কী লেখা আছে ধর্ষণ আইনে?

কী লেখা আছে ধর্ষণ আইনে? - ছবি : সংগৃহীত
প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন রাত্রিকালীন নির্বাচনের নতুন সংস্কৃতি আমাদের নৈতিক অবক্ষয়কে ধসিয়ে দিয়েছে। মহামারী করোনার মধ্যে ‘ধর্ষণ’ মহামারীতে গোটা জাতি আজ বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্ত, নিরাপত্তাহীন। অভাব অনটনে থাকা পরিবারগুলো তো বটেই, অধিকন্তু সব শ্রেণী ও সব বয়সের নারীসমাজ আজ মানুষরূপী পশুদের লালসার শিকার। গণধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সংগঠনগুলো আন্দোলন করে যাচ্ছে, তাদের অন্যতম দাবি- ধর্ষকদের ফাঁসি দিতে হবে। যারা ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই সরকারি দলের স্থানীয় পর্যায়ের হোমরা চোমরা। জনগণের সেন্টিমেন্ট আঁচ করতে পেরে আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ‘ফাঁসি’ নির্ধারণ করে রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্স জারি করেছেন। ইতোমধ্যে ১৫ অক্টোবর ২০২০ মাদরাসার ছাত্রীকে অপহরণ করে গণধর্ষণের মামলায় টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক খালেদা ইয়াসমিন পাঁচ ধর্ষককে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন।
যারা গণধর্ষণ করে এবং ধর্ষিতার নগ্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে তারা মানুষের আকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও রুচি এবং অবস্থানগত দিক থেকে তাদের সাথে পশুর অমিল নেই। একজন মানুষ কতটুকু অসভ্য, নোংরা ও পশু হলে দলবেঁধে একজন নারীকে ভোগ করে তার উলঙ্গ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারে (!) এ পশুদের ফাঁসি হলে কারো কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়, এমন কি যে পিতা-মাতা ধর্ষককে জন্ম দিয়েছে তাদেরও মনে কোনো প্রকার কষ্ট বা আপত্তি থাকা উচিত নয়। কারণ ধর্ষকের পিতা-মাতা সমাজে একা নয়, তাদেরও মা, বোন, কন্যা প্রভৃতি রয়েছে। পাশবিকতার শাস্তি পাশবিকতার মতোই হওয়া বাঞ্ছনীয়। ফলে গণধর্ষকদের ফাঁসির শাস্তি হওয়াই অনেকের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং এর ভাইরাল হওয়া ছবি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া রোধ করার জন্য ফাঁসিই কি একমাত্র সমাধান?
আইন প্রণয়নের ক্ষমতা যদিও জাতীয় সংসদের এখতিয়ার, তথাপি সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৩(১) মোতাবেক “সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনক প্রতীয়মান হওয়ায় মন্ত্রিপরিষদের সুপারিশ মতে, ১৩ অক্টোবর ২০২০ অর্ডিন্যান্স নং-০৪/২০২০ জারি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯ নং ধারা সংশোধন করত ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শাস্তির পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড’ বা ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে’ দণ্ডিত” করার বিধান জারি করেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংগঠিত ধর্ষণ বা গণধর্ষণ বা ধর্ষণের ছবি প্রকাশের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞাকেই নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-
‘যে ব্যক্তি, অতঃপর ব্যতিক্রম ক্ষেত্র ব্যতিরেকে নিম্নোক্ত পাঁচ প্রকার বর্ণনাধীন যেকোনো অবস্থায় কোনো নারীর সহিত যৌন সহবাস করে, সেই ব্যক্তি নারী ধর্ষণ করে বলিয়া গণ্য হইবে।’
প্রথমত, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত, তার সম্মতি ব্যতিরেকে, তৃতীয়ত, তার সম্মতিক্রমে, যে ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে তার সম্মতি আদায় করা হয়; চতুর্থত, তার সম্মতিক্রমে, যে ক্ষেত্রে লোকটি জানে যে সে তার স্বামী নয় এবং সে (নারীটি) এই বিশ্বাসে সম্মতি দান করে যে, সে (পুরুষটি) এমন কোনো লোক যার সাথে সে আইনানুগভাবে বিবাহিত অথবা সে নিজেকে তার সাথে আইনানুগভাবে বিবাহিত বলিয়া বিশ্বাস করে; পঞ্চমত, তার সম্মতি সহকারে বা ব্যতিরেকে, যে ক্ষেত্রে সে ১৪ বছরের কম বয়স্কা হয়।
ব্যাখ্যা : অনুপ্রবেশই নারী ধর্ষণের অপরাধরূপে গণ্য হওয়ার যোগ্য যৌন-সহবাস অনুষ্ঠানের নিমিত্ত যথেষ্ট বিবেচিত হইবে।
ব্যতিক্রম : কোনো পুরুষ কর্তৃক তার স্ত্রীর সাথে যৌন-সহবাস স্ত্রীর বয়স ১৩ বছরের কম না হইলে নারী ধর্ষণ বলে গণ্য হইবে না। বেশ্যাবৃত্তি পৃথিবীর আদি ব্যবসা। এই ব্যবসায় নারীসমাজ পুরুষ কর্তৃক ভিকটিম। ভিকটিম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বহু নারীবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে এবং ফ্যামিনিজম নামে একটি মতবাদ পৃথিবীতে চালু আছে। তারা পুরুষ কর্তৃত্ব চায় না। কিন্তু পৃথিবীকে সুন্দর ও সার্থক করার জন্য নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া সম্ভব কি? এ নিয়ে আলোচনা করলে আলোচনা শেষ হবে না, বরং যুক্তির পর যুক্তি চলতে থাকবে। সার্বিক পর্যালোচনাক্রমে বর্তমানে কেন ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা নিখুঁতভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
ধর্ষকের শাস্তি ফাঁসির আইন হওয়া সত্ত্বে¡ও ধর্ষণ ও গণধর্ষণ থেমে নেই। এর কারণ কী? রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই রাষ্ট্রের পাঁচমিশালি ভূমিকা গ্রহণ করায় সরকার কোনো বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ভূমিকায় সফল হতে পারছে না। দেশের অভ্যন্তরীণ সব অবস্থা, বিপর্যয় প্রভৃতির বিরুদ্ধে সরকার বিএনপি/জামায়াত ও বিরোধী দলকে দোষারূপ করলেও বিএনপি/জামায়াতের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারেনি। ধর্ষণ বা গণধর্ষণের যত অভিযোগ এখন সরকারি দলের হোমরা চোমরাদের বিরুদ্ধে। এ মর্মে প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তার দলীয় লোকরা যেমন থেকে নেই, তেমনি থেমে নেই বিভিন্ন শ্রেণীর বয়সের পাষণ্ড ধর্ষকরা।
ধর্ষকদের মধ্যে সব বয়সের পুরুষই রয়েছে। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোই এখন যৌন সুড়সুড়ি দেয়ার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সব বয়সের ছেলেমেয়ের হাতে এখন মোবাইল। মোবাইল টিপাটিপিতেই তারা এখন মহাব্যস্ত এবং দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে চলমান চলচ্চিত্র সংস্কৃতি (সিনেমা/নাটক প্রভৃতি), বিশেষ করে আকাশ সংস্কৃতির কুফল আজ সমাজে বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতি ও নৈতিকতাই মানুষের পশুত্বকে দমন করতে পারে, অন্য দিকে রয়েছে পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি। ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ফাঁসির আইন পাস করা সত্ত্বে¡ও ধর্ষণ রোধ হয়নি বলেই প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়। তবে সময়ই এর প্রতিফল বলে দেবে। কিন্তু ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগের যে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে তা প্রতিরোধের জন্যও আইনে একটি সুস্পষ্ট বিধান থাকা দরকার। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, দমানোর জন্য স্বামী তার নিজ স্ত্রীকে বাদি করে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করেছে। কোথাও কোথাও ধর্ষণের মিথ্যা আসামি দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি হাইকোর্ট একটি রায়ে মেডিক্যাল রিপোর্টের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে পারিপার্র্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বিচারিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। বিষয়টি অনেক অনুধাবনের দাবি রাখে। আমাদের দেশে যেভাবে মিথ্যা মামলা হয় এবং ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে সাজানো হয়, সে বিষয়টি বিবেচনায় মেডিক্যাল রিপোর্টের গুরুত্ব উড়িয়ে দেয়া যায় না। গত ৯ অক্টোবর ২০২০ বরিশালের বাকেরগঞ্জে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো চার শিশুকে হাইকোর্টের নির্দেশে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায়, ধর্ষণ মামলার সাজা যেমন কঠিন হওয়া আবশ্যক, ঠিক তেমনি ধর্ষক চিহ্নিত করার পদ্ধতিও খুবই সতর্কতার সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। নতুবা নির্দোষ ব্যক্তিরও কঠিন শাস্তি হওয়ার একটি সুযোগ থাকে। অন্য দিকে, কোনো পুরুষ কোনো মহিলার প্রতারণার শিকার হয়ে পড়ে কি না তা-ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখন রাষ্ট্রীয় অনাচার বৃদ্ধি পায়, তখনই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সামাজিক অনাচারগুলো বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে গণমানুষের কণ্ঠ এখন রোধ করে দেয়া হচ্ছে। চলছে একদলীয় শাসনব্যবস্থা এবং একপেশে স্বাধীনতা। যারা সরকারি দল আইন তাদের সহজে স্পর্শ করতে পারে না। সার্বিক অবস্থায় মনে হয়, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যেন কিছু লোকের পকেটস্থ হয়ে পড়েছে। বিত্তবানরা বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প গড়ার নামে বিত্তহীনদের জমি দখল করে নিচ্ছে, সরকার পরিবেশ দফতরের অনুমতি ছাড়া প্রকল্প গড়ে তুলছে, জনগণ বাধা দিলে তাদের পুলিশ দিয়ে নানাবিধ হয়রানি করা হচ্ছে।
সরকারি দলের এমপিরা প্রতিটি উপজেলায় দেশী-বিদেশী অস্ত্রের সমন্বয়ে একটি বাহিনী গঠন করেছে। জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, এমপি বাহিনীর লোকেরা ধর্ষণের দায়ে ধরা পড়েছে। ফলে ধর্ষকের ঘটনা প্রকাশ পেলেই মীমাংসার নামে ঘটনাটির ধামাচাপা দেয়া হয়। এতে পুলিশকে নীরব রাখতে এমপির ভূমিকা যথেষ্ট প্রভাবান্বিত করে। এ কারণেই ধর্ষণের মোকদ্দমা আপস করাকে কেন বেআইনি ঘোষণাসহ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে না মর্মে জানতে চেয়ে হাইকোর্ট সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন।
সার্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতীয়মান হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের হাতের মুঠোয় গোটা সমাজব্যবস্থা আজ বন্দী। এই বন্দিত্বে ভিকটিম অসহায় মানুষগুলো ক্ষমতার আশপাশে যেতে পারে না। ক্ষমতাসীনরা নারীদেহ লুটসহ সব কিছুই অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার লুট করতে আইন বা সামাজিক সংস্কৃতিকে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধক মনে করছে না। অন্য দিকে, সাধারণ মানুষ ক্ষমতাসীনদের লোক দেখানো তুষ্ট করতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করলেও এর পেছনে যে বিষের আগুন জ্বলে তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারে না।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com