শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আরেক রাজাপাকসার প্রত্যাবর্তন
বাসিল রাজাপাকসা - ছবি সংগৃহীত
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রবল বিরোধিতার মধ্যে বৃহস্পতিবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধানের বিতর্কিত ২০তম সংশোধনী পাস হলো। ফলে একটি গুরুতর রাজনৈতিক হুমকি উৎরে যেতে সক্ষম হলেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা। তবে তার সমানে কোভিড-১৯ সংক্রমণের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে আগের মতোই এবং ক্রমেই তা তীব্র হয়ে উঠছে। রাজধানী কলম্বোতেই শত শত আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে।
সব জল্পনা-কল্পনা বাতিল করে দিয়ে ২০এ সংশোধনীর পক্ষে ১৫৬ ভোট পড়ে। ২২৩ আসনের পার্লামেন্টে বিলটি পাস হওয়ার জন্য ১৪৮ ভোটই যথেষ্ঠ ছিলো। যদিও পার্লামেন্টের বিরোধী দলসহ বাইরে প্রভাবশালী বৌদ্ধভিক্ষু ও ক্যাথলিক বিশপ, তামিল ও মুসিলম সংখ্যালঘুদের প্রবল বিরোধিতার কারণে বিলটি পাস হবে কিনা তা নিয়ে সরকার কিছুটা দোটানায় ছিলো। কিন্তু সরকারি জোটের সবাইতো বটেই বিরোধী পক্ষের ৮ জন এমপিও সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা ভোটাভুটির সময় অনুপস্থিত ছিলেন।
২০এ-এর বৈশিষ্ট্য
সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীকে (১৯এ) বাতিল করবে ২০এ। ২০১৫ সালে ১৯এ সংশোধনী গ্রহণ করে আগের ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতৃত্বাধিন সরকার। এতে সরাসরি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খর্ব করে কয়েকটি স্বাধীন কমিশনকে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়। এসব কমিশনে অনির্বাচিত সদস্যদের রাখার বিধান ছিলো। এতে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলো।
২০এ-এর ফলে স্বাধীন সাংবিধানিক কাউন্সিলের জায়গায় অনেক দুর্বল পার্লামেন্টারি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পাবে।
সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ
অসংখ্য আবেদন, আলোচনা, ওয়েবিনার, এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একাংশ এবং সাধারণভাবে জাতীয়তাবাদী ও এসএলপিপি পন্থী ক্যাথলিক চার্চের নেতাদের বিস্ময়কর বিরোধিতার মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ২০ অক্টোবর পার্লামেন্টে পড়ে শোনানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে সংবিধানের কিছু ধারা পরিবর্তনের প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে কিন্তু ২০এ সংশোধনীকে পুরোপুরি নাচক করা হয়নি।
পার্লামেন্টের বাইরে প্রবল বিরোধিতা
২০এ সংশোধনীর বিরুদ্ধে বিরোধিতা হয় শ্রীলংকার সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে। কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং শক্তিশালী সরকার গঠনের পক্ষের লোক থেকে শুরু করে মধ্যমপন্থী অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। শিল্পমন্ত্রী বিমাল বিরাবানসা প্রকাশ্যেই বলেছেন যে, সংশোধনীর বিরুদ্ধে যে সব উদ্বেগের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো শোনা উচিত এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসাকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, ২০এ সংশোধনী যদি বর্তমান সরকারের জন্য ব্যুমেরাং হয়ে আসে, তাহলে এজন্য তিনি দায়ি থাকবেন না।
২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরের দুর্বল সরকারের জায়গায় ২০২০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পরে যখন শক্তিশালী সরকার গঠনের উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, তখনই আতঙ্ক ছড়ালো যে প্রস্তাবিত ২০এ সংশোধনীর মাধ্যমে একজন স্বৈরাচারি প্রেসিডেন্টের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।
সার্বিকভাবে, প্রশ্ন হলো রাজাপাকসা সরকার কি তার জনপ্রিয়তাকে অতিরঞ্জিত ভেবেছে এবং যতটা গিলতে পারবে না, ততটা তারা মুখে নিয়ে ফেলেছে? প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসাকে বিশেষ করে রামান্না ও আমারাপুরা বৌদ্ধ নিকায়াস (বৌদ্ধদের দুটো প্রধান ধারার প্রধান) এবং শক্তিশালী ক্যাথলিক বিশপদের কনফারেন্সের – যারা ৬ শতাংশ ক্যাথলিকদের প্রতিনিধিত্ব করে – বিরোধিতার বিস্ময় ধাক্কা সামলাতে হয়, যারা ২০এ সংশোধনীর বিরোধিতা করেছে।
তবে, আরও কট্টর জাতীয়তাবাদী আসগিরিয়া ও মালওয়াত্তে বৌদ্ধ অংশগুলো নিজেরা অনেক কর্তৃত্বপরায়ন এবং এই সংশোধনী নিয়ে তারা নীরব ছিলো।
২০এ সংশোধনী নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে, যদিও বাস্তবতা হলো ২০২০ আগস্টের পার্লামেন্ট নির্বাচনে এবং ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ একটা শক্তিশালী সরকার গঠনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এর কারণ হলো আগের সরকার ১৯তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এমন অযৌক্তিকভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা হয়েছে এবং উভয়কেই আবার বেশ কিছু স্বাধীন কমিশনের অধীনে রাখা হয়। বিভ্রান্তিকর এই ক্ষমতা ভাগাভাগির কারণে দুই দিক থেকে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত এসেছে এবং এটার কারণে সন্ত্রাসীরা ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল বড় ধরনের বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৬০ জনের বেশি মানুষকে হত্যার সুযোগ পেয়েছে।
জনগণ যেখানে পুরোপুরি কর্তৃত্বশালী সরকার চায় না, সে অবস্থায় এসএলপিপি নেতারা গত সপ্তাহে বৈঠক করে সংশোধনীর ব্যাপারে ধর্মযাজকদের বিরোধিতা ও উদ্বেগ এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা নিয়ে আলোচনা করেন। সরকারের অনেক সিনিয়র সদস্যই মনে করেন যে, ২০এ সংশোধনীতে পরিবর্তনটা একরকম বাধ্যতামূলক পর্যায়ে চলে গেছে।
তামিল অধ্যুষিত উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিএনএ) প্রস্তাবিত ২০এ সংশোধনীর বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেছে। তারা আগেই এই বলে সতর্ক করছে যে, এই বিল পাস হলে প্রেসিডন্সিয়াল রাজতন্ত্র শুরু হবে এবং পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভার উপর প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
এখানে উল্লেখ করার মতো দিক হলো রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও সরব মুসলিম রাজনীতিবিদদের নীরবতা। জাস্টিস মন্ত্রী আলী সাবরি ছাড়া মুসলিম রাজনীতিবিদদের কেউই মুখ খুলছেন না। আলি সাবরি এক হিসেবে আইন সম্পর্কিত মন্ত্রী হিসেবে ২০এ সংশোধনীর জন্য দায়ি, কিন্তু তিনিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মন্তব্য করেননি। মুসলিম রাজনীতিবিদদের এসএলপিপি সরকার দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং সে কারণে তারা ২০এ সংশোধনীর বিরুদ্ধে মন্তব্য করে সরকারের বিরাগভাজন হতে চাচ্ছেন না।
বাসিল রাজাপাকসার প্রত্যাবর্তন
২০এ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টে আরেক রাজাপাকসা ভাইয়ের আগমনে বিষয়টি পোক্ত হলো। তিনি হলেন এসএলপিপি দলের কৌশলবিদ যুক্তরাষ্ট্র-লংকান দ্বৈত নাগরিক বাসিল রাজাপাকসা। ২০এ পাস হওয়ায়, তিনি পার্লামেন্টের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপযুক্ত হলেন এবং মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হবেন তিনি। আগে তিনি অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৫ সালের ১৯এ সংশোধনীতে দ্বৈত নাগরিকদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিষিদ্ধ ছিলো। ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সে জন্য গোতাবায়াকে তার মার্কিন নাগরিকত্ব বাতিল করতে হয়। ভাইয়ের বিজয়ের কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন বাসিল রাজাপাকসা, কিন্তু তিনি নিজে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেননি বা নিজে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
করোনা হুমকি
শ্রীলঙ্কার প্রধান শহরগুলোর উপকণ্ঠ থেকে করোনাভাইরাস মূল শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সূত্র : এসএএম