ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হালফ্যাশনের পাগলামো
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী - ছবি সংগৃহীত
করোনাকালের জুলাই মাসে আমি এক হৃদয়বিদারক মছিবতের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বাসায় মায়া নামক জনৈকা মধ্যবয়সী মহিলা বছরখানেক ধরে ছুটা বুয়া হিসেবে কাজ করছিলেন। মায়া আমাদের বিল্ডিংয়ের আরো পাঁচ বাসায় কাজ করেন এবং একটি বাসায় রাত যাপন করেন। আমরা যে ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকি সে বাড়ির আদি বাসিন্দা অর্থাৎ জমির মালিক মায়াদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এ জন্য পুরো বিল্ডিংয়ে মায়ার দাপট অনেকটা বাড়িওয়ালিদের মতো। ইতোপূর্বে তার দুইবার বিয়ে হয়েছে- কিন্তু স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ার জন্য সে এখন একা থাকে। মায়া অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং মুখরা প্রকৃতির রমণী। ফলে কাজের জন্য সবাই মায়াকে পছন্দ করে কিন্তু তার মুখরা স্বভাবের জন্য লোকজন তাকে ঘাঁটাতে চায় না।
আমাদের বাসায় মায়া রোজ সকাল ৮টায় আসে এবং ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে তার কাজ শেষ করে অন্য ফ্ল্যাটে চলে যায়। সে যতক্ষণ আমাদের সাথে থাকে ততক্ষণ অনবরত কথা বলতে থাকে। আমার স্ত্রীর প্রধান দায়িত্ব হলো মায়ার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং প্রতিটি কথায় সায় দেয়া। অর্থাৎ মায়া যদি কাউকে খারাপ বলে তবে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সেটাতে সমর্থন জানাতে হবে এবং মায়ার প্রিয়জনদের ব্যাপারে সর্বদা প্রশংসাসূচক কথা বলতে হবে। মায়াকে সচল রাখার জন্য আমার স্ত্রী গত একটি বছর যাবৎ যে দক্ষতা লাভ করেছে তা দেখে অন্যান্য যেসব ফ্ল্যাটে মায়া কাজ করে সেসব ফ্ল্যাটের ভাবীরা রীতিমতো হতবাক হয়ে যান। তারা যদি কোনো বিষয়ে মায়াকে ম্যানেজ করতে প্রয়োজন অনুভব করেন তবে তারা সরাসরি মায়াকে কিছু না বলে আমার স্ত্রীকে বলে থাকেন। এ নিয়ে আমার স্ত্রীর গর্বের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। সে প্রায়ই মায়ার প্রসঙ্গ তুলে আমাকে খোটা দেয়ার চেষ্টা করে। বলে, আমার চেয়ে তার ম্যানেজারিয়াল এবং ম্যানেজমেন্ট ক্ষমতা অনেক বেশি।
আমার স্ত্রীর সাথে মায়ার সখ্যকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং দিন শেষে ঘরে ফিরে হররোজ মায়া কাহিনী শুনে বুঝতে পারি আমাদের বিল্ডিংয়ের চব্বিশটি ফ্ল্যাটের কোন কোণায় কী ঘটেছে। করোনার সময়টিতে অনেক বাসায় মায়ার প্রবেশ নিষেধ থাকলেও আমাদের বাসা ছিল তার জন্য অবারিত। এরই মধ্যে হঠাৎ শুনলাম, মায়ার অসুখ হয়েছে। সে যে বাসায় রাত যাপন করত সেই বাসার প্রায় সবাই করোনা আক্রান্ত হলো এবং পরিবারের কর্তা করোনায় মারা গেলেন। ফলে সেই পরিবারের লোকজন নিজেদের পাশাপাশি মায়াকেও গৃহবন্দী করে রাখল। মায়া ইন্টারকমে বারবার আমার স্ত্রীকে ফোন করে কান্নাকাটি শুরু করল। মায়ার দাবি তার করোনা হয়নি। তার পেটে আগে থেকেই মস্তবড় একটা টিউমার ছিল। টাকার অভাবে সেটির অপারেশন করানো হয়নি। টিউমারটি মায়াকে অসহ্য কষ্ট দিচ্ছিল এবং তার আশঙ্কা হচ্ছিল যে, দু-এক দিনের মধ্যে অপারেশন করা না গেলে সে মারা যাবে।
মায়াকে কোনো একটি হাসপাতালে ভর্তি করে অপারেশন করিয়ে আনার জন্য আমার স্ত্রী আমাকে বারবার তাগাদা দিতে লাগল। আমি রাজধানীর বড় বড় প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে কথা বললাম। সবাই প্রায় একই কথা বলল, অর্থাৎ করোনার এই সময়ে তারা মহিলাদের ডেলিভারিসংক্রান্ত অপারেশন ছাড়া অন্য কোনো রোগীর অপারেশন করছে না। এমন সময় আমার হঠাৎ মনে পড়ল ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের কথা। স্ত্রীকে বললাম, মায়াকে নিয়ে সোজা ওই হাসপাতালে চলে যাওয়ার জন্য। আমার বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশের কোথাও মায়াদের স্থান না হলেও গণস্বাস্থ্যের হাসপাতালে ঠিকই ঠাঁই হবে। আমার স্ত্রী মায়াকে নিয়ে সেই করোনার মধ্যে যখন বের হওয়ার উদ্যোগ নিলো তখন রাজ্যের বাধাবিপত্তি দেখা দিলো। কিন্তু মায়ার অতি চিৎকার এবং আমার স্ত্রীর দৃঢ়তার সামনে কোনো বাধাই টিকল না। তারা যখন হাসপাতালে পৌঁছালো তখন আমার স্ত্রীর পরিচিত একজন কর্মকর্তা সব রকম সহযোগিতা করলেন। ফলে মায়ার চিকিৎসার বিষয়ে আমাকে আর কষ্ট করে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ফোন করতে হলো না।
মায়া মোট ১৫ দিনের মতো হাসপাতালে ছিল। অপারেশনসহ অন্যান্য খয়-খরচা মিলিয়ে তার সাকুল্যে ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। মায়ার মুখে আমি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সম্পর্কে যা শুনলাম তা রীতিমতো বিস্ময়কর। মায়া জানাল যে, একজন সাদা চুলের বুইড়া মানুষ প্রতিদিন সকালে একা একা প্রতিটি রোগীর কাছে আসত আর জিজ্ঞাসা করত তাদের কোনো অসুবিধা আছে নাকি কিংবা কোনো ডাক্তার নার্স তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে কিনা। মায়া লক্ষ্য করল যে লোকটি প্রতিদিন একই জামা-প্যান্ট পরে আসে এবং একই কথা বলে। তখন তার সন্দেহ হলো যে লোকটি হয়তো ভবঘুরে কোনো পাগল-টাগল হবে। তাই সে একদিন কোনো একজন নার্সের কাছে বৃদ্ধ লোকটি সম্পর্কে অভিযোগ করল। মায়ার মুখরা স্বভাব এবং কর্কশ কথায় নার্সটি ভীষণ বিরক্ত হলো এবং রাগতস্বরে মায়ার কাছে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আসল পরিচয় প্রকাশ করল।
উল্লেখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন যখন ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী যথানিয়মে তার বেডের কাছে এলেন তখন মায়ার ভীষণ লজ্জা হলো এবং এক ধরনের মমত্ববোধে তার অন্তর বিগলিত হলো। এ অবস্থায় ডা: চৌধুরী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে তো- কোনো ডাক্তার-নার্স খারাপ ব্যবহার করছে না তো? ডা: চৌধুরীর কথা শুনে হঠাৎ মায়ার মনে হলো- সে একটা অভিযোগ করবে। যে নার্সটি তাকে বকা দিয়েছিল সেই নার্সের বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা নালিশ করে যদি তাকে একটু বকা খাওয়ানো যায় তবে নেহায়েত মন্দ হয় না। মায়া মনে মনে অনেক কথামালা সাজিয়ে পরবর্তী কয়েক দিন চেষ্টা করেও ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে নালিশ জানাতে পারল না। কারণ ডা: চৌধুরী যে আন্তরিকতা এবং যে সততা নিয়ে হাসিমুখে মায়ার খোঁজখবর নেন সেটা দেখলে নাকি মায়ার খুব মায়া লাগে এবং তার সামনে মিথ্যা কথা বলতে মন সায় দেয় না।
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং তার হাসপাতাল সম্পর্কে মায়ার অভিজ্ঞতার কথা যখন আমার স্ত্রীর মুখে শুনলাম তখন ডা. জাফরউল্লাহকে নিয়ে আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসা এবং গর্বের স্থানটি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেল। করোনা সঙ্কটকালে তার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক করোনা কীট আবিষ্কার এবং সেই আবিষ্কারকে সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার জন্য তার যে নিরন্তর সংগ্রাম তা সারা দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তার জন্য বর্ণালী সিংহাসন তৈরি করে ফেলেছে। সরকারের মধ্যে মাপটি মেরে থাকা এক শ্রেণীর মানুষের অসহযোগিতার কারণে তিনি নিজে এবং তার প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ডা: বিজন যে দুর্ভোগ দুর্দশা এবং অপমানের কবলে পড়েছেন তা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে হজম করা সম্ভব ছিল না। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো আত্মহত্যা করতেন- নতুবা ব্রেন অথবা হার্ট স্ট্রোকে মারা পড়তেন।
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন স্বভাবজাত বীর এবং অনন্য উদ্ভাবনী শক্তির প্রতিভাময় মানুষ। এই জন্য তিনি হয়তো সহজে সব কিছু এড়িয়ে যেতে পারেন এবং দরকার পড়লে অনেক কিছু ভুলে যেতে পারেন। যেমনটি ভুলে রয়েছেন ২০১৮ সালে তার প্রতি যে অবিচার ও অন্যায় করা হয়েছে সেই মাছ চুরি গাছ চুরি জমি দখল মারামারি ইত্যাদি শিরোনামে অনেক মিথ্যা মামলা এবং সাজানো মোকদ্দমার ঘটনা। তার অদম্য দেশপ্রেম মানুষের প্রতি নিদারুণ মমত্ববোধ এবং দায়িত্ববোধ যে তার ৮০ বছরের জরাজীর্ণ শরীরটিকে এখনো কতরকম পাগলামির ধকল সহ্য করতে হয় তা নিম্নের ঘটনাটি জানলে সহজে যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন।
মায়ার ঘটনার পর আমি আরেকজন রুগী পাঠাই গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। আমার নির্বাচনী এলাকা দশমিনার প্রত্যন্ত এক গ্রামের হতদরিদ্র এক বৃদ্ধা জরায়ু সমস্যায় দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ। তার ছেলেকে বললাম ঢাকায় এনে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়ার জন্য। ছেলেটি তার মাকে নিয়ে যথারীতি হাসপাতালে গেল। হাসপাতাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলল, অতি দরিদ্র যদি হয় এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সার্টিফিকেট থাকে তবে ১৫ হাজার টাকা লাগবে। জনপ্রতিনিধির স্থলে ছেলেটি যখন আমার নাম বলল, তখন তারা সার্টিফিকেট ছাড়াই ভর্তি করাতে রাজি হলো। কিন্তু সমস্যা হলো তাদের কাছে সার্কুল্যে চার হাজার টাকা ছিল। তারা মায়ার মতো সামর্থ্যবান ছিল না যে, ১৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে পারবে।
রুগিনীর ছেলে আমাকে ফোন করল। আমি তাকে সরাসরি ডা: জাফরউল্লাহর চেম্বারে গিয়ে আমার কথা বলে দেখা করতে বললাম। দরিদ্র গ্রাম্য বালক তার অসুস্থ মাকে নিয়ে কোনো বাধা ছাড়াই লিফটের ৬তলায় উঠে ডা: জাফরউল্লার চেম্বারে বিনা বাধায় ঢুকে পড়ল এবং সেখানে বসে ফোন দিলো যে, তিনি হাসপাতালে নেই। আজ আর ফিরবেন না। ছেলেটির কথা শুনে আমি প্রমাদ গণলাম। কারণ তারা আমার কথামতো ঢাকা এসেছে। সুতরাং সেদিন যদি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারে তবে তাদের আমার বাসায় স্থান দিতে হবে। অন্য দিকে, যদি চার হাজার টাকার মধ্যে অপারেশন না করানো যায় তবে বাকি ১১ হাজার টাকাও আমার পকেট থেকে যাবে। সুতরাং অনেকটা বাধ্য হয়েই আমি ভর দুপুরে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ফোন দিলাম।
আমার ফোন পেয়ে জাফর ভাই জানালেন যে, তিনি প্রেস ক্লাবে আছেন। আমি তাকে বিস্তারিতভাবে সমস্যার কথা বললাম। তিনি সব শুনলেন। আমাকে বললেন যে, ওদেরকে আমার রুমে বসতে বলো। আমি ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ফিরব। তিনি যথারীতি হাসপাতালে ফিরলেন এবং কোনো রকম বিলম্ব না করেই চার হাজার টাকার বদৌলতে পুরো অপারেশনের ব্যবস্থা করলেন বলে রুগিনীর ছেলেটি আমাকে জানাল। ঘটনা শুনে আমি বেশ তাজ্জব হয়ে গেলাম। গ্রামের একটি অসহায় রুগীর জন্য নিজের অসুস্থ শরীরকে দানা-পানি না দিয়ে কিংবা বাসায় ফেরার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে হাসপাতালের চেম্বারে ফিরে নিজে রুগিনীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অপারেশনের আয়োজন করার জন্য যে কত বড় উন্মাদনা দরকার তা নিয়ে যখন ভাবছিলাম ঠিক তখন জাফর ভাই ফোন দিলেন!
জাফর ভাইয়ের ফোন পেয়ে আমি তার পাগলামোর আরেকটি স্তরের সন্ধান পেলাম। আমার ধারণা ছিল তিনি হয়তো বলবেন, রনি! তোমার রুগীর জন্য সব কিছু করে দিয়েছি। তারপর আমি হয়তো তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু কথাবার্তা বলব। কিন্তু তিনি ওসব না বলে আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে বললেন যে, রনি! তোমার রুগিনীটিকে দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছে- এই জন্য ফোন দিয়েছি। ছোট্ট একটি অপারেশন! এই জন্য ঢাকা আসার দরকার নেই। এমনকি উপজেলাতেও যাওয়ার দরকার নেই। গ্রামে গ্রামে মেডিকেল টিম পাঠিয়ে এসব রুগির অপারেশন করা সম্ভব। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার বয়স্ক নারী গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরের পর বছর বিছানায় পড়ে থাকে এবং অসহ্য বেদনায় কাতরাতে থাকে। আমি তোমার গলাচিপাতে মেডিকেল টিম পাঠাব এবং আমি নিজেও যাব ...।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে জাফর ভাইয়ের কথা শুনলাম এবং মনের আয়নায় বারবার তার ছবি এবং ডা: বিজন শীলের ছবি আঁকতে চেষ্টা করলাম। আমি তাকে সেই ২০১১-১২ সালের মতো বলতে পারলাম না চলেন জাফর ভাই, সব দায়িত্ব আমার। কারণ গলাচিপা দশমিনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল অবদি গণস্বাস্থ্য লায়ন্স ক্লাব, মুসলিম এইডসহ বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে লাখো মানুষকে যে চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলাম তা পরিচালনা করার হিম্মত হারিয়ে আমি নিজেই এখন মজলুমে পরিণত হয়েছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য