করোনায় কী খাবেন, কী খাবেন না
কী খাবেন, কী খাবেন না - ছবি সংগৃহীত
ওষুধ, ইনজেকশন, টিকা নয়। যেকোনো ভাইরাস, যেকোনো সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে বড় শক্তি বা প্রতিরোধ হচ্ছে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ইমিউন সিস্টেমের ক্ষমতা যত বাড়াবেন, তত সফলভাবে করোনাভাইরাসও মোকাবেলা করা যাবে। সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন দেহমনের যথাযথ যতœ নেয়া। সুস্থতা মহান আল্লøাহ তায়ালার বড় নিয়ামত। এই সুস্থতার জন্য প্রয়োজন সাত্ত্বিক খাবার। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। পুষ্টি বিজ্ঞানসম্মত খাবার। আর নিয়মিত কিছু ব্যায়াম। যেমন সবুজ গাছগাছালিপূর্ণ জায়গায় হাঁটা আর প্রাণভরে শ্বাস নেয়া। শরীরে রোদ লাগানো এবং সাধারণ ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করার অভ্যাস। তাহলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাড়বে।
সুস্থতা যে কত বড় নিয়ামত এটা একজন মানুষ বুঝতে পারেন, যখন তিনি অসুস্থ হন। শুধু অর্থের পেছনে ছুটলে অর্থ সুস্থতা দিতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক প্রতিটি ক্ষেত্রে সুস্থ জীবনদৃষ্টি। শরীরের সিস্টেম যদি নষ্ট হয়ে যায় টেবিলের ওপর নানা খাবার থাকলেও তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। সুস্থতা না থাকলে টাকাও কোনো কাজে আসে না। এই করোনাকালে প্রথম দিকে একজন ধনকুবের কথা সবার জানা। কোটি কোটি টাকা তার কোনো কাজে আসেনি। দুই ভাই মিলে এক ভেন্টিলেটরে ছিলেন, শেষ রক্ষা হয়নি। আরেক ধনকুবের সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, চীনের ডাক্তারদের দিয়ে বোর্ড বসিয়েও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। ডাক্তারদের তিনি বলেছিলেন, তার হাজার কোটি টাকা সম্পদের বিনিময়ে হলেও তাকে সুস্থ করতে, কিন্তু তা পারা যায়নি।
চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে খাবার। সহজ ফর্মুলা হচ্ছে, সুপাচ্য সহজ খাবার গ্রহণ করতে হবে। সব খাবারই খাওয়া যাবে, তবে খাবারটা হতে হবে পুষ্টিসম্মত, রুচিসম্মত এবং ধর্মসম্মত। যে মৌসুমে যে শাকসবজি পাওয়া যায়, যে ফলমূল পাওয়া যায় তা এবং মাছ, গোশত, ডিম খেতে হবে। আয়ুর্বেদের সূত্র হচ্ছে, শাকে বাড়ায় মল আর ফলে বাড়ায় বল। মৌসুমি ফলের ব্যাপারে বলা হয়, যে মৌসুমে যে ফল হয় সেই অঞ্চলে সেই মৌসুমের যে রোগ থাকে, সে রোগের প্রতিষেধক থাকে সে ফলে। ফল মানে হচ্ছে দেশজ ফল, আঞ্চলিক ফল এবং মৌসুমি ফল। তাহলেই রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে। পৃথিবীতে যত ফল পাওয়া গেছে বাংলাদেশের কাঁঠাল সবচেয়ে পুষ্টিকর এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। তাই কাঁঠালের সিজনে কাঁঠাল, আমের সিজনে আম। তেমনি কলা, আমড়া, জাম্বুরা, পেয়ারা, আমলকী, জাম, বেল, পেঁপে, কমলা, আনারস অর্থাৎ যে মৌসুমে যে ফল, তা খেতে হবে। শাকসবজির মধ্যে বাঁধাকপি, লালশাক, পুঁইশাক, ডাঁটা শাক, পাটশাক, কচুশাক, কচুর লতি, সজনে পাতা এবং আঁশজাতীয় সবজি বেশি বেশি খেতে হবে। ডিম পুষ্টিদায়ক, ওজনকে নিয়ন্ত্রণ করে। দিনে একটা ডিম খেতে পারলে ভালো। দুই দিন নিরামিষ, দুই দিন ছোট মাছ, দুই দিন বড় মাছ ও এক দিন গোশত তো সবসময় সুষম খাবার। মাছের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছ যত খাওয়া যায়, তত ভালো। গোশত যত বেশি, তত কোলেস্টেরল। চিংড়ি-কাঁকড়ার অনেক পা, কোলেস্টেরল সবচেয়ে বেশি। তারপর খাসি, গরুর চার পা। হাঁস-মুরগির দুই পা। মাছের কোনো পা নেই।
কোলেস্টেরলও নেই। অতিরিক্ত মসলা, তেল-ঝাল, ভাজাপোড়া বর্জন করাই ভালো। প্রতিদিনের খাবার তালিকায় এককোষ রসুন, ২০-৪০টা কালিজিরা, এক গ্লাস দুধ, একটা কলা এবং একটা ডিম রাখা খুবই ভালো পুষ্টিবিদদের মতে। তেমনি রাখতে হবে সবুজ সালাদ এবং টক দই, যাকে ইয়োঘার্ট বলে। চাল একটু কমিয়ে বিকল্প হিসেবে সাথে আলু রাখা যায়। চালের ক্ষেত্রে খোসাসহ চাল খাওয়ার অভ্যাস করলে ভালো। লাল চাল, ঢেঁকিছাটা চাল হলে খুবই ভালো।
চিকিৎসকদের তথ্যানুযায়ী, করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে হিংস্র্র সংক্রমণ হয়েছে সিগারেট, অ্যালকোহল, এনার্জি বা সফট ড্রিংকস এবং প্যাকেট ও টিনজাত খাবার গ্রহণকারীদের ওপর। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমার পেছনে ফাস্টফুড, সফট ড্রিকস, এনার্জি ড্রিংকস এবং ধূমপান ও অ্যালকোহল মারাত্মক ক্ষতিকারক। ফাস্টফুড টেস্টি হওয়ার পেছনে আছে চর্বি বা তেল ব্যবহার। যত বেশি তেল খাবেন তত বেশি তেলতেলে হবেন, ওজন বাড়বে, স্থূলকার হবেন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পাবে। সফট বা এনার্জি ড্রিংকস কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বৈজ্ঞানিক কারণটা হচ্ছে- সফট ড্রিংকস টেস্টি হয় যখন এটা ‘চিলড’ অবস্থায় থাকে। যত ঠাণ্ডা তত স্বাদ। পানি সবচেয়ে ঠাণ্ডা ও ঘন হয় যখন এর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছায়। সফট ড্রিংকস যাতে বরফ না হতে পারে সে জন্য কোম্পানিগুলো একটি অ্যান্টিফ্রিজার কেমিক্যাল ব্যবহার করেÑ ইথিলিন গ্লাইকল। এটা সফট ড্রিংকসের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রিতে নিয়ে স্থির রাখে, আর নামতে দেয় না। এই কেমিক্যাল ইথিলিন গ্লাইকল কিডনির জন্য খুবই ক্ষতিকারক। তাই এগুলো না খেয়ে নিয়মিত ডাব খাওয়া খুব ভালো। ডাবের মধ্যে ১৯টি উপাদান রয়েছে। কচি ডাবের পানি ও রক্তের যে ফ্লুইড, তরল অংশ, একই উপাদানে তৈরি। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ডাব খুব উপকারী।
গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবহার শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষুদ্রান্ত্র দ্বারা। আর ক্ষুদ্রান্ত্রকে সুস্থ রাখতে পারে এরকম তিনটি খাদ্য হলো- আদা, রসুন ও মধু। এ ছাড়াও গ্রিন টি বা সবুজ চা ও ইমিউন সিস্টেম সংহত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। ব্যায়াম বিশেষ করে শ্বাসের ব্যায়াম ফুসফুসের জন্য খুবই জরুরি। করোনার টার্গেট ফুসফুস, সে ক্ষেত্রেও শ্বাসের ব্যায়াম ভালো। প্রতিদিন সকালে অন্তত ২০ মিনিটের মিস্টি রোদ বা সূর্যের কিরণ শরীরে লাগালে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি দূর হয়ে যায়। তাই প্রাকৃতিক খাবার, মৌসুমি ফলমূল, সব বিজ্ঞানসম্মত খাবার এবং নিয়মিত ব্যায়াম একটি কার্যকর ইমিউন সিস্টেম গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সাম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব