চীন-মার্কিন বৈরিতার নতুন মাত্রা
চীন-মার্কিন বৈরিতার নতুন মাত্রা - ছবি সংগৃহীত
একবিংশ শতাব্দী শুরু হওয়ার পর থেকে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর হিসেবে সম্ভবত গণ্য হবে ২০২০ সাল। এ সময়ে এক দিকে বৈশ্বিক কর্তৃত্বের লড়াই ঘনীভূত হয়ে উঠেছে, অন্য দিকে বহুলালোচিত কোভিড-১৯ দুনিয়ার আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। দেশে দেশে উত্তেজনা, আন্তঃআঞ্চলিক সঙ্ঘাত ও আন্তঃমহাদেশিক উত্তাপ এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যা ২০২১ সালে বড় আকারের বৈশ্বিক সঙ্ঘাতকে অনিবার্য করে তুলবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
২০২১ সালে বৈশ্বিক পর্যায়ে সঙ্ঘাতের অনেক কেন্দ্র তৈরি হবে বলে মনে হচ্ছে। ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যপ্রাচ্য অব্যাহত থাকবে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের কেন্দ্র হিসেবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্ঘাতের কেন্দ্র কিছুটা বিস্তৃত ও বহুমুখী রূপ নিতে পারে। এর সাথে ককেসাস অঞ্চলেও সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। নাগর্নো-কারাভাখকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে এই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। নতুন করে উত্তেজনা ছড়াতে পারে ক্যারিবীয় ও আশিয়ান অঞ্চলে। তবে সঙ্ঘাতের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চল।
২০২১ সালের সর্বব্যাপী সঙ্ঘাতের লক্ষণীয় প্রস্তুতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন শিবিরে। আমেরিকান শিবিরের এই প্রস্তুতি এক প্রকার আক্রমণাত্মক। সম্ভবত শত্রুকে তার এলাকায় সীমিত করে, আঘাত হানার মাধ্যমে সক্ষমতা নষ্ট করার ঐতিহ্যগত আমেরিকান কর্মপদ্ধতি অনুসৃত হতে যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে। ২০৫০ সাল নাগাদ একক বিশ্ব নিয়ন্ত্রক পরাশক্তি হওয়ার ব্যাপারে চীনের যে উদ্দেশ্য রয়েছে সেটিকে আঘাত করা এর একটি প্রধান লক্ষ্য হতে পারে। তাইওয়ান, সেনাকুক দ্বীপের মালিকানা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাসহ বেশ ক’টি বিরোধের ইস্যু রয়েছে এখানে।
বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তি হওয়ার জন্য কতগুলো অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হয়। এসব গুণগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, যথেষ্ট জনসম্পদ, প্রতিরক্ষা সামর্থ্য ও আদর্শ বা চেতনাগত উদ্বুদ্ধকরণের সক্ষমতা। এর পাশাপাশি মিত্র শক্তিগুলোকে বৃহত্তর অর্থে ছায়া প্রদানের সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব নিয়ন্ত্রক হওয়ার সক্ষমতার অনেক বৈশিষ্ট্য অর্জন ইতোমধ্যে হয়ে গেছে চীনের। আরো কিছু সক্ষমতা অর্জন পর্যায়ে রয়েছে। কিছু বিষয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। অবশ্য কিছু দিককে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এমনটি লক্ষ করা যাচ্ছে না। ২০২০ সাল নাগাদ চীন হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যা ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এটি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে পারে। সার্বিক প্রতিরক্ষা সক্ষমতার বিচারে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরেই এখন চীনের স্থান। যদিও অতি উচ্চ প্রযুক্তির সমরাস্ত্র বিবেচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বেইজিং। আর শিল্প প্রযুক্তি ও উন্নয়নে চীন এখনো বিকাশমান স্তর অতিক্রম করেনি। এ ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইউরোপের মৌলিক প্রযুক্তিনির্ভরতা চীনের রয়ে গেছে। শিল্প ভিত্তি সম্প্রসারণে জীবাষ্ম জ্বালানি ও রেয়ার আর্থ বা মূল্যবান ধাতবের মৌলিক ভূমিকা রয়েছে। জ্বালানি বিষয়ে চীন বহুলাংশে আমদানিনির্ভর। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জীবাষ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কম বেশি থেকে যাবে। চীন এ চাহিদা মেটাতে ইরান ও রাশিয়ার সাথে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করছে। অন্য দিকে ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার সামগ্রী উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ‘মূল্যবান ধাতব’ এর ৮০ শতাংশ চীন সরবরাহ করে বিশ্ব বাজারে। এটি চীনা শিল্পায়নের একটি মৌলিক ভিত্তি।
জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি উৎকর্ষতা ও গবেষণায় চীন এখনো বৈশ্বিক মান থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়। মিত্র দেশগুলোকে ছায়াদানের ক্ষেত্রে চীনা নীতি হলো অনেকখানি ‘সরকার টু সরকার’ সম্পর্ক ধরনের। অর্থাৎ সরকারে গেলে গভীর সম্পর্ক। ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লে সব সম্পর্ক আর বজায় রাখা হয় না। ফলে চীনের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবাদর্শের বলয় এক সময় যে ধরনের ছিল সেটি এখন নেই। এছাড়া পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে অভিবাসনের যে সুযোগ ও প্রক্রিয়া থাকে সেটি চীনের নেই। বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রাপ্তিতে এটিকে চীনের একটি ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
চীনের এই সক্ষমতা ও ঘাটতির মধ্য দিয়েই ২০১৪ সাল থেকে দেশটি পররাষ্ট্র কৌশলে অন্য দেশে হস্তক্ষেপ না করার খোলস থেকে বের হতে শুরু করে। মাও শে তুং উত্তর চীনকে মুক্তবাজার ও বিশ্বায়ন ধারায় নিয়ে গিয়ে দেং জিয়াও পিং অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি ও শক্তি অর্জনের পথে নিয়ে গেছেন। শি জিন পিংয়ের হাতে নেতৃত্ব আসার পর ‘বেল্ট ও রোড’ প্রকল্পের মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রভাব বলয় সৃষ্টির ব্যাপারে বেশ খানিকটা আগ্রাসী ধরনের নীতি কৌশল নিতে শুরু করেছে চীন। আর এই সময়টাতে আমেরিকার নেতৃত্বে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতা। আমেরিকান পররাষ্ট্র কৌশলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার বৈদেশিক নীতির জন্য এক প্রতিপক্ষের প্রয়োজন হয়। একুশ শতকের প্রারম্ভিক সময় থেকে সে প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত ছিল ‘ইসলামিক শক্তি’। হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব ধারণা এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করেছিল। আমেরিকান নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে আন্তর্জাতিকভাবে সেই নীতির প্রয়োগ করা হয়। এর পাশাপাশি রাশিয়াকেও যুক্তরাষ্ট্র এক পর্যায়ে বৈশ্বিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। কিন্তু এখন তাত্ত্বিকভাবেও আমেরিকান প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করা হচ্ছে চীনকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকান তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ভাবনার পরিবর্তন আসতে থাকে। রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশলগত কিছু বোঝাপড়া হয়েছে বলে মনে হয়। যার ফলে গত চার বছর রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাত লক্ষ করা যায়নি। বরং মধ্যপ্রাচ্যে রুশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিপূরক ভূমিকা লক্ষ করা গেছে অন্তরালে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার উপস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রকে তার অবস্থান ত্যাগ করতে দেখা যায়। আর এই সময়টাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে চীন। ট্রাম্প চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করে আমেরিকান বাজারকে চীনা পণ্যের জন্য সঙ্কুচিত করে ফেলেন। চীনে আমেরিকান কোম্পানির বিনিয়োগ অনেকখানি বন্ধ হয়ে যায়। একই সাথে সামরিক সঙ্ঘাতের মেরুকরণ ও জোট গঠন প্রক্রিয়া চলতে থাকে একটি সর্বাত্মক দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতের প্রস্তুতি হিসেবে।
২০২০ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের যে দৃশ্যপট এখন দেখা যাচ্ছে তাতে আমেরিকা চীনকে তার এশীয় অঞ্চলে সীমিত করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ লক্ষে আমেরিকা এশিয়ায় তার মিত্র দেশগুলোকে একই জোটে সংগঠিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো প্যাসিফিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। এর মধ্যে ভারত অস্ট্রেলিয়া জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে নিরাপদ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর গড়ার নামে ‘কোয়াড’ নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছে। এর আওতায় বেশ কয়েক দফা সামরিক মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে।
এর বিপরীতে চীন অপর বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার সাথে একটি কৌশলগত বোঝাপড়া তৈরি করেছে। যার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে আমেরিকান একাধিপত্য খর্ব করা। ইউক্রেনে রাশিয়ান সামরিক হস্তক্ষেপ ও দখলদারিত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়ার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ মস্কোর বেইজিংনির্ভরতা বেশ খানিকটা বাড়িয়েছে। অন্য দিকে প্রভাবশালী বিশ্ব শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা চীনকে রাশিয়ান প্রতিরক্ষা চুক্তি ও সমরাস্ত্রের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী করেছে। আর দু’দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় রাশিয়া জ্বালানির একটি টেকসই বাজার পেয়েছে অন্যদিকে চীন এক ধরনের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে কৌশলগত সহযোগী লাভ করেছে।
চীনবিরোধী আমেরিকান পরিকল্পনার বিষয় বেইজিংয়ের অজানা কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে চীনের চার পাশে বৈরী দেশগুলো নিয়ে একটি বেইজিং বিরোধী বলয় তৈরি করে রাখতে চেয়েছে, সেখানে চীন চেয়েছে একটি এশীয় সহযোগিতা বলয় তৈরি করতে। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা, ব্রিকস, নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক, রোড অ্যান্ড বেল্ট প্রকল্প ইত্যাদি তৈরিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে চীন এশিয়া কেন্দ্রিক একটি সহযোগিতার বলয় তৈরি করতে চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা বলয় নির্মাণ করে সেই বলয়কে অকার্যকর করে দেয়ার প্রচেষ্টা নিয়েছে।
দুই বিদ্যমান ও হবু বিশ্ব শক্তির এই দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত ২০২১ সালকে এক রক্তঝরা বছরে পরিণত করতে পারে। ভারতের সাথে সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে এর মধ্যে দুই দেশের মাঝে বড় আকারের যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চীন নিয়ন্ত্রিত হংকংয়ের অবস্থা বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠছে। তাইওয়ানের আশপাশে দুটি মার্কিন রণতরি নিয়ে এসে দক্ষিণ চীন সাগরে বড় রকমের সঙ্ঘাতের প্রস্তুতির জানান দেয়া হচ্ছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণকে চীনের জীবাণু যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে সর্বাত্মক চীন বিরোধী লড়াইয়ে রূপ দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বকে বিভাজিত করে একটি অংশকে ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বলয়ে ঠেলে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আশপাশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নতুন এক মেরুকরণ তৈরি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ২০২১ সাল নতুন এক পরিস্থিতির অভিমুখ তৈরি করবে বলে মনে হচ্ছে। যার পথ ধরে বিশ্ব পরিস্থিতি নতুন এক ব্যবস্থার দিকেও চলে যেতে পারে। তাতে পরবর্তী বছরগুলোতে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙে নতুন এক ব্যবস্থাও সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হতে পারে।