ভারতকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা
ভারতকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা - ছবি : সংগৃহীত
আগামী ২৭ অক্টোবর নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় তথাকথিত ২+২ যুক্তরাষ্ট্র-ভারতীয় নিরাপত্তা সংলাপের বিব্রতকর সময় নিয়ে ধ্রূমজাল সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ কী হচ্ছে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকা।
অব্যাহতভাবে ঘনিষ্ঠ হতে থাকা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সামরিক জোট বা ভারত-চীন সম্পর্ক অব্যাহতভাবে পতনের দুটি ঘটনার কোনটির কারণে এই সময় নির্ধারণ করা হলো, তা নির্ধারণ করা অসম্ভব।
বর্তমানে অদ্ভূত দ্বান্দ্বিক অবস্থা বিরাজ করছে। একদিকে ২০০৮ সালের পরমাণু চুক্তি এবং ২০১৫ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তা আরো বেগবান হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সামরিক জোট এখনো টলায়মান অবস্থায় রয়েছে, অন্য দিকে ইউপিএ শাসনামলে স্থিতিশীল থাকা চীন-ভারত সম্পর্ক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে অবনতি হতে থাকে এবং তা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে গেছে।
সমস্যা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গড়ার ব্যাপারে (কোয়াডে তা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান) ভারতীয়রা অনেকটাই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে তা বিবেচনা করছে, আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বৃহত্তর বৈশ্বিক ভিশন বিবেচনা করছে।
এই জটিলতার মধ্যে বিভ্রান্তিও আছে : ভারতীয়দের মধ্যে ব্যাপকভাবে এই ধারণা বিদ্যমান রয়েছে যে তাদের দেশ আমেরিকান পণ্য সামগ্রী থেকে সেরাটাই বাছাই করছে। কিন্তু দিল্লির নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতারা ভালোমতোই জানেন যে এটা স্রেফ দিবাস্বপ্ন। কারণ কোনো পরাশক্তির সাথে সামরিক জোট গঠন করা অনড় প্রতিশ্রুতির বিষয়।
আমেরিকান বিশ্লেষকেরা অনেকাংশেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাথে সুর মিলিয়েই কথা বলছেন। ভারতের অনেক বিশ্লেষক ২+২ সংলাপকে ৩ নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচনের আগ দিয়ে একটি তাড়াহুড়া করে আয়োজিত অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে তারা ঠিক এই সময়েই কেন ২+২ সংলাপ আয়োজন করা হলো, তা নিয়ে ভেবে দেখছেন না।
আসলে অনুষ্ঠানটি ৩ নভেম্বরের আগেই এ ধরনের অনুষ্ঠান হতেই হবে। এর একমাত্র কারণ হলো, একে ঘিরে অনিশ্চয়তা রয়েছে। আর তা হলো জো বাইডেন জয়ী হয়ে যান, তবে অনেক কিছুতেই অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে পারে।
জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে রেখে ইঞ্জিন জোড়া লাগানো হয়েছে। তবে ইঞ্জিনটি চালানোর আগে বেশ গতির সঞ্চার করতে হবে।সেই কাজটিই করা হচ্ছে। ইঞ্জিনে এমন গতির সঞ্চার করা হচ্ছে, যাতে পরে নিজ গতিতেই তা চলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সামরিক জোটের জন্য চূড়ান্ত সময় চলে এসেছে। এ কারণে ইঞ্জিনটি চালু করার জন্যই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও প্রতিরক্ষামন্ত্রীঅ মার্ক এস্পারকে নিয়ে আসছেন ভঅরতের সামরিক জোট গঠনের জন্য। কাজটি আর কোনোভাবেই ফেলে রাখা যায় না।
এস্পারকে নিয়ে ভারতীয় পক্ষের একটি সমস্যা আছে। পেশাগত জীবনে তিনি বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী। তিনি ১০১তম এয়ারবোর্ন (স্ক্রিমিং ঈগলস)-এ পদাতিক অফিসার ছিলেন। তিনি ডেজার্ট স্ট্রোম ও গালফ ওয়ারে (ব্রোঞ্জ স্টার পুরস্কার পেয়েছিলেন) সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, ওয়েস্ট পয়েন্ট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েট হয়েছিলেন, হার্ভার্ড থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন, পিএইচডি ডিগ্রি করেছেন জর্জ ওয়াশিংটন থেকে। তিনি সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। পেন্টাগনের দায়িত্ব নেয়ার আগে তিনি সেনাবাহিনীর সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা মোদির মন্ত্রিসভায় শিক্ষা বা পেশাগত দক্ষতার দিক থেকে এস্পারের সমকক্ষ কেউ নেই। ভারতে তার সফর সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে ২০ অক্টোবর আটলান্টিক কাউন্সিলের সিইও ও সভাপতি ফ্রেডেরিক কেম্পের সাথে তার সংলাপের ট্রান্সক্রিস্টটি অবশ্যই পড়া উচিত।
তিনি পরাশক্তির প্রতিযোগিতার যুগে মার্কিন মিত্র জোট ও অংশীদারিত্ব জোরদার করা নিয়ে আলোচনায় তার চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছেন এবং তা করেছেন ভারত সফরের ঠিক আগ দিয়ে।
এস্পার জয়শঙ্কর যে ইঞ্জিনটি সংযোজন করেছেন, সেটি পরীক্ষা করার জন্য দিল্লিতে যে রোড ম্যাট নিয়ে আসছেন, তার একটি দারুণ পূর্বালোচনা এখানে যোগ করেছেন।
তিনি যে আলোচনা পেশ করেছেন, তা যদি সংক্ষিপ্তাকারে বলা যায় তবে তা দাঁড়ায় এমন যে মার্কিন প্রতিরক্ষা কৌশল আসলে পেন্টাগনের এক নম্বর অগ্রাধিকার বাস্তবায়ন করছে। আর তা করা হচ্ছে পরাশক্তির প্রতিযোগিতার যুগে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিযোগী হচ্ছে চীন ও রাশিয়া।
এই প্রেক্ষাপটে পেন্টাগন যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে তা হলো : প্রথমত, মার্কিন বাহিনীকে মারণঘাতী করে প্রস্তুত করা; দ্বিতীয়ত, জোট শক্তিশালী করা ও অংশীদারিত্ব গড়া; তৃতীয়ত, সময়, অর্থ ও জনশক্তিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পুনর্বিন্যাশ করা।
তিনি বলেন, মিত্র ও অংশীদারদের নেটওয়ার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোই প্রতিক্ষপক্ষের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে বিপুলভাবে সুবিধা দেবে। চীন ও রাশিয়া দুই দেশ মিলে সম্ভবত যত দেশকে একত্রিত করতে পারবে, তার সংখ্যা ১০-এর কমই হবে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার তৎপরতা বন্ধ করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া দ্রুতগতিতে তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়ন করছে, ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের অনুকূলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য পেনটাগন বর্তমানে দুটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। একটি হলো, নতুন ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স গাইডেন্স ফর ডেভেলপমেন্ট অব অ্যালায়েন্স অ্যান্ড পার্টনারশিপস (জিডিএপি) ও অপরটি হলো তথাকথিত ডিফেন্স ট্রেড মডার্নাইজেশন।
তিনি বলেন, দুটি মিলে যুক্তরাষ্ট্রকে সমমনা দেশগুলোকে নিয়ে তার সক্ষমতা ও সামর্থ্য বাড়াতে সহায়তা করবে, বন্ধুপ্রতীম সামরিক বাহিনীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা বাড়াবে।
জিডিএপির লক্ষ্য হলো মিত্র ও অংশীদারদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করা। এটা নতুন যুগের সূচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যাপকভাবে সুবিধা দেবে।
এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পেন্টাগনের আছে একটি টুল কিট। এটি গঠিত হয় অন্যান্য দেশের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষিত সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে। ফরেন মিলিটারি সেলস প্রগ্রাম থেকেও তাদের বাছাই করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সরঞ্জাম, প্রযুক্তি, সিস্টেমকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অংশীদারদের যুদ্ধপ্রস্তুতির সক্ষমতা বাড়াতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে আসছে ফরেন মিলিটারি সেলস। আর তা মার্কিন অস্ত্র শিল্পকে উদ্ভাবনমূলক, প্রতিযোগী হিসেবেও বহাল রেখেছে।
এস্পার বলেন, দিল্লিতে ২+২ সংলাপ বর্তমান সময়ের কৌশলগত ইস্যুগুলোতে দুই দেশের মধ্যকার অভিন্ন অবস্থানই আরো সুসংহত হবে।
মজার ব্যাপার হলো, এস্পার প্রকাশ করে দেন যে গত সপ্তাহে তথাকথিত ফাইভ আই ফোরামের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে গঠিত এই গোয়েন্দা গ্রুপিংয়ের বৈঠকে ইন্দো-প্যাসিফিকের চ্যালেঞ্জ, কিভাবে এসব দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। তিনি বলেন, সার্বভৌমত্বের প্রতি, আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক ব্যবস্থার প্রতি, স্বাধীন নৌচলাচলের প্রতি চ্যালেঞ্জগুলো কিভাবে মোকাবেলা করা যাবে, তা নিয়েও আলোচনা হয়। ফলে আরো ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সৃষ্টিও হচ্ছে। নয়া দিল্লির বৈঠকে এসব বিষয় নিয়েও আলোচনা হবে।
সূত্র : ইন্ডিয়াপাঞ্চলাইন