ইমিউন সিস্টেম যেভাবে কাজ করে
ইমিউন সিস্টেম যেভাবে কাজ করে - ছবি সংগৃহীত
দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেহকে রোগব্যাধি থেকে রক্ষার জন্যও রয়েছে একটি সুসংহত ও কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তের মধ্যে তিন ধরনের সেল বা কোষ রয়েছে- লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা ও অনুচক্রিকা। লোহিত কণিকার কাজ হলো, রক্তে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই অক্সাইড পরিবহন করা। অনুচক্রিকার কাজ হলো, কোনো জায়গা কেটে গেলে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করা, যাতে অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ হতে না পারে। আর শ্বেতকণিকার কাজ, দেহের রোগ প্রতিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও সহায়তা করা। মূলত শ্বেতকণিকাই হলো আমাদের দেহের আসল প্রতিরক্ষাবাহিনী। যেসব শ্বেতকণিকা রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অংশ নেয় সেগুলো হলো নিউট্রোফিল, মনোসাইট, ম্যাক্রোফেজ, বি-লিম্ফোসাইট, টি-লিম্ফোসাইট ইত্যাদি। শরীরে কোনো রোগ-জীবাণু প্রবেশের সাথে সাথে এরা সেগুলোকে ধ্বংস করার কাজে উদ্যোগী হয়। এ ছাড়া আছে ন্যাচারাল কিলার সেল নামেই এর পরিচয়। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত ক্যান্সার সেল তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এগুলো টিউমারে রূপ নেয়ার আগেই ন্যাচারাল কিলার সেল ওগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।
দেহে ইমিউন সিস্টেম মূলত কাজ করে স্বয়ংক্রিয় ও স্বনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে। যেমন হাত বা শরীরে কোনো অংশ কেটে গেলে সেই কাটা অংশ দিয়ে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। এ সময় দ্রুত নিউট্রোফিল এগিয়ে আসে এবং এই জীবাণুকে ধ্বংস করে। নিউট্রোফিল অযাচিত জীবাণুকে ধরে খেয়ে ফেলে, প্রতিনিয়ত এভাবে জীবাণুর সাথে যুদ্ধ করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। আবার যখন নিউট্রোফিল জীবাণুর সাথে পেরে উঠে না, তখনই ইনফেকশন হয়। সাদা রঙের পুঁজ বেরিয়ে আসে। এই পুঁজ আসলে শরীরের মৃত নিউট্রোফিল। এভাবে প্রতিদিন দেহকে রক্ষা করতে গিয়ে শত সহস্র নিউট্রোফিল অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে।
যক্ষ্মার ভ্যাকসিনের কথা ধরা যাক। শরীরে এই ভ্যাকসিন দেয়া মাত্রই দেহ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যতম সৈনিক ম্যাক্রোফেজ সেখানে ছুটে যায়, টিকার জীবাণুটিকে কামড়ে ধরে। কামড় দিয়ে সে বুঝতে পারে যে তাকে ধ্বংস করা তার সাধ্যের মধ্যে নেই। কিন্তু হাল ছেড়ে না দিয়ে ম্যাক্রোফেজ তাকে নিয়ে আসে টি-লিম্ফোসাইটের কাছে। টি-লিম্ফোসাইট তাকে ধ্বংস করে। সেই সাথে হাজার হাজার মেমোরি টি-সেল তৈরি করে রক্তে ছেড়ে দেয়। ভবিষ্যতে যখন যক্ষ্মার সত্যিকার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে তখন এই মেমোরি টি সেল সেই জীবাণুকে আক্রমণ করে এবং একই প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করে দেয়। অর্থাৎ যক্ষ্মা থেকে আপনি বা আপনার শিশু রক্ষা পায়। যক্ষ্মার ভ্যাকসিন বা টিকা এক্ষেত্রে শুধু সাহায্য করছে। একইভাবে হেপাটাইটিস, হাম, পোলিও এবং বর্তমান করোনাভাইরাস ও অন্যান্য রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করছে শরীরের ইমিউন সিস্টেম। ভ্যাকসিন এ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তুলছে।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী বর্তমানে সবচেয়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী রোগ। এর আগের আতঙ্ক সৃষ্টিকারী রোগ হলো এইডস। এই রোগটি শরীরে ইমিউন সিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। এইডসে এখন পর্যন্ত বিশ্বে তিন কোটিরও বেশি মানুষ মারা গেছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বলা হয়েছে। এইডস শরীরে ঢোকার পর টি-লিম্ফোসাইটের ভেতরে বাসা বাঁধে। সেখানে সে বংশবিস্তার করে। একসময় টি-লিম্ফোসাইটকে অকার্যকর করে দেয়। এইডস রোগ নিয়েও একজন রোগী অনেক দিন বাঁচতে পারে। কারণ টি-লিম্ফোসাইটের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এইডস রোগীর দেহে যদি অন্য রোগের জীবাণু ঢুকে পড়ে অর্থাৎ যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া কিংবা বর্তমান করোনাভাইরাস, তখন তাকে আর সুস্থ করা সম্ভব হয় না। ইমিউন সিস্টেম তখন অসহায় হয়ে পড়ে।
আগেই বলেছি, দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কিছু কোষ সব সময় সদা সতর্ক প্রহরীর মতো চারদিকে টহল দিচ্ছে। এরা দেহে আক্রমণকারী ভাইরাস বা যেকোনো রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে সর্বদা সজাগ। আসলে দেহে আক্রমণকারী কোনো ভাইরাস বা রোগ-জীবাণুর উপস্থিতি টের পাওয়ার সাথে সাথে ইমিউন সিস্টেম এক ধরনের প্রোটিন নিঃসরণ করে। এই প্রোটিনকে বলা হয় ইন্টারফেরন। এরা ভাইরাস কপি বা প্রতিলিপি তৈরির এবং তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ বা ইন্টারফেয়ার করে। ভাইরাসটির বংশবিস্তার ঠেকানোর পাশাপাশি ইমিউন সিস্টেমের অন্যান্য অংশকে সক্রিয় করে ইন্টারফেরন। যেমন- আক্রমণকারীকে ধ্বংস করার জন্য নিউট্রোফিল নিয়োগ করে। ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের বিরুদ্ধে নিউট্রোফিল খুবই কার্যকর। নিউট্রোফিল এগুলোকে ধরে খেয়ে ফেলে। ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে নিউট্রোফিল দু’ধারি তলোয়ারের মতো। এরা ভাইরাসের সাথে টানা যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। এই যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে নিউট্রোফিল নিঃশেষও হয়ে যেতে পারে। এটা হলে একে বলা হয় সাইটোকাইন স্টর্ম বা সাইটোকাইন ঝড়।
ইমিউন সিস্টেমের অধীনে নজরদারির ক্ষেত্রে সেরা প্রহরী হলো ম্যাক্রোফেজ। দেহের চার দিকে ঘুরে সন্দেহজনক কিছু পেলেই সেগুলোকে খপ করে খেয়ে ফেলে ম্যাক্রোফেজ। এরপরও একক লড়াই চালিয়ে যাওয়া অনেক সময় তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা ইমিউন সিস্টেমের অন্য অংশগুলোকে ডেকে পাঠায়। ভাইরাসের সাথে লড়াইয়ে ইমিউন সিস্টেমের ‘অ্যাডাপটিভ’ বা অভিযোজিত অংশ জড়িত থাকে। এ পর্যায়ে আমরা টি-কিলার সেল বা টি-ঘাতক কোষকে সক্রিয় হতে দেখি। করোনাভাইরাসের কথাই ধরুন। এক্ষেত্রে টি-সেলের কাজ হলো, কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমিত বা দখল করা কোষগুলোকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করা। অ্যাডাপটিভ রেসপন্সে প্লাজমা বি-সেল থেকে কোটি কোটি অ্যান্টিবডি নিঃসরণ হতে থাকে। এরা লুকিয়ে থাকা বা পালিয়ে যাওয়া যেকোনো ভাইরাসকে ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করে। অ্যান্টিবডি বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। অন্যতম কাজ হলো ক্ষুধার্ত শ্বেতকোষগুলোকে সক্রিয় করে তোলা। রক্তে অ্যান্টিবডির মাত্রা বেড়ে যাওয়া একটি ভালো লক্ষণ। এর মানে হলো, ইমিউন সিস্টেম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। চীনের উহানের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্বাস্থ্যবান ও সক্রিয় ইমিউন সিস্টেম খুব গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের চেয়ে বয়স্করা ভাইরাসে কেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এ থেকেই বোঝা যায়। বয়স্কদের ইমিউন সিস্টেম বেশ দুর্বল। তাই শরীরকে সুস্থ ও রোগমুক্ত রাখতে ইমিউন সিস্টেমকে সুস্থ রাখা জরুরি। ডাক্তার, ওষুধ, হাসপাতাল হলো সহযোগী শক্তি। সুস্থতার মূল শক্তি হলো একটি কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম।