাভের দিকে যাচ্ছে তখন সৌদি ও আমিরাতপন্থী দলগুলোর জোট সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেছে। একই সাথে বেলুচিস্তান ও খায়বার পাকতুন খোয়ায় হঠাৎ করে অন্তর্ঘাতী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা বেড়ে যাওয়া একই সূত্রে বাঁধা এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-
একটি প্রশ্ন এ সময়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, পাকিস্তান কি পারবে সৌদি-আমিরাতের ইচ্ছানুযায়ী ভারত ও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে? এটি করা হলে মিসরের ভূ-খ-ে আজ যেভাবে মিসরবাসীদের ইচ্ছা আকাক্সক্ষা বা স্বার্থের কোনো মূল্য নেই সেই একই অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে পাকিস্তানেও। পাকিস্তানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ইসলামী চেতনার যে শিকড় রয়েছে তা থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করার এক গভীর প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমেরিকান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ভিত শুধু নড়বড়ে করে দেয়নি একই সাথে সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করে সমাজে দ্বিধাবিভক্তিও সৃষ্টি করেছে। এখন রাজনৈতিক ও সামাজিক এই দ্বিধাবিভক্তিকে চাঙ্গা করে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করার একটি প্রয়াস চলছে বলে মনে হয়। পাকিস্তানের ডিপ স্টেট এ বিষয়ে সচেতন বলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অন্তর্ঘাত সৃষ্টির প্রচেষ্টা এবং কৌশলগত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিনির্মাণে সতর্ক কর্মপন্থা অনুসরণ করতে পারে ইসলামাবাদ। পাকিস্তান নিশ্চয়ই সৌদি-আমিরাতের চাপে নতি শিকার করে ইসরাইল-ভারতের গোয়েন্দা তৎপরতার চারণভূমিতে পরিণত হবে না।

mrkmmb@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us