কর্মীদের প্রশ্ন : কত দিন চলবে এমন?
বিএনপি - ছবি : সংগৃহীত
সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমের জরিপে প্রশ্ন ছিল-ে‘‘ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, সিইসির (প্রধান নির্বাচন কমিশনার) এই বক্তব্যের সঙ্গে আপনি কি একমত?’’ এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ মন্তব্য করেছেন ৯২ শতাংশ আর ‘হ্যাঁ’ বলেছেন মাত্র ৬ শতাংশ। বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সূচক কতটা নিম্নমুখী তা এই জরিপের ফলাফলের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও আঁচ করা যেতে পারে। ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে শতকরা ১০ ভাগের একটু বেশি। অর্থাৎ কোনো দলের ভোটারই এখন কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উৎসাহ পাচ্ছেন না।
ভোটারদের এই উৎসাহ হারিয়ে ফেলার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেছেন, প্রথমত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একতরফা আধিপত্য, দ্বিতীয়ত, ভোটারদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট।
তিনবার দেশ শাসন করা সরকারি দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বিস্ময়করভাবে মাত্র ৭টি আসন পেয়েছে। দলটি অবশ্য ওই নির্বাচনকে ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’ বলে আখ্যা দিয়ে ফলাফল বর্জন করে। জাতীয় নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি উপনির্বাচনের ফলাফলেও কোনো ব্যত্যয় দেখা যায়নি। যেখানে সরকারি দলের প্রার্থী পেয়েছেন লাখ লাখ ভোট, আর বিএনপি প্রার্থীর ভোট পাওয়ার সংখ্যা ২ হাজার থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত।
এমন নির্বাচনে বিএনপি কেন বারবার অংশ নিচ্ছে, তা নিয়ে দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ সমর্থকদের মধ্যেও প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপির হাইকমান্ড নির্বাচনে অংশ নেয়ার পেছনে যে যুক্তির কথা বলা হচ্ছে, সেটি হচ্ছে- ‘সরকারের একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে জনগণের সামনে বারবার তুলে ধরা এবং একই সাথে নির্বাচনী ব্যবস্থা যে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, সেটি দেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পক্ষে থাকা শক্তিগুলোর কাছে তুলে ধরা।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায়- ‘আমরা দেখছি এসব উপনির্বাচন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল, তা থেকে কোনো পার্থক্য নেই। একইভাবে একই কায়দায় ভোট ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পার্থক্যটা হচ্ছে ওই সময়ে ২৯ ডিসেম্বর ডাকাতি করা হয়েছিল ভোটের আগের রাতে, আর এখন এসব নির্বাচনে ভোট হয়, ভোটার যায় না, ঘোষণা হয় মাত্র। এ কারণে অনেকে প্রশ্ন করেন, তাহলে কেনো আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক দল। দলটি বিশ্বাস করে, সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথÑ নির্বাচন। গণতন্ত্রের ন্যূনতম যেটুকু স্পেস পাওয়া যায়, সেই স্পেসটুকু ব্যবহার করা প্রয়োজন। কোনো সুযোগ আমরা দিতে চাই না এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে। যে সুযোগ নিয়ে তারা ন্যূনতম স্পেসটাও নিয়ে চলে যাবে। এ জন্য আমরা এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।
বিএনপি হাইকমান্ডের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ‘সরকার আরো দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আর সেই বাসনা থেকেই নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব কৌশলে অনীহা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভোটারবিমুখতাকেই তারা ক্ষমতায় থাকার একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে।’
দলটি মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনী এই ধারার অবসান হতে পারে কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এবং সেটি হতে হবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই। এর কোনো বিকল্প নেই।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকেই আন্দোলনের পথ বেছে নেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনের বছরখানেক আগে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়া হয়। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে হরতাল-অবরোধ করে। সমাধানের কোনো পথ বের না হওয়ায় তারা নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপির পাশাপাশি ২৮টি বিরোধী রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনের পরেও বিএনপি তাদের দাবিতে অটল থেকে কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও দলটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি থেকে সরে যায়নি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগেও দলটি একই দাবিতে মাঠে নামে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে (কারাগারে ছিলেন) মাঠের আন্দোলন বাদ দিয়ে ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিভিন্ন তৎপরতা চালায় তারা। কিন্তু এসব তৎপরতা কোনো কাজে আসেনি। বরং নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সারা দেশে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা, শতাধিক প্রার্থীর ওপর হামলাসহ নানা বৈরী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত টিকে থেকে ৭টি আসন লাভ করে।
বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, গত দুটি একতরফা জাতীয় নির্বাচন প্রমাণ করেছে, দলীয় সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অধীনে কেনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই ফিরে যেতে হবে। সেটি যে প্রক্রিয়াই হোক। নতুন নির্বাচনের আগে আবারো সরকারের ওপর এই চাপ প্রয়োগ করা হবে। তারা বলেছেন, বিএনপি ধীরে ধীরে আবারো নিজেদের প্রস্তুত করছে। দল ও সংগঠন শক্তিশালী করা হচ্ছে। প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা হচ্ছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির এক নেতা গতকাল মঙ্গলবার আলাপকালে বলেন, ‘আপাতত মনে হচ্ছে, আন্দোলন গড়ে তোলা খুবই কঠিন। কিন্তু হঠাৎ করে পরিস্থিতি যে পাল্টে যেতে পারে, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। এক মাগুরার নির্বাচন যেমন পরিস্থিতি উল্টে দিয়েছিল, সেরকম কিছু তো হতেই পারে। আন্দোলনের সমস্ত উপাদান বিদ্যমান আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।’ বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা-৫ উপনির্বাচনের পর বিএনপি সত্যি সত্যিই ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-কক্সবাজার রোড অচল করে দিতে চেয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা দেয়ার পর রাতেই শীর্ষ পর্যায় থেকে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল প্রার্থী সালাহউদ্দিনকে। কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সেটি শেষ পর্যন্ত করা হয়নি। সাধারণ কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বিএনপি।