ইসরাইলি চালে ইরান হাতছাড়া ভারতের!
মোদি ও নেতানিয়াহু - ছবি : সংগৃহীত
পিটিআই সংবাদ সংস্থা দিল্লির ‘সূত্রের’ উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে ইরানের ফারজাদ-বি গ্যাস ক্ষেত্র প্রকল্পটি কার্যত ভারতের হাতছাড়া হয়ে গেছে। ওএনজিসি বিদেশ ও ইরানের ন্যাশনাল ইরানিয়ান ওয়েল কোম্পানির মধ্যকার আলোচনার পর্দা নেমে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।
সরকারি ভাষ্য হলো, মূল্য নিয়ে যে ব্যবধান ছিল, তা পূরণ করা যায়নি। অন্যরা জানিয়েছে, ইরান আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
তেল ও গ্যাস হলো কৌশলগত খনিজসম্পদ, একেবারে বিরল কিছু ঘটনাতেই কেবল ‘বন্ধুপ্রতীম দামে’ তা দেয়া হয়। আর তাও দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, ব্যতিক্রম প্রকৃতিতে।
ফারজাদ-বি গ্যাস ক্ষেত্রের বেলাতে আরো তিনটি কারণ কাজ করেছে।
প্রথমত, গ্যাস ক্ষেত্রটির মজুত বিপুল (আনুমানিক ২১,৭ ট্রিলিয়ন ঘন ফুট)। ফলে সামান্য মূল্যের হেরফেরও ইরানের জন্য বিপুল ক্ষতির সামিল।
দ্বিতীয়ত, ফারজাদ-বি পরিচালনায় ওএনজিসির সক্ষমতা নিয়েই সংশয়ে থাকতে পারে ইরান। ওএনজিসি বিদেশ তাদের বেশির ভাগ বিদেশী প্রকল্পে সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডার। বিভিন্ন দেশে তাদের ১৪টি উৎপাদনে থাকা সম্পত্তি থাকলেও তারা তাদের বার্ষিক উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে (প্রায় ৬০ ভাগ) নির্ভল করে থাকে রাশিয়ার ওপর।
সাম্প্রতিক খবরে জানা যাচ্ছে, ক্ষেত্রগুলোর প্রাকৃতিক পতনের ফলে প্রধান প্রধান উৎপাদনকারীর (ওপেক+-এর সিদ্ধান্তে) উৎপাদন হ্রাসের ফলে ওএনজিসি বিদেশ তাদের ক্যাপেক্স তাদের উৎপাদন হ্রাস করেছে।
তৃতীয়ত, ভারত সরকারের কনসোর্টিয়ামের অংশ হিসেবে ওএনজিসি বিদেশ ইসরাইলের সাথেও অনুসন্ধানী কাজ করছে। আর ফারজাদ-বি-এর অবস্থান হলো পারস্য উপসাগরে ইরান-সৌদি সমুদ্র সীমান্তে। ফলে এটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
উপসাগরের ভূরাজনীতিতে ইসরাইল ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। ওএনজিসি বিদেশকে ইসরাইলে অনুসন্ধান কাজ চালাতে দেয়াটা যে ভারত সরকারের জন্য চরম বোকামি হয়েছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। ভারত সরকার কাজটি করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০১৭ সালে হাই প্রোফাইল ইসরাইল সফরের পর।
মনে হচ্ছে, ইসরাইলিদের কাছে মোদি সরকার বোকা বনে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ওএনজিসি বিদেশের ফারজাদ-বি প্রকল্পকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ভারতের এই কোম্পানি সফলভাবে সেই ২০০৮ সালে সফলভাবে অনুসন্ধানকাজ শুরু করে, উৎপাদন ও বিপণন কাজে দক্ষতার পরিচয় দেয়।
ইসরাইলে ওএনজিসি বিদেশের চুক্তি ২০২১ সাল পর্যন্ত থাকবে। ওয়েল প্রাইজ ম্যাগাজিনের একটি স্পর্শকাতর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ওই মেগা জ্বালানি প্রকল্পটি ভণ্ডুল করে দিতে পেরে ইসরাইল বেশ আত্মতৃপ্তির হাসি হেসেছে। কারণ ওই প্রকল্পটি সফল হলে ভারত-ইসরাইলি সম্পর্ক দীর্ঘ মেয়াদে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত।
এদিকে চীন ও ইরানের মধ্যে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক চুক্তিটি অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বেশ বিচক্ষণ ও নমনীয়। তবে তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে না। ইরান একটি আঞ্চলিক শক্তি, তারা বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় কাজ করে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সেপ্টেম্বরে তেহরানে যাত্রাবিরতির উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে ইরানের সাথে মিটমাট করার চেষ্টা করা, তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। ফারজাদ-বি থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গেছে তা হলো : বন্ধুত্ব অনিবার্য বিষয় নয় এবং কল্যাণমূলক সম্পর্কের জন্য পারস্পরিক স্বার্থ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তি প্রয়োজন।
ফারজাদ-বি হাতছাড়া হওয়াটা মাত্র সূচনা। ভারত-ইরান সম্পর্ক কৌশলগত বিপর্যয়ে পড়ার মুখে রয়েছে। আসন্ন মালাবার মহড়ায় অস্ট্রেলিয়ার অংশগ্রহণের ফলে যে বৈরী সময়ের সূচনা করবে, তাতে ইরান ও ভারতের মূল স্বার্থ আর একই সমতলে থাকবে না।
সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, ভারতের কোয়াড কৌশল ইরানের সাথে দিল্লির সম্পর্ক জটিল করে তুলবে। উপসাগরের কোনো দেশ (বা ইসরাইল) কোয়াডের অংশ হতে চাইবে না। কারণ আসিয়ান দেশগুলোর মতো সমস্যায় তারাও আছে। তারা সবাই চীনের সাথে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চায়।
কোয়াডের নৌবাহিনীগুলো ভারত বা দিয়াগো গার্সিয়ায়র ঘাঁটিগুলো থেকে ভারত মহাসাগরে যখন সাবমেরিন অনুসন্ধান অভিযান শুরু করবে, তখন এই সামরিক জোট ইরানের নিরাপত্তা হিসাবে বড় করে ধরা দেবে। আরব সাগরের উত্তর দিকে ইরানের নৌঘাঁটিগুলো থাকায় নিরাপত্তার নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ইরান।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভারত মহাসাগরে সামরিকায়ন বিস্তার করার ফলে আঞ্চলিক দেশগুলো- কেবল চীন নয়, সেইসাথে পাকিস্তান, ইরান ও সম্ভবত রাশিয়াও- সম্প্রসারণশীল নীতি গ্রহণ করবে।
এটি এই অঞ্চলে ভারতকে নিঃসঙ্গ করে ফেলবে, ভারতের উচ্চাভিলাষকে সংযত করার জন্য পাল্টা কৌশল প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করবে। সর্বোপরি, নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। ভারতের কূটনীতিবিদেরা যতই আগড়ম বাগড়ম করে বলুন না যে কোয়া কোনোভাবেই ব্রিকস বা এসসিওর চেয়ে বেশি কিছু নয়, তাতে ভারতের প্রতিবেশীদের উদ্বেগ কাটবে না।
সূত্র : ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন