ব্লাসফেমি : মুসলিমদের দায়িত্ব ও বিশ্ব সম্প্রদায়
ব্লাসফেমি : মুসলিমদের দায়িত্ব ও বিশ্ব সম্প্রদায় - ছবি : সংগৃহীত
ফ্রান্সের প্যারিসে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর কার্টুন প্রদর্শন করা একজন শিক্ষক সম্প্রতি নিহত হয়েছেন। ওই শিক্ষক ক্লাস চলাকালীন তার ক্লাসে ওই কার্টুন দেখিয়েছিলেন। এরপর ১৮ বছর বয়সী এক যুবক ওই শিক্ষককে হত্যা করেছে। এর জবাবে, হত্যাকারীকেও পুলিশ মেরে ফেলছে। হত্যাকারী যা করেছিল তার শাস্তি সে ওই সময়েই পেয়েছিল। কিন্তু এরপরে যা ঘটছে, তাকে রাজনীতিই বলা যেতে পারে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমমানুয়েল ম্যাক্রো বলেছেন, ইসলামী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের লড়াই অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে শিক্ষক হত্যা হয়েছে তাতে কোনো শক্তি নেই।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে, যে বিশ্বে কেবলমাত্র মুসলিম নয় বরং লাখ লাখ অমুসলিমেরও শ্রদ্ধেয় নবী (সা.)-এর কার্টুন দেখানো ব্যক্তি কীভাবে শিক্ষক হতে পারে? যদিও মৃত ব্যক্তির সাথে যা ঘটেছিল তা ভুল ছিল, এমনটি হওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে ওই ব্যক্তি যা করেছে তা সঠিক ছিল। এই হত্যাকে যেমন ন্যায়সঙ্গত বলা যায় না, তেমনি নবী (সা.)-এর কার্টুন বানানো বা দেখানোও ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। নবী (সা)-এর কোনো ছবি নেই, কোনো মূর্তি নেই, কোনো আকৃতি নেই, তাহলে তাঁর কার্টুন বানানো সঠিক কীভাবে হতে পারে? কিন্তু এই সত্যটি জানার পরও এই জাতীয় বিতর্কিত এবং অমর্যাদাকর কাজ করা হচ্ছে। যার স্পষ্ট বার্তাটি হ'ল যারা এটি করেন তাদের বিশ্বের ১.৮ বিলিয়ন জনসংখ্যার ধর্মীয় অনুভূতি সম্পর্কে কোনো চিন্তা নেই, অথবা এই কাজগুলো তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়।
মুসলমানদের এ বিষয়টি বুঝতে হবে, যদি কেউ নবী (সা.) শানে ধৃষ্টতা দেখিয়ে তার মস্তিষ্কের দেউলিয়াপনার প্রমাণ দেয় তাহলে মুসলিমদের সংযম রেখে কাজ করতে হবে। এই ধরণের ঘটনার জন্য মুসলমানদের তিনটি উপায় রয়েছে। প্রথম উপায়টি হলো- সেই যুবকের কাছে গিয়ে তাকে জানানো, সে যা করেছে তার অনুমতি নেই সে যে ধর্মের অনুসারী। দ্বিতীয় উপায়টি হলো- ওই যুবককে নবী (সা)-এর জীবনী, শিক্ষা, হাদিসগুলো জানানো, নবী (সা.)-এর চরিত্র কী ছিল তা তাকে জানানো। তৃতীয় উপায় হলো- তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে এই জাতীয় ঘটনার পরে এই তিনটি পথের কোনোটিই গ্রহণ করা হয় না। বরং চতুর্থ পদ্ধতি- সহিংসতার পথ অবলম্বন করা হয়। এবং এভাবে কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া ব্যক্তির সাথে গোটা বিশ্বের 'সহানুভূতি' যুক্ত হয়। এরপরে ন্যারেটিভ সেট শুরু হয়, এমনকি 'বুদ্ধিজীবী' যারা নিজেকে উদারপন্থী বলে থাকেন, তারা বলতে শুরু করেন যে, মানুষের জীবন কোনো নবীর শানের চেয়ে বড় কিছু নয়।
সম্প্রতি ভারতের কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতেও একই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল, একজন বিধায়কের ভাতিজা নবী (সা.) সম্পর্কে অমর্যাদাকর মন্তব্য করেছিল, যাতে ক্ষুব্ধ লোকেরা সেই পথ অবলম্বন করেছিল যা গ্রহণ করা উচিত হয়নি। এবং বিষয়টি আবারো সহিংসতার মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছিল। কর্ণাটক পুলিশ তিন যুবককে গুলি করে হত্যা করেছিল। নিহতদের জন্য সহানুভূতিও দেখানো হয়নি, পুলিশকেও অভিযুক্ত করা হয়নি এবং বিপরীতে, বিক্ষোভকারীদের অভিযুক্ত করা হয় যে তারাই সহিংসতা করেছিল। কিন্তু এই সহিংসতার কোলাহলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে যে ব্যক্তি সহিংসতার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল তার জবাব কারো কাছে নেই।
আবারো ফ্রান্স প্রসঙ্গে আসা যাক। ফ্রান্সের প্যারিসে ওই ঘটনা হওয়ার পরে, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ঘটনাস্থলে পৌঁছে এই ঘটনাটিকে ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রো ডানপন্থী দলের নেতা। তিনি ওই ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে বর্ণনা করতে ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তিনি কী বলতে পারেন যে কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে উপহাস করা সন্ত্রাসবাদ নয়? কার্টুন দেখানো ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড যদি ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ হয় তবে কোটি কোটি মানুষের পরম শ্রদ্ধেয় নবী (সা.)-এর কার্টুনও সেখানে রয়েছে। একে বৌদ্ধিক সন্ত্রাসবাদ বলা যেতে পারে। কিন্তু এটাকে সন্ত্রাস বলা হবে না বা একে সন্ত্রাসবাদ বলা হচ্ছে না। বিদ্বেষপূর্ণ বাকস্বাধীনতার কথাকে 'বাকস্বাধীনতা' বলা হবে এবং নাম দেয়া হবে 'সৃজনশীলতা'।
কোনো মুসলিম কী কখনো খ্রিস্টধর্মের শ্রদ্ধেয় হযরত ঈসা (আ.)-এর কার্টুন বানিয়েছেন? কোনো অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন? কোনো মুসলিম কী কখনো ইহুদিদের শ্রদ্ধেয় হযরত মুসা (আ.)-এর কার্টুন করেছেন? কোনো অমর্যাদাকর মন্তব্য করেছেন? করেননি। এটি এজন্য ঘটেনি কারণ ইসলাম অনুসারে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধেয় হযরত ঈসা (আ.), ইহুদিদের শ্রদ্ধেয় হযরত মুসা (আ.) হলেন নবী। এ কারণেই কোনো মুসলিম নবীদের শানে কৌতুক সম্পর্কে ভাবতেও পারে না।
কিন্তু ডেনমার্ক থেকে শুরু করে ফ্রান্স পর্যন্ত বারবার মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে উপহাস করা হয়। কখনো শার্লি এবদো, কখনো কার্টুনিস্ট দ্বারা, কখনো কোনো কথিত শিক্ষক দ্বারা প্রিয় নবী মুহাম্মাদ(সা)-এর কার্টুন দেখিয়ে বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর (মুসলিম) ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলা করা হয়। এগুলো সবই বৌদ্ধিক সন্ত্রাসবাদের শ্রেণির অন্তর্গত। বিশ্ব যদি সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটাতে চায় তাহলে সবধরণের সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটাতে হবে।
সূত্র : পুবের কলম