নাগাদের শান্ত করতে পারছে না ভারত

জয়ন্ত কালিতা | Oct 24, 2020 05:54 pm
নাগাদের শান্ত করতে পারছে না ভারত

নাগাদের শান্ত করতে পারছে না ভারত - ছবি সংগৃহীত

 

ভারত সরকার আর দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠি ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (ইসাক-মুইভাহ) বা এনএসসিএন (আই-এম) এর মধ্যে যে নড়বড়ে শান্তি আলোচনা চলছে, সেটা আগামীতে আরো বড় বাধার মুখে পড়তে যাচ্ছে, কারণ আলাদা পতাকা ও আলাদা সংবিধানের প্রশ্নে বিদ্রোহী গ্রুপটি তাদের দাবিতে আরও অনড় হয়েছে।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক থুইঙ্গালেং মুইভাহ দ্য ওয়্যারের সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “আমরা এই দুটো ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিয়েছি, যেখানে কোনো ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই এবং আমাদের শেষ ব্যক্তিটি জীবিত থাকা পর্যন্ত আমরা এই অবস্থানে অনড় থাকবো”। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন যে, “নাগারা কখনো ভারতীয় ইউনিয়নের অংশ হবে না বা ভারতের সংবিধানকে মেনে নেবে না”।

প্রায় ৪০টি উপজাতি নিয়ে নাগা সম্প্রদায় গঠিত। উত্তরপূর্বাঞ্চরের চারটি রাজ্য – নাগাল্যান্ড, মনিপুর, আসাম ও অরুণাচল প্রদেশ এবং প্রতিবেশী মিয়ানমারের কিছু অংশ জুড়ে তারা ছড়িয়ে আছে।

ভারতের সবচেয়ে পুরনো গেরিলা তৎপরতার একটা স্থায়ী সমাধান খুঁজতেই নাগা শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত এক বছর ধরে এটা অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছে। মুইভার সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার ভালোভাবে নেবে না, কারণ মাত্র গত বছরেই সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নেয়, যার মধ্যে নিজস্ব সংবিধান আর আলাদা পতাকার বিষয়টিও ছিল।

এক ধাপ এগিয়ে, দুই ধাপ পেছানো

এনএসসিএন (আই-এম) ১৯৯৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে অস্ত্রবিরতি চুক্তি করে। তারা বৃহত্তর নাগালিম মাতৃভূমির সাথে নাগা অধ্যুষিত সবগুলো এলাকাকে যুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

কয়েকটি সরকারের সাথে বহু বছরের দর কষাকষির পর বিদ্রোহী গ্রুপটি ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকারের সাথে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করে। সরকার পরে নাগাল্যাণ্ড রাজ্যের বর্তমান গভর্নর আর এন রবিকে শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করে। তবে এনএসসিএন (আই-এম) যখন অন্য আরও আধা ডজন নাগা সংগঠন – যারা সম্মিলিতভাবে নাগা ন্যাশনাল পলিটিক্যাল গ্রুপস (এনএনপিজি) নামে পরিচিত – তাদের সাথে আলোচনা শুরু করে, তখন সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।

চলতি বছরের জুনে পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নেয় যখন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা রবি নাগাল্যাণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেইপিউ রিও’র কাছে একটি কড়া চিঠি দেন, যেখানে তিনি অভিযোগ করেন যে, ‘সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলো’ দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে নির্বাচিত কর্তৃপক্ষের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের মতো করে সরকার পরিচালনা করে যাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে সিস্টেমের মধ্যে তারা ‘আত্মবিশ্বাসের সঙ্কট’ তৈরি করছে।

চিঠিতে যদিও এনএসসিএন (আই-এম) এর নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে এতে বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের বিরুদ্ধে হয়রানি, চাঁদাবাজি, এবং এমন একটা সিস্টেম পরিচালনার অভিযোগ করা হয়েছে, যেটাকে ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ হিসেবে দেখা যায়।

এনএসসিএন (আই-এম) পাল্টা আঘাত হেনে বলেছে, “মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে তার (রবি) ভূমিকা নিয়ে আস্থার সঙ্কট রয়েছে কারণ তিনি বেপরোয়াভাবে নাগা ইস্যুকে খাটো করার চেষ্টা করছেন। তবে নাগাদের মধ্যে যে প্রশ্নটা ঘুরছে, সেটা হলো দীর্ঘদিনের ইন্দো-নাগা রাজনৈতিক ইস্যুর সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী মি নরেন্দ্র মোদি কোন ভুল ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছেন কি না”।

বর্তমান সঙ্কট

এনএসসিএন (আই-এম) আগস্ট মাসে প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের বিস্তারিত প্রকাশ করে। তারা অভিযোগ করেছে যে, রবি মূল দলিল থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি শব্দ বাদ দিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন যে, রবি আসল বাক্য থেকে ‘নতুন’ শব্দটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন, যেটা ছিল, “আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য নতুন অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পর্ক গড়তে এই চুক্তি ভূমিকা রাখবে”।

এনএসসিএন (আই-এম) একই সাথে দাবি জানিয়েছে যাতে রবিকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বাদ দেয়া হয়। বিদ্রোহী গ্রুপটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “ইস্যুটি এখন ভারত সরকারের কোর্টে রয়েছে। ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত) চুক্তিটি এর আসল ফর্মে রেখে এটা নিয়ে কাজ করার জন্য আর এন রবি ছাড়া অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া উচিত”।

সেই সাথে মুইভাহ দাবি করেছেন যাতে আলোচনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে হয় এবং ‘তৃতীয় কোন দেশে’ হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি লেখা এক চিঠি – যেটা চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রকাশ করা হয়, সেখানে বলা হয়েছে, “আমরা আমাদের প্রস্তাবে উল্লেখ করেছি যে, নাগাল্যান্ড তাদের নিজস্ব জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় প্রতীক এবং নিজস্ব সংবিধান ব্যবহার করবে, যেটা ‘ইয়েহজাবো’ নামে পরিচিত”।

নাগাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য রবিকে অভিযুক্ত করে মুইভাহ লিখেছেন, “ভারত সরকারের প্রতিনিধি নাগা সমাজের মধ্যে ঐক্য গড়ার মাধ্যমে একটা সম্মানজনক রাজনৈতিক সমাধানে আসার বদলে বিভক্তি সৃষ্টি করছে”।

এই ধরণের অভিযোগ সত্বেও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রবিকে পরিবর্তনের কোন আগ্রহ সরকার দেখাচ্ছে না, যার অর্থ হলো এনএসসিএন (আই-এম) এর জন্য এটা মেনে নাও অথবা চলে যাও পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

মুইভার সাম্প্রতিক মন্তব্য সম্পর্কে সুইডিশ সাংবাদিক, লেখক ও কৌশলগত বিশ্লেষক বার্তিল লিন্টনার বলেন, তার এই মন্তব্যের ফলে শান্তি প্রক্রিয়া থেকে এনএসসিএন (আই-এম) কে পুরোপুরি বাদ দেয়া হতে পারে।

নাগাল্যান্ডের মনোভাব

লিন্টনার সম্ভবত তার এই পর্যবেক্ষণের জায়গায় সঠিক যে, মোদি সরকার হয়তো তাদের শান্তি চুক্তি থেকে এনএসসিএন (আই-এম) বাদ দিয়ে অন্যান্য নাগা গ্রুপগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যাবে, যারা এরই মধ্যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এমনকি নাগাল্যাণ্ড সরকারও দ্রুততম সময়ে একটা সমাধানের চেষ্টা করছে।

১৫ অক্টোবর নাগাল্যাণ্ড সরকার আর নাগরিক সমাজের গ্রুপগুলোর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়, যেখানে একটি প্রস্তাবনা পাশ করা হয়। সেই প্রস্তাবে নাগা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যাতে তারা ‘কোভন্যান্ট অব রিকনসিলিয়েশানের’ প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং নাগাদের অভিন্ন ভবিষ্যতের স্বার্থে অহিংস নীতি বজায় রাখে।

এই সব ঘটনার ব্যাপারে এনএসসিএন (আই-এম) কি প্রতিক্রিয়া জানায়, সেটা এখনও দেখার বিষয়। নিজেদের দিক থেকে ভারত সরকারকে অবশ্যই উত্তরপূর্বাঞ্চলে কাশ্মীর মডেলের অনুসরণ করা চলবে না। লিন্টনার তার গ্রেট গেম ইস্ট : ইন্ডিয়া, চায়না অ্যাণ্ড দ্য স্ট্রাগল ফর এশিয়া’র মোস্ট ভোলাটাইল ফ্রন্টিয়ার বইয়ে লিখেছেন, উত্তরপূর্বাঞ্চলের মানুষদের জটিল ইতিহাসকে বুঝতে হবে এবং সেগুলো উপলব্ধির মাধ্যমেই এই অঞ্চলের সঙ্ঘাত নিরসনের দিকে যেতে হবে।

সূত্র : দ্য ইরাবতী/এসএএম


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us