ভারতের ইন্ধনে পাকিস্তানে নতুন আন্দোলন!
ইমরান খান, জেনারেল বাজওয়া ও নওয়াজ - ছবি সংগৃহীত
পাকিস্তানে কথিত সেনা-পুলিশ সঙ্ঘাতের ফেক নিউজ করে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া ভারত ছেয়ে ফেলেছে; অনেক সেলিব্রেটি যাদের অ্যাকাউন্ট ভেরিফাইড চিহ্ন লাগানো তারাও সোশ্যাল মিডিয়ায় সেসব ফেক রিপোর্ট কপি করে ছেয়ে ফেলেছেন। এ অবস্থায় ওই ফেক নিউজ প্রসঙ্গে এর বিরুদ্ধে ‘বিবিসি বাংলা’ ও তুরস্কের ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’ এজেন্সি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আলাদা আলাদা রিপোর্ট ছেপেছে।
টিআরটির রিপোর্টের শিরোনাম হলো, ‘ভারতীয় মিডিয়া নির্দয়ভাবে গণউন্মাদনা জাগিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কাল্পনিক গৃহযুদ্ধের খবর প্রচার করছে’। আর বিবিসি বাংলার শিরোনামটা হলো, ‘করাচিতে গৃহযুদ্ধের ভুয়া খবর নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে মাতামাতি’।
তবে এই ফেক নিউজ নিয়ে পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন ঠাট্টা তামাশা বা টিটকারি করা হচ্ছে বলে পাকিস্তানেই পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে তেমনি বিবিসিও কোথায় কিভাবে কারা এই নানান ফেক নিউজ তৈরি করেছে, আর কিভাবে কারা কারা তা প্রচার করেছে এরই এক লম্বা অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে। এটা মূলত বিবিসিরই নিজের যেটা ফেক নিউজ ধরা বা চেক করার বিভাগ আছে, ‘বিবিসির রিয়েলিটি চেক’ এবং ‘বিবিসি মনিটরিং’ নামে, এদেরই মুখ্য তৎপরতা ও সহায়তায় তৈরি করা এক রিপোর্ট। যেমন বিবিসি ঠাট্টা টিটকারি প্রসঙ্গে বলেছে, ‘সিভিল ওয়ার করাচি’, ‘ফেইক নিউজ’ এবং ‘ইন্ডিয়ান মিডিয়া হ্যাশট্যাগে তারা অনেক রঙ্গ রসিকতামূলক পোস্ট এবং মিম শেয়ার করেছে টুইটারে’।
এই ফেক তৎপরতায় ভারতের মিডিয়ায় এমন ব্যক্তিত্বও আছেন যাদের অবস্থান এমন হালকা নয় বরং সিরিয়াস ও পদকজয়ী সম্পাদকও আছেন। অথচ এদেরও ফেক নিউজের প্রতি আগ্রহ এতই তীব্র, কারণ সম্ভবত তারা চীনা সীমান্ত সঙ্ঘাত দেখে হতাশ। তাই তারা চেক না করে নেয়া ফেক নিউজে অংশ নিয়েছেন, নিজেদের পত্রিকার শিরোনাম করেছেন ও ধরা খেয়েছেন। যেমন, বিবিসির এমন তালিকায় আছে ‘সিএনএন-নিউজএইটিন, জি নিউজ এবং ইন্ডিয়া টুডে পর্যন্ত’। অর্থাৎ এরা বিজেপি দলীয় মিডিয়া পারসন নয়, বাইরের।
যেমন, অর্ণব গোস্বামী বা রিপাবলিক টিভির হিন্দি বা মারাঠি ভাষায় প্রচারিত বিজেপি দলীয় মিডিয়া প্রপাগান্ডিস্টরা আছেন, এদের মতো কেউ নয়। যেমন ইন্ডিয়া টুডের সম্পাদক রাজদ্বীপ সরদেশাই; তিনি এটা ছাড়াও আরো অনেক মিডিয়া গ্রুপের সাথে জড়িত সম্পাদক-সমতুল্য পর্যায়ে। তিনি এত খারাপ রেপুটেড লোক নন, বরং নতুন ধরনের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব (সে সময় তার উত্থান হয়েছিল এনডিটিভির সাথেই) হিসেবে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত। অথচ তার নিজের পত্রিকার হেডলাইনেও একই রকম, ‘করাচিতে সিন্ধু-পুলিশ প্রধানকে অপহরণ করা হয়েছে’ ধরনের ফেক রিপোর্ট করেছে। বিবিসি সেটারও এক স্ন্যাপ শট তুলে এনে ছাপিয়েছে ওই রিপোর্টে।
তবু আমাদের আজকের লেখার প্রসঙ্গ ঠিক পাকিস্তান নয়। বরং কেন ভারত সরকার ও তার প্রভাবে এর মিডিয়া এমন প্রচারণা চালাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে? এটা কিসের ইঙ্গিত? আর মূলত কেন এই ইঙ্গিত আমাদের জন্যও ভয়ঙ্কর? আমাদের বেলাতেও এটা ঘটতে পারে কেন?
বিরোধী জোট পিডিএম (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট)
পাকিস্তানে এক বিরোধী জোট তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে, যার আলাদা নামও দেয়া হয়েছে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। এর চেয়েও মজার দিকটা হলো এই জোটের প্রধান বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে মওলানা ফজলুর রহমানকে। আর খুব দ্রুত চলতি মাসজুড়ে চলছে তাদের জনসভা। তাদের এবারকার জনসভার স্টেজে দেখা যাচ্ছে মওলানা ফজলুর দুই পাশে জোটের প্রধান দুই দলের দুই তরুণ প্রতিনিধি- মরিয়ম নওয়াজ শরিফ আর বিলওয়াল ভুট্টো। চিত্রটা ইতিবাচক মনে করা যেত কিন্তু সমস্যা হলো তাদের পিতারা দুর্নীতির দায়ে বিচারে অভিযুক্ত হিসেবে জেলে, সে কারণেই তারা এখানে।
আর এই দুর্নীতির অভিযোগ দুই-এক কোটি নয়, মিলিয়ন ডলার তো বটেই, বিলিয়নে মাপতে হতে পারে। অনুমান করা হয় তা দুই বিলিয়নের বেশি ডলারের। নওয়াজ শরিফ আরো ‘শ্রেষ্ঠ’। তিনি নাম তুলেছেন মানে তা প্রকাশিত হয়েছে ‘পানামা পেপারস’ নামে পরিচিত এক অর্থপাচার কেলেঙ্কারির ডকুমেন্টে। যেটা ‘অফশোর অ্যাকাউন্টে’ যারা টাকা পাচার করে রেখে দিয়েছেন দুনিয়ার এমন প্রায় দুই লাখ লোকের ডকুমেন্টের তালিকা যা এক ভুলের কারণে ফাঁস হয়ে যায়।
মওলানা ফজলুর নেতৃত্বে এটা নওয়াজ ও ভুট্টোর দলসহ ছোটবড় ১১ দলের জোট, যা জন্ম নিয়েছে গত মাসে আর এ মাসের ৩ তারিখে তাকে এর প্রধান বানিয়েছে। এর প্রথম সমাবেশ ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় আর দ্বিতীয়টা ছিল করাচিতে ১৮ অক্টোবর। এখান থেকেই ভারতীয় সংশ্লিষ্টতার ঘটনা সামনে আসতে থাকে।
তবে এর আগেও, মানে গত বছর নভেম্বরে একই রকম সমাবেশ করেছিলেন ফজলু। নওয়াজ ও ভুট্টোর দল বাইরে দাঁড়িয়ে সেসময় সমর্থন দিলেও কেউই তাতে অংশগ্রহণ করেনি। সেখানে মওলানা ফজলু জমায়েত নিয়ে ১৩ দিনের অবস্থান করে রাজধানীতে বসেছিলেন। কিন্তু কোনো দাবি কিছু আদায় করা ছাড়াই তা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল সে সময়ে। ইমরান খান ২০১৮ সালের আগস্টের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। আর তাতে খাইবার-পাখতুন প্রদেশের এক কেন্দ্র থেকে দাঁড়িয়ে ফজলু হেরে যান, ইমরানেরই দলের প্রার্থীর কাছে।
বলা হয়ে থাকে, সেই জেনারেল জিয়াউল হকের (পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ১৯৭৮-৮৮) উত্থানের সময় তার সাথে মওলানা ফজলুর প্রভাবশালী উত্থান ঘটেছিল; বিশেষত ব্লাসফেমি আইন ও দুর্নীতিবিরোধী ইসলামী আইন ইত্যাদি প্রসঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ও প্রভাব খুবই মুখ্য ছিল বলে। সেই থেকে তিনি ‘প্রভাবশালী ইসলামী নেতা’ হিসেবে রাজনীতি করে এসেছেন। ভোটে দাঁড়িয়েছেন পাখতুন প্রদেশ থেকে। জিয়ার আমলে তার মাধ্যমে অসংখ্য মাদ্রাসা খুলে তিনি পরিচালনা করেছেন। তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে সৌদি রাজ-প্রভাব রাখা বা ফেলার এক বড় উপায় হয়ে ওঠেন। অথচ তিনিই ২০১৮ নির্বাচনে নিজ কনস্টিটুয়েন্সি থেকে পরাজিত হয়েছেন। এই ফলাফল দেখে তিনি অপমানিত। তাই তিনি মেনে নিতে পারেননি। সে কারণে এক বছর না যেতেই তিনি ইমরানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন। তবুও মওলানা ফজলুর ২০১৯-এর ওই আন্দোলন আর এবার ২০২০ সালের আন্দোলনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ফারাক আছে।
বিরোধীদের আন্দোলনের মূল দাবি কী?
কম কথায় বললে, তাদের মূল দাবি ২০১৮ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে অথবা আর্মি নির্বাচনের পরিবর্তে ‘সিলেকশন’ করেছে; তাই এটা বাতিল করতে হবে।
ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট, বহু পুরানা (১৯১৬) এক আমেরিকান থিংকট্যাংক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এর এক গবেষক ফেলো হলেন ড. মাদিহা আফজাল। মাদিহা পাকিস্তানি অরিজিনের; লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও ল’-এর গ্রাজুয়েট। পরে আমেরিকান ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি; আর পরে আমেরিকার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দিন অধ্যাপনার পর তিনি এখন ব্রুকিংসের ফেলো। তিনি নিয়মিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় বা ব্রুকিংসের সাইটেই লিখে থাকেন। সেখানে তার বক্তব্য হলো, ‘এখনকার আর্মির অনেকেই নওয়াজকে অপছন্দ করে সত্য কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝির নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের ক্ষমতাসীন হওয়াতেও এই আর্মিই তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বলে অভিযোগ ছিল।’ এ ছাড়া একালে নওয়াজের ভিতর প্রায় খোলাখুলি প্রো-ইন্ডিয়ান হয়ে ওঠার ঝোঁক প্রবল, আমরা দেখছি।
খুবই কম কথায় বললে ঘটনাটা হলো, ১৯৯১-এর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা দুনিয়ার একক নেতা হয়ে যায়। এতে আমেরিকান থিংকট্যাংকগুলো তাদের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের চেপে ধরে যে, দুনিয়ার একলাই নেতা এখন আমেরিকা বলে এইবার তৃতীয় বিশ্বে আমেরিকাকে সামরিক শাসন জারি বা সমর্থন করা তখন থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। ক্লিনটন (প্রেসিডেন্ট ১৯৯৩-২০০১) সে সময়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। আর এখান থেকেই চক্রে পড়ে নওয়াজ মূলত প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে ব্যবসায়ী হিসেবে ভারতের ফাঁদে আটকা পড়েন। ক্লিনটন যেখানে স্বীকার করে নিয়েই শুরু করছেন যে, আমেরিকার ইচ্ছা ও কারণে এত দিন ‘সামরিক শাসন’ এশিয়া চলেছে সেখানে ভারত, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই পাকিস্তানের সামরিক শাসনের মূল কারণ ও সমস্যা বলে পারসু করতে থাকে। এতে ক্লিনটন ব্যাপারটা পাশ কাটিয়ে গেলেও নওয়াজ শরিফ ভারতের লাইনে সামরিক বাহিনীর ওপর রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ এসেছে বলে প্রচার করতে থাকেন। একই সময় ভারত-পাকিস্তান কারগিল যুদ্ধ সীমিত হয়ে শেষ হয়েছিল। এবার নওয়াজ এই যুদ্ধের জন্য ভারতের সহযোগী হয়ে প্ররোচনা করতে থাকেন যে, জেনারেল মোশাররফের কারণে কারগিল যুদ্ধ হয়েছে আর এই দাবি করে তাকে সরাতে এক পরিকল্পনা করেন নওয়াজ।
শ্রীলঙ্কা থেকে জেনারেল মোশাররফ দেশে রওনা হতে চাইছিলেন। কিন্তু তাকে বহনকারী সেই বাণিজ্যিক প্যাসেঞ্জার বিমান পাকিস্তানের কোথাও নামতে দিয়ে এই ফাঁকে নওয়াজ আর্মি চিফ পরিবর্তন করে দেন। কিন্তু এতে আর্মির মধ্যে নওয়াজবিরোধী ক্ষোভ জেগে ওঠাতে আধা ঘণ্টার মধ্যে পালটা ক্ষমতা দখল ও বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তেল ফুরানোর পাঁচ মিনিট আগেই মোশাররফের বিমান আবার পাকিস্তানের রাজধানীতেই অবতরণে সক্ষম হয়। মোশাররফ ক্ষমতাসীন আর নওয়াজ বন্দী হন। এটাই ১৯৯৯ সালের অমেরিকার অনিচ্ছায় পাকিস্তানের সামরিক ক্ষমতা দখল। তাই আমেরিকা মোশাররফের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। এভাবেই চলতে থাকে। পরে ২০০১ সালের ‘নাইন-ইলেভেন’ হামলার দিন নিরুপায় আমেরিকা এই স্বীকৃতি দিয়েছে বলে জানায়। নওয়াজের আসলে স্বার্থ ছিল, ভারতীয়দের সাথে ব্যবসা করা।
নওয়াজ মূল ইত্তেফাক গ্রুপের মালিক ও ব্যবসায়ী। তার ব্যবসা বলতে ভারতীয় পণ্য পাকিস্তানে এনে বিক্রি করে কমিশন খাওয়া। যেমন বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানেও একই আইনে ভারতীয় সিনেমা আমদানি নিষিদ্ধ ছিল। নওয়াজ এটা প্রথম খুলে দিয়েছিলেন। আর ভারতীয় সিনেমা প্রডিউসার মালিকেরা নগদ খদ্দের পেয়েছিলেন। আসলে এমন ব্যবসাপাতির বিরুদ্ধে আর্মিই নওয়াজের ক্ষমতার জন্য প্রধান বাধা বলে অনুভব করাতেই পুরা ব্যাপারটা আর রাজনৈতিক সমস্যা হয়ে থাকেনি। নওয়াজ গংয়ের পেটি ব্যবসায়িক স্বার্থ মুখ্য করে হাজির করাতে ভারতের তাঁবেদারিটাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল যা পাকিস্তানে সে সময় রাজনীতিবিদ (ব্যবসায়ী) বনাম আর্মি এই নামে হাজির হয়েছিল। তবু পাকিস্তান আর্মি আমেরিকার ইচ্ছা মেনে সেই থেকে আর কখনো ক্ষমতা দখল করতে যায়নি। আর না করেও রাজনীতিতে যতটুকু প্রভাব রাখা যায় সে চেষ্টা করে অবশ্য। বলাই বাহুল্য, নওয়াজদের মতো রাজনীতিবিদ থাকলে এই সমস্যার কোনো দিন কোনো সমাধান নেই।
তবে পরিস্থিতিকে ভারতের আধিপত্যে নেয়ার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য আমেরিকানদের লোভের স্বার্থ মূলত দায়ী। আমেরিকার আগ্রহ ভারতের বাণিজ্য, বাজার, অস্ত্র বিক্রি ইত্যাদির ওপর যেটা ভারত পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলার পর থেকে প্রায় বাণিজ্য সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ভারত তা আমেরিকাকে দেয়ার এক পূর্বশর্ত হিসেবে উল্টো পাকিস্তানের বাজার ভারতকে পাইয়ে দিতে যেন আমেরিকা সাহায্য করে এই শর্ত দিয়েছিল। আর এই ভারত-আমেরিকান স্বার্থের মধ্যে পড়ে পাকিস্তানের ভাগ্য হারিয়ে গিয়েছিল। আজ সেসব পুরনো পাকিস্তানবিরোধী পরিকল্পনা আবার সামনে আসছে, একটু একটু করে। তার আগে মাদিহার বাকি কথা শেষ করে নেই।
মাদিহা এবার তার কথা শেষ করতে সরাসরি ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে চলে যান। তিনি বলেন, এখানে ‘অস্বীকার করা কঠিন’ এমন দুটা ফ্যাক্টস আছে। প্রথমত নির্বাচন কমিশনের ম্যানেজমেন্ট ফেইলিওর বা অযোগ্যতাটা ছিল মারাত্মক। সারা দিন ভোট প্রদানের সময় কোথাও কোনো বড় অভিযোগ ছিল না, ওঠেনি। কোনো ভোট গণনার শুরুতে তা আরো দেরি হওয়াতে মানুষের সন্দেহ বাড়তে থাকে। কারণ কমিশনের সফটওয়ার ফেল করেছিল। মাদিহার দ্বিতীয় পয়েন্টটা অনেক শক্ত। তিনি বলছেন, বিদেশী পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিল ইইউ-এর অবজারভার, এক বড় টিম। তাদের রিপোর্ট হলো, নির্বাচন মোটা দাগে ‘ইতিবাচক’ হয়েছে।
এছাড়া যে প্রসঙ্গ মাদিহা আনেননি তা হলো, আসলে যেখানে আর্মির প্রভাব ছিল, তা হুবহু নওয়াজের দলের পুরনো এমপিকে দুর্নীতির দায়ে আদালতের মাধ্যমে অযোগ্য ঘোষণা করে দেয়া হয়েছিল। এই কাজে পরোক্ষে আর্মির হাত ছিল মনে করা হয়। এ কথা অবজারভারেরাও বলেছিল। এর মূল কারণ, ওই ইসলামী দুর্নীতির আইন। এটা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আদালতকে যথেচ্ছ অধিকার দেয়া আছে। এক রায়ের শেষে বিচারকের এমন মন্তব্য আছে যে, আমাদের এমন ক্ষমতা দিলে তো এটা হবেই। আর সেটা ব্যবহার করাতেই নওয়াজের দলের বহু প্রার্থী অযোগ্য হয়ে যায়। তবে মূলত তাদের সফটওয়ার ফেল করার কারণে ফলাফল দিতে দেরি হয়েছে। আর এ থেকেই প্রচারণার শুরু।
এখন শেষে মূল যে কথাটা তা হলো, বিরোধী দলের এই আন্দোলন শুরু হলে পরে কেন ইমরান আলজাজিরাকে বলছেন যে, এই আন্দোলনে নওয়াজ শরিফ ‘ভারতের খেলা খেলতে নেমেছেন’! প্রথমত এটা কথার কথা কোনো অভিযোগ বা কমন রাজনৈতিক দল একে অপরকে যেভাবে ও অর্থে যেমন বলে থাকে সেই সাধারণ অর্থ বলা কোনো কথা নয়। এর সুদূরপ্রসারী অর্থ আছে। কী সেটা?
দুনিয়ার এই সময়টা এখন পালাবদলের। গ্লোবাল নেতা বা নেতৃত্বের পালাবদল- আমেরিকার বদলে চীনের নেতৃত্ব নেয়ার পালাবদল। আমেরিকা জানে, এই পরিবর্তন অনিবার্য। তা জেনেও যত তাতে দেরি করিয়ে দেয়া যায় এই লক্ষ্যে আমেরিকা খড়কুটোও আঁকড়ে ধরতে চাইছে। আর তা থেকেই যাবতীয় নতুন সমস্যা।
আর এ কাজে আমেরিকার চেয়েও অনুসারী সাগরেদ ভারত আরো কূটাশ্রয়ী হতে চাইছে। তাই ভারত চাইছে, একটা গ্লোবাল পোলারাইজেশনের মধ্যে পাকিস্তানকে ফেলে দিতে। মওলানা ফজলু মানে সৌদি লবি বা প্রভাব। ভারত এটাকে উপরে আমেরিকা, মাঝে সৌদি আর নিচে ভারত এভাবে পোলারাইজেশন টানতে চাইছে। যেন পাকিস্তানে আমেরিকা-চায় না পোলারাইজেশনটা পাকিস্তানের দলভিত্তিক হয়ে যাক। যেমন ইমরান একদিকে আর তিনটা দল অন্য দিকে- ভারত-চীন পোলারাইজেশনের দুই ভাগ এমন হোক। এতে ভারত নওয়াজকে পুরনো ১৯৯৯ সালের কথা ও অ্যালায়েন্সের কথা, ব্যবসায়িক সুবিধার কথা মনে করিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আর নওয়াজের অবস্থা হলো যাকে দুর্নীতির দায়ে বাকি জীবন জেলে থাকার কথা কারণ তার তো সাজার রায় হয়ে গেছে তাই, তার কাছে পাকিস্তান ভারতের অধীনে গেলেইবা কী? যদি তাতে নওয়াজ খালাস পেয়ে যাওয়ার উপায় পাওয়া যায়?এ কারণেই ভারতের গৃহযুদ্ধের প্রপাগান্ডা নওয়াজের সাথে ভারতের আঁতাত কত গভীরে চলে গেছে এরই প্রকাশ।
কিন্তু মূল কথা- একটা দেশের জন্য এই সময়ে সবচেয়ে খারাপ হবে যদি ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা চীন বা আমেরিকান এই ভিত্তিতে দেশের দলগুলো একেকটার এজেন্ট হয়ে ভাগ হয়ে যায়। পাকিস্তানের ভাগ্যে সেই বিপদ ঘটতে যাচ্ছে।
আর এটাই আমাদের জন্যও কী কোনো ইঙ্গিত যে, আমাদের ভাগ্যেও না এমন পরিণতি কোনো ফাঁক-ফুটা দিয়ে এসে যায়!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com