বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক ভাবনা!
গর্বিত সামরিক বাহিনী - ছবি : সংগৃহীত
ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) আওতায় সামরিক, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও সুশাসন নিয়ে বাংলাদেশের সাথে বৃহত্তর অংশীদারিত্ব গড়তে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটি সমরাস্ত্র আধুনিকায়নে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীগুলোর লক্ষ্যÑ ২০৩০ অর্জনে সহযোগিতা দিতে আগ্রহী। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে জোরালোভাবে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। সামনের দিনগুলোতে ঢাকার সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে চায় ওয়াশিংটন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ক কাউন্সিলর ব্রান্ট ক্রিস্টিনসেন এবং ডিফেন্স অ্যাটাসে মাইলস বেকার এসব কথা জানান। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আইপিএস নিয়ে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড-এর সাথে প্রতিযোগিতা করছে না। মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিকের লক্ষ্য অর্জনে আমরা এ অঞ্চলের যেকোনো দেশের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ আইনের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক পদ্ধতি সমুন্নত রাখেÑ এমন সব দেশের গঠনমূলক অংশগ্রহণকে আমরা স্বাগত জানাই। অংশীদারদের সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সম্ভব সব কিছুই করছে।
তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান হলো, আইপিএসে সামরিক কোনো উপাদানে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। তবে এই কৌশলের আওতায় অবকাঠামোগত বিনিয়োগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে। চীনের সাথে বাংলাদেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই জোরালো। এই প্রেক্ষাপটে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় বাংলাদেশ। মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের সাথে বাংলাদেশের দ্বিমত নেই। একই সাথে বাণিজ্যিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অংশীদার থাকবে বাংলাদেশ।
এ দিকে বাংলাদেশের কাছে চীনের সাবমেরিন বিক্রি নিয়ে আপত্তি তুললেও মিয়ানমারের কাছে আইএনএস সিন্ধুবীর নামে তিন হাজার টন ওজনের কিলো ক্লাস ডুবোজাহাজ বিক্রি করেছে আইপিএসে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অংশীদার ভারত। গত বৃহস্পতিবার এটি মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মিয়ানমার সাবমেরিনটির নামকরণ করেছে ইউএমএস মিন ইয়ে থেইন খা থু।
১৯৮৮ সালে ভারতীয় নৌবহরে যুক্ত হয়েছিল সাবমেরিনটি। সম্প্রতি হিন্দুস্তান শিপইয়ার্ড লিমিটেড বিশাখাপত্তমের ইয়ার্ডে ডুবোজাহাজটির সংস্কার করা হয়। এতে সাবমেরিনটির আয়ু বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ বছর। এই প্রথমবারের মতো কোনো সাবমেরিনের মালিক হলো মিয়ানমার নৌবাহিনী। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, সাগার (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন) ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে স্বয়ম্ভর করে তোলার নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই মিয়ানমারের কাছে সাবমেরিনটি বিক্রি করেছে তার দেশ।
ভারতের বেঙ্গালুরুভিত্তিক ইংরেজি ম্যাগাজিন স্বরাজ্যের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারকে সাবমেরিনটি দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে ২০ কোটি ডলারে চীন দু’টি সাবমেরিন বিক্রি করেছিল বাংলাদেশের কাছে। টর্পেডো ও মাইন দিয়ে সুসজ্জিত ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’ নামের মিং ক্লাস সাবমেরিন দু’টি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শক্তি বাড়ালেও ভারতের মূল চিন্তা অন্য জায়গায়। সাবমেরিন ছাড়াও চীনের কাছ থেকে বেশ কিছু যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহ করছে বাংলাদেশ। সাবমেরিন দু’টি শত্রুপক্ষের যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনকে আক্রমণ বা মোকাবেলা করতে সক্ষম। সম্প্রতি কক্সবাজারের পেকুয়ায় সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণের কাজও পেয়েছে চীন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যন্ত্রাংশ ও অস্ত্রের জন্য চীনের ওপর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নির্ভরশীলতা ভারতের পূর্ব উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ নৌ স্থাপনা ও বিশাখাপত্তমে নির্মাণাধীন ভারতীয় নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ঘাঁটির কাছাকাছি বেইজিংয়ের উপস্থিতি বাড়ানোর সুযোগ করে দেবে। অন্য দিকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ঘাঁটি থেকে চীনা জাহাজ ও সাবমেরিনের রসদ ও জ্বালানি সংগ্রহের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সাবমেরিন কেনার পর মিয়ানমারও এ নিয়ে আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। বিষয়টি ভাবতে বাধ্য করেছে ভারতকে। দিল্লির আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশের দেখাদেখি মিয়ানমারও যদি চীন থেকে সাবমেরিন কেনার উদ্যোগ নেয়, তাহলে বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতি আরো বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে যাবে।
এতে বলা হয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর তাগিদ থেকে মিয়ানমারের ওপর প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে আগে থেকেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল ভারত ও চীন। দুই দেশই মিয়ানমারে বড় বড় কয়েকটি বন্দর নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেনার পর মিয়ানমারে সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ বাড়াতে থাকে ভারত। ২০১৭ সালে মিয়ানমারকে লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় টর্পেডো সরবরাহ করে ভারত।
চলতি মাসের শুরুতে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও ভারতীয় সেনাপ্রধান এম এম নারাভানে মিয়ানমার সফরে যান। ওই সময়ে তারা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি ও সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সাথে বৈঠক করেন। এ সময় মিয়ানমারের কাছে আর্টিলারি গান, টি-৭২ ট্যাঙ্কের জন্য গোলাবারুদ, সোনার ও টর্পেডোসহ সামরিক সরঞ্জাম বিক্রিতে সম্মত হয় ভারত। ভারতের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ৬০০ কোটি ডলারের একটি জ্বালানি তেল শোধনাগার নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়।
ডিফেন্স জার্নালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি ইন্দো-প্যাসিফিক জাতি। প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে আমাদের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। নিরাপত্তা সহযোগিতা ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য এই অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র সাত দশক ধরে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তুলেছে। অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও সুশাসন- এই তিনটি আইপিএসের মৌল ভিত্তি।
তারা বলেন, বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের অনেক সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাই। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশ বেশ কিছু নতুন বোয়িং-৭৮৭ এয়ারক্রাফট কিনেছে। এলএনজি খাতে মার্কিন কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে। এগুলো দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ভালো উদাহরণ। জ্বালানি ছাড়াও কৃষিভিত্তিক বাণিজ্য, ড্রেজিং ও পরিবেশ প্রযুক্তির মতো খাতগুলোতে আমরা সহযোগিতা সম্প্রসারণের চেষ্টা করছি, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অর্থায়ন বাড়াচ্ছে উল্লেখ করে কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় রাডার সিস্টেম উন্নয়ন, সমুদ্রে টহল নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন এবং বঙ্গোপসাগরে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশকে সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
কর্মকর্তারা বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে স্বচ্ছতা ও সুশাসন হাত ধরে চলে। দুর্বল প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতি ও নিম্নমানের কর্মপরিবেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য সুশাসন সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে।