চীনা 'আগ্রাসন' ও কোয়াড : ভারতের ভাবনা
চীনা 'আগ্রাসন' ও কোয়াড : ভারতের ভাবনা - ছবি : সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে একটি কৌশলগত জোটের নাম কোয়াড। বর্তমান সময়ে আলোচিত একটি বিষয়। এই অঞ্চল ও আশপাশের ভবিষ্যও একে ঘিরে হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এখানে প্রকাশ করা হলো
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি মোকাবিলা করার জন্য অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও আমেরিকার কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি টোকিওতে কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন এবং সেখানে তারা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য সুরক্ষাবলয় গঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটা ঠিক যে এশিয়ায় ন্যাটোর একটি ছোট সংস্করণ হিসেবে এটি কাজ করবে না। তবে এই অঞ্চলে যার যার সার্বভৌমত্ব, নৌচলাচলের স্বাধীনতা, সীমানাসংক্রান্ত স্বাধীনতা, অবাধ বাণিজ্য ইত্যাদি নিশ্চিত করার জন্য কোয়াড কাজ করে চলেছে।
কোয়াডের এসব লক্ষ্যের সামনে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চীন। চীন থেকে উদ্ভূত করোনা মহামারীতে বিশ্ব যখন টালমাটাল, ঠিক সেই সময় চীনের আগ্রাসী বিস্তারবাদী আচরণ কোয়াডকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়ে সক্রিয় করেছে। ‘অবাধ ও মুক্ত ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল’ গঠনের ডাক দিয়ে ২০১৬ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রথম কোয়াডের ধারণা দিয়েছিলেন এবং পরে আমেরিকা এগিয়ে আসায় সেটি দ্রুতই একটি সক্রিয় জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অবাধ বাণিজ্য ও নৌচলাচল সুগম করায় একমত হওয়ার পিছনে চীনের বিস্তারবাদী তৎপরতা অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। চীনের দখলদারি মনোভাবের কারণে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশও এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
ফ্রান্স অতি সম্প্রতি ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছে। এর আগে ফ্রান্সের এই পদে কোনও রাষ্ট্রদূত ছিল না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে জার্মানি। সম্প্রতি জার্মানি একটি নির্দেশিকায় ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে সব ধরনের বিপদমুক্ত করতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে বলেছে। বোঝাই যাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কোয়াড সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ইইউ এই অঞ্চলে একজোট হয়ে কাজ করবে। আমেরিকার বিদেশসচিব মাইক পম্পেও বলেছেন, ‘আমরা চার দেশ মিলে একসময় যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলাম, তা এখন ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি সত্যিকারের নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের সকলের সামনে যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে, তাকে মোকাবিলা করতে এই নিরাপত্তা কাঠামো ভূমিকা রাখবে।’
নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানির কথায়, কোয়াডের ভবিষ্যৎ ভারতের উপর নির্ভর করছে। কারণ এই জোটের অন্য তিনটি দেশ আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও জাপান আগে থেকেই আমেরিকার নিরাপত্তার ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে। ফলে চীনের আগ্রাসন থেকে তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। কিন্তু ভারতের সঙ্গে চীনের স্থলসীমানা রয়েছে এবং সম্প্রতি ভারত চীনের সীমান্ত আগ্রাসনের শিকারও হয়েছে। এতে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মতো আরও একটি যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চীনের এই আগ্রাসনের প্রবণতা ভূকৌশলগত হিসেব–নিকেশ বদলে দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং হিমালয় অঞ্চলে পিপলস লিবারেশন আর্মিকে আগ্রাসী হওয়ার নির্দেশ দিয়ে ভারতকে আঘাত মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে বাধ্য করেছেন। লাদাখে চীন যেভাবে হামলা চালিয়েছে, সেভাবে চীন যাতে ফের হামলা চালাতে না পারে, সে জন্য কোয়াড আরো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
কোয়াডের তৎপরতার সঙ্গে আমেরিকা–চীনের ‘নতুন শীতল যুদ্ধের’ সম্পর্ক আছে বলে মনে করা যেতে পারে। জাপানের সঙ্গে আমেরিকা যে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ আছে, ভারতের সঙ্গে সে ধরনের চুক্তি আমেরিকার নেই। তবে চীনকে মোকাবিলা করতে আমেরিকা ভারতকে ‘সফট অ্যালায়েন্স’ হিসেবে চাইছে।
ভারত মহাসাগরে ভারত, আমেরিকা ও জাপানের যে সামরিক মহড়া হয়ে থাকে, ‘মালাবার নেভাল ওয়ার গেম’ শীর্ষক সেই মহড়ায় এবার অস্ট্রেলিয়া যোগ দেবে। অর্থাৎ কোয়াডের সব সদস্য এবার যৌথ মহড়া দেবে। কোয়াডের এই সংহতি ও তৎপরতায় জি জিনপিংয়ের আগ্রাসী নীতির বেপরোয়া গতি বাধার মুখে পড়বে। একসময় কোয়াডকে চীনের আগ্রাসন থামানোর একটি প্রতীকী প্রতিষ্ঠান বলে ভাবা হতো। কিন্তু এখন সেটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। তাইওয়ানকে জি জিনপিং ধারাবাহিকভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। সেই হুমকি যদি সামরিক তৎপরতায় মোড় নেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক জোট হিসেবে কোয়াডের সামরিক সক্ষমতার বিষয়টি গোটা দুনিয়ার সামনে আত্মপ্রকাশ করবে।