৪ মাজহাব অনুসরণ কেন প্রয়োজন
৪ মাজহাব অনুসরণ কেন প্রয়োজন - ছবি সংগৃহীত
মাজহাব অর্থ আদর্শ, মত, বিশ্বাস, মতবাদ ইত্যাদি। পৃথিবীতে বর্তমানে চারটি মাজহাব রয়েছে। তা হলো হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাব। হানাফি মাজহাবের প্রবর্তক ইমাম আবু হানিফা নুুমান ইবন সাবিত। তার জন্ম ৮০ হিজরিতে এবং মৃত্যু ১৫০ হিজরিতে। তিনি ৪০ জন ছাত্র নিয়ে ফিকহ বোর্ড গঠন করেন এবং ৩০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফিকহশাস্ত্র সঙ্কলন করেন। মালেকি মাজহাবের প্রবর্তক ইমাম মালেক রা:। তিনি ইমাম আবু হানিফা রা:-এর সুযোগ্য ছাত্র। তার জন্ম হিজরি ৯০ মতান্তরে ৯৪-৯৫ সনে, মৃত্যু হিজরি ১৭৯ সনের ১১ মতান্তরে বা ১৪ রবিউল আউয়াল শনিবার। শাফেয়ি মাজহাবের প্রবর্তক ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইদরিস আশ শাফেয়ি। তিনি ছিলেন ইমাম মালেক রা:-এর অন্যতম শিষ্য। তার জন্ম হিজরি ১৫০ সালে এবং মৃত্যু হিজরি ২০৪ সনে। হাম্বলি মাজহাবের প্রবর্তক ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রা:। তিনি হিজরি ১১৬ সালে রবিউল আউয়াল মাসে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং হিজরি ২৪৯ সনে বাগদাদেই ইন্তেকাল করেন। চারটি মাজহাবই উত্তম যুগে প্রবর্তিত হয়েছে এবং চারটি মাজহাবই হক বলে ইজমা হয়ে গেছে, ফলে এ চারটি মাজহাবকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
মাজহাব মানা কেন জরুরি : মাজহাব মানা এবং মাজহাবের অনুসরণ করা সবার জন্য আবশ্যক ও জরুরি নয়। বরং যারা কুরআন ও হাদিসের তত্ত্বজ্ঞান জানেন না এবং মুজতাহিদ বা গবেষক নন তাদের জন্য কোনো মাজহাব অনুসরণ করা আবশ্যক। মাজহাব অনুসরণ আবশ্যক হওয়ার কারণ হলো-
কুরআন মাজিদে বিপরীতমুখী আয়াত বিদ্যমান থাকা : কুরআন মাজিদের কোনো কোনো আয়াতের অর্থ আপাত দৃষ্টিতে বিপরীত মনে হয়। যেমন- একটি আয়াতে রয়েছে কুরআনের যতটুকু পাঠ করা তোমাদের জন্য সহজ ততটুকু পাঠ করো। অপর আয়াতে রয়েছে- কুরআন যখন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগের সাথে তা শ্রবণ করো এবং চুপ থাকো, যেন তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও। এ আয়াতদ্বয় একটি অন্যটির বিপরীতে। এখন কোনটির ওপর আমল হবে সবার বুঝা সম্ভব নয়।
কুরআন ও হাদিসে একাধিক অর্থবোধক শব্দের ব্যবহার : কুরআন ও হাদিসের একাধিক অর্থবোধক শব্দের ব্যবহার অনেক। যেমন : আল্লাহর বাণী- তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীগণ তিন কুরু পর্যন্ত প্রতীক্ষায় থাকবে। এ আয়াতে কুরু এর অর্থ দুটি ঋতুস্রাব ও পবিত্রতা। এখন কোন অর্থ হবে তা জানার জন্য মুজতাহিদের দরকার। মহানবী সা: বলেন, যে ব্যক্তি জমি বর্গা দেয়া থেকে বিরত না থাকে সে যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকে। জমি বর্গা দেয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। কোন পদ্ধতি এখানে নিষেধ করা হয়েছে তা জানার জন্য গবেষণা প্রয়োজন।
নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব : স্থান, কাল ও অবস্থান পরিবর্তনের ফলে নতুন সম্যার উদ্ভব হয়। বর্তমানে মানুষ চাঁদের দেশে গেছে, মঙ্গল গ্রহে পৌঁছেছে। সেখানে নামাজ কিভাবে পড়বে তার জন্য গবেষণার দরকার। একজন মানুষের রক্ত অন্য জনকে দেয়ার বিধান কী? একজনের চক্ষুকণিকা, বালব, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গ অন্যজনকে দেয়া বৈধ কি না? এ সব প্রশ্নের সমাধানের জন্য গবেষণার প্রয়োজন। ভবিষ্যতে আরো অনেক সমস্যা আসতে পারে, যার সমাধান কোথাও খোঁজে পাওয়া না গেলে গবেষণার মুখাপেক্ষী হতে হবে।
সবার কুরআন-হাদিসের যথার্থ জ্ঞান না থাকা : কুরআন ও হাদিসের মর্ম ও তত্ত্বজ্ঞান, নাসেখ মানসুখ, মুজমাল, মুফাসসার ইত্যাদি সম্পর্কে অনেকেরই যথার্থ জ্ঞান নেই। তাই নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য মাজহাবের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আল্লাহর নির্দেশ : আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
১. হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে উলিল আমরের। (সূরা নিসা-৪৯) মুফাসসিরগণের মতে, উলিল আমর দ্বারা কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানের অধিকারী ফকিহ ও মুজতাহিদগণকেই বুঝানো হয়েছে।
২. তোমরা যদি না জানো, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো। (সূরা নাহল-আয়াত-৪৩)
৩. তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ কেন বের হয় না? যাতে তারা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়। (সূরা তাওবা-১২২)
৪. যেদিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের নেতাসহ ডাকব। (সূরা বনি ইসরাঈল-৭১) ইমাম কুরতুবি এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, বিচার দিবসে প্রত্যেক দলকে দুনিয়ার অনুসৃত ইমামের মাজহাব অনুসারে ডাকা হবে। (তাফসিরে কুরতুবি ১০ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৯৭)
৫. যারা প্রার্থনা করে, হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করো যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদেরকে করো মুত্তাকিদের জন্য অগ্রনেতা। (সূরা ফুরকান-৭৪) মুফাসসির সম্রাট ইবন আব্বাস রা: এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আমাদেরকে হিদায়াতের ইমাম করুন। ইমাম বগভি র: বলেন, আমাদেরকে এমন ইমাম করে দিন যাতে মুক্তাকিগণ সৎ কাজে অনুসরণ করে (তাফসিরে বগভি)
৬. যারা আমার অভিমুখী হয়েছে তাদের পথ অনুসরণ করো। (সূরা লুকমান-১৫) এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নবীর এবং সৎকর্ম পরায়ণ ব্যক্তিদের মাজহাব তথা পথ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশ : জ্ঞানীদের অনুসরণ করার ব্যাপারে মহানবী সা: বলেন-
১. দ্বীন হচ্ছে শুভ কামনা। আমরা (সাহাবায়ে কিরাম) বললাম, কার জন্য শুভ কামনা? তিনি বলেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলমানদের ইমামদের জন্য এবং সর্বসাধারণ মুসলমানের জন্য। (সহিহ মুসলিম হাদিস নং ১৯৬/৯৫)। ইবনে হাজার আসকালানি বলেন, মুসলমানদের ইমাম হলেন মুজতাহিদগণ আর তাদের জন্য শুভ কামনা হলো তাদের ইলম তথা ইজতিহাদি মাসআলা প্রচার প্রসার করা, তাদের মর্যাদা তুলে ধরা এবং তাদের সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা। (ফতহুল রাবি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩৮)।
২. যে ব্যক্তি পরিপক্ব জ্ঞান ছাড়া ফতওয়া দেয়, তার ভুল ফতওয়ার পাপ তার ওপরই বর্তাবে। (আবু দাউদ হাদিস নং-৩৬৫৭)।
৩. সুযোগ্য উত্তরসূরি পূর্বসূরিদের কাছে থেকে এ ইলম তথা কুরআন-সুন্নাহর ইলম গ্রহণ করবে। (তাহাবি দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭) এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, উত্তরসূরিগণ শরিয়তের জ্ঞান পূর্বসূরিদের থেকে গ্রহণ করবেন।
৪. রাসূল সা: সাহাবায়ে কিরামকে বলেন, ‘তোমরা আমাকে অনুসরণ করো। আর তোমাদের পরবর্তীরা তোমাদের অনুসরণ করবে।’ (বুখারি বাব-৬৮, মুসলিম বাব-২৮ হাদিস নং-৯৮২/১৩০)।
৫. ‘আমার উম্মত অবশ্যই কোনো গোমরাহির ওপর একমত হবে না। তোমরা যখন কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখবে তখন গরিষ্ঠদের মতকে আঁকড়ে ধরবে।’ (ইবনে মাজাহ, বার-৮ হাদিস নং-৩৯৫০)।
৬. ‘জানি না যে, আর কতকাল তোমাদের সাথে আমি বেঁচে থাকব। তবে আমার পরে তোমরা আবু বকর ও উমরকে অনুসরণ করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস নং-৩৬৬৩)।
৭. মহানবী সা: হজরত মুয়ায ইবন জাবাল রা:কে ইয়েমেনের গভর্নর করে পাঠানোর প্রাক্কালে জিজ্ঞেস করেন, হে মুয়ায! তুমি উদ্ভূত সমস্যার সমাধান কিভাবে করবে? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, আমি কুরআন মাজিদে এর সমাধান খুঁজব। রাসূল সা: প্রশ্ন করলেন, যদি কুরআনে না পাও তখন কী করবে? হজরত মুয়ায রা: বলেন, আমি সুন্নাতে রাসূলের মাধ্যমে এর সমাধান করব। রাসূল সা: আবার প্রশ্ন করলেন যদি সেখানে না পাও, তাহলে কী করবে? হজরত মুয়ায রা: বললেন, আমি ইজতিহাদ করব। মহানবী সা: প্রিয় সাহাবির কথা শুনে অত্যন্ত খুশি হন এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলের দূতকে রাসূলের সন্তুষ্টি অনুযায়ী কথা বলার তাওফিক দান করায় আল্লাহর প্রশংসা করেন। (আবু দাউদ হাদিস নং-৩৫৯৪, তিরমিজি হাদিস নং ১৩২৭, নাসায়ি হাদিস নং-৫৩৯৯)।
বর্তমানে পৃথিবীতে চারটি মাজহাব চালু রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাধিক মুসলমান হানাফি মাজহাবের অনুসারী। অনুসরণের দিক দ্বিতীয় হলো শাফেয়ি মাজহাব। তারপর মালেকি তারপর হাম্বলি। চার ইমামের চারটি মাজহাব সুবিন্যস্ত, গ্রন্থবদ্ধ ও সংরক্ষিত আকারে অবিচ্ছিন্ন ধারায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। সর্বযুগে সব দেশে চার মাজহাবের অসংখ্য বিশেষজ্ঞ আলেম বিদ্যমান রয়েছেন। আল্লামা জালালউদ্দিন মহল্লি র: বলেন, অধিকতর বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, সাধারণ মানুষ এবং সেসব আলিম মুজতাহিদ নন তাদের জন্য নির্দিষ্ট মাজহাব অনুসরণ করা অপরিহার্য। (শরহুজময়িল জাওয়ামি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭১)। ইবন হুরায়রা আল হাম্বলি রা: বলেন, চার মাজহাবের অনুসরণের ওপর ইজমা সঙ্ঘটিত হয়েছে। সঠিক মত তাদের মতের বাইরে যাবে না। ( আল মুবদি শরহুল মুকনি, দশম খণ্ড পৃষ্ঠা-১৬)।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী