মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে আমিরাত-সৌদি-তুরস্ক টানাপোড়েন
মুহিউদ্দিন-মাহাথির-আনোয়ার - ছবি সংগৃহীত
মালয়েশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সমর্থন লাভের পরও নিশ্চিতভাবে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন অনেক। আনোয়ার যে ১২২ জন সংসদ সদস্যের সমর্থন সম্বলিত আইনগত হলফনামা ভিডিও রেকর্ডসহ প্রদর্শন করেছেন রাজাকে ওই বিষয়টি মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এড়িয়ে গেছেন। রাজপ্রাসাদ থেকেও জটিলতা পরিহার করার জন্য আনোয়ার রাজাকে কেবলমাত্র একটি তালিকা দেখিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
মালয়েশিয়ার ক্ষমতার যেকোনো পরিবর্তন মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হবার কারণে এ নিয়ে প্রভাব বিস্তারের খেলা অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে। সর্বশেষ তথ্য হলো, প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সমর্থন হারিয়ে ভেঙে পড়ার মুখোমুখি। ফেডারেল সংবিধান অনুসারে রাজা বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিতে পারেন। অথবা সংসদে অনাস্থা ভোটে সমর্থন যাচাইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিনকে সুযোগ দিতে পারেন।
প্রথম পদক্ষেপটি নেবার ব্যাপারে রাজা উদ্যোগ নিয়েও পরে পিছিয়ে এসেছেন কোনো ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে আশঙ্কা অথবা ক্ষমতাশালী কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে । আনোয়ার ইব্রাহিমকে সাক্ষাত দেবার পর তিনি ডিএপি আমানাহ ও উমনো প্রধানকে সাক্ষতকারের সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কারণ না দেখিয়ে তিনি তা স্থগিত করেছেন। এখন আগামী ২ নভেম্বর আহুত সংসদ অধিবেশনে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন ও আলোচনার কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যে মুহিউদ্দিন ইয়াসিন ও তার সরকারের অনুগত সদস্যরা ভেঙ্গে পড়া সমর্থনকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। বিশেষভাবে উমনুর যেসব নেতাকে মন্ত্রী ও সমপর্যায়ের সরকারি সুবিধা দেয়া হয়েছে তাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী ও উমনু নেতা হিশামুদ্দিন হোসেন ও খাইরি জামালুদ্দিন।
এই প্রচেষ্টায় উমনুতে একধরনের দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে এবং উমনু দলগতভাবে আনোয়ার ইব্রাহিমকে সরকার গঠনে সমর্থন দিতে পারবেন কিনা তাতে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। তবে উমনু প্রধান আহমদ জাহিদ হামিদি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের সমর্থক এমপিদের যে গ্রুপটি আনোয়ারকে লিখিতভাবে সমর্থন জানিয়েছেন তাদের অবস্থান পাল্টায়নি। এমনকি জাহিদ হামিদি ও নাজিব রাজ্জাক দুজনই প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের উমনু দল ও এর নেতৃবৃন্দের প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলছেন।
তাদের বক্তব্যে গোপন থাকছে না যে আইনিব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নাজিব ও জাহিদ হামিদিকে রাজনীতি ও নির্বাচনের অযোগ্য করে মুহিউদ্দিন ইয়াসিন বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী থাকতে চান এবং হিশামুদ্দিনকে উমনুর সভাপতি ও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী করার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থানুকুল্য ও সমর্থনধন্য এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিপুল অর্থ প্রবাহ ও ক্ষমতার সুবিধা দেয়া হচ্ছে। উমনুর শীর্ষ নেতারা বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি বলে তারা মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পতনের জন্য সমর্থন দিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিমকে।
এবার আনোয়ার ইব্রাহিম আর কোনো অনিশ্চিত সম্ভাবনার উপর বাজি ধরতে চাননি। তিনি স্বস্তিকর সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থন নিশ্চিত করেই সংবাদ সম্মেলনে সরকার গঠনের পর্যাপ্ত সমর্থন প্রাপ্তি ও রাজার সাথে সাক্ষাতকারের সুচির বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। এ ঘোষণার পর যে একটি রাজনৈতিক ঝড়ের সূচনা হবে সেটিও তিনি জানতেন। এসবের প্রস্তুতিও তিনি যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ে রেখেছেন। এখনো পর্যন্ত যাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে আনোয়ার অগ্রসর হয়েছেন তাতে পরিবর্তন হয়নি। পাকাতানের অংশীদার দল ডিএপি, আমানাহ এবং বাইরের উমনু ও ওয়ারিসানের একটি অংশ তাকে সমর্থনে দেয়ার অঙ্গীকার পালন করবেন। তবে তার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বিরোধিতা আসছে ইসলামিক দল পাস এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের পক্ষ থেকে। ৯৬ বছর বয়সে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য মাহাথিরকে সমর্থন দিয়েছে তার ক্ষুদ্র দলটি। টুকটাক চেষ্টাও তিনি করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে পাস আনোয়ার সরকার গঠন করলে রাজপথে নামার হুমকি দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, আমিরাত, ইসরাইল, চীন অন্তরালে থেকে আনোয়ারের সরকার গঠনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তুরস্ক, কাতার ও কিছুটা যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের নীরব সমর্থন আনোয়ারের প্রতি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের ভূমিকা অনেকখানি দেশটির অর্থনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
মালয়েশিয়ার রাজনীতি এবং ক্ষমতার গভীর ভরকেন্দ্রে যেসব খেলাধুলা চলছে তাতে আনোয়ারের সামনে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুহিউদ্দিনের দিন ফুরিয়ে এসেছে। সংসদের আস্থা ভোট পার হবার কোনো অবস্থা নেই মুহিউদ্দিনের জন্য। পূর্ণকালীন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না করে অন্তবর্তীকালীন সরকার করা হলেও তার নেতৃত্ব মুহিউদ্দিনের হাতে থাকার সম্ভাবনা নেই। এখনো সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে, অনাস্থা ভোটের আগে বা পরে বেশির ভাগ সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাজার ঘোষণা দেয়ার। আর দেশি বিদেশি চাপ বেশিমাত্রায় বেড়ে গেলে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার অজুহাতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে যথাসম্ভব কম সময়ের ব্যবধানে নির্বাচন দিতে হবে। শেষোক্ত পদক্ষেপের রাজনৈতিক ঝুঁকি অনেক। এতে একটি দুর্বল সরকার তৈরি হবে, যে সরকারের পক্ষে করোনা মহামারি পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং রাজনৈতিক হানাহানি মোকাবেলা কঠিন হতে পারে।
বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত ও কোভিড-১৯ আন্তর্জাতিকভাবে বড় ধরনের এক অনিশ্চিত অবস্থা তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতির প্রভাব থেকে মালয়েশিয়া মুক্ত নয়। একইসাথে সৌদি বলয় থেকে মাহাথির সরকারের রাতারাতি বের হয়ে উল্টোমুখি যাত্রা এবং বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ করে ইসরাইলি আধিপত্য বেড়ে যাবার একটি প্রভাবও মালয়েশিয়ার উপর পড়েছে। আর দেশটির নৃতাত্ত্বিক জনমিতির বাস্তবতা এমন যে সংখ্যাগুরু মালয়রা অর্থনৈতিক আধিপত্য চীনাদের কাছে হারানোর কারণে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই আর হারাতে চায় না। মাহাথিরের পাকাতান সরকারে অমালয়দের প্রভাবশালী ভূমিকা ওই ভীতিকে বেশ খানিকটা বৃদ্ধি করেছে।
আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়প্রধান সরকার গঠনের ঘোষণা এবং মালয় স্বার্থের সুরক্ষায় কিছু পরিকল্পনার বিষয় জানিয়ে মালয় ডিপ স্টেটের আস্থা ফেরাতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে সেটি হলে নভেম্বর মাসেই মালয়েশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ হতে পারেন পিকেআর প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিমের।