যুক্তরাষ্ট্রের নজরে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলো
ট্রাম্প - ছবি সংগৃহীত
মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের গত সপ্তাহে ঢাকা সফরকে এমন একসময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দৃশ্যমানতা বাড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে যখন চীন তার উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (এতে অবকাঠামো খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি ও বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার বলা হয়ে থাকে) মাধ্যমে এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে তার সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে।
বাইগানের তিন দিনের ঢাকা সফরের আগে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পার সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ফোনে আলাপ করেন। বাংলাদেশের সংবাদপত্র ডেইলি স্টারের মতে, এই উদ্যোগকে টেকসই প্রবৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উদ্দীপনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী বাইগান বলেন,ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার দেখে। তিনি আরো বলেন, অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ হতে পারে ‘আমাদের কাজের’ কেন্দ্রবিন্দু।
অতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগে দিয়ে ঢাকায় ওয়াশিংটনের উচ্চপর্যায়ের সফর হয়েছে বলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব ইনাম খান জানিয়েছেন। ২০১৬ সালের আগস্টে ওই সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এবং ২০১২ সালের মে মাসে তার পূর্বসূরী হিলারি ক্লিনটন এবং এখন নভেম্বরের নির্বাচনের অল্প কয়েক দিন বাকি থাকতে বিগান সফর করলেন।
বিগানের সফরের প্রেক্ষাপট হলো বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের দুই লক্ষাধিক বাংলাদেশী-আমেরিকানের সমর্থন জয়ের চেষ্টা ছাড়াও (তারা ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থক)ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের জন্য অংশীদার অনুসন্ধান।
খান বলেন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই সম্পৃক্ততায় চীনের সাথে ভারসাম্যবিধানই গুরুত্ব পাবে।
বাংলাদেশে সফরের আগে বিগান ছিলেন দিল্লিতে। সেখঅনে পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে তিনি ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেন।এছাড়া চলতি মাসের শেষ দিকে নয়া দিল্লিতে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নির্ধারিত যৌথ কৌশলগত সংলাপের প্রস্তুতিমূলক কাজও সারেন।এসব সভায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভূমিকা ও করোনা মহামারি-পরবর্তী সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
বিগানের সফর হলো দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল ভারত নয়, বরং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সাথেও সম্পৃক্ত হওয়ার মার্কিন নীতির বৃহত্তর প্রবণতার অংশবিশেষ।
সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপের সাথে প্রতিরক্ষা ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সই করে যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তির আলোকে দুই পক্ষ ভারত মহাসাগরে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় একে অপরের সাথে সহযোগিতা করবে। নেপালের সাথে একই ধরনের চুক্তি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
দিল্লিতে বিগান ভারতে নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূতের সাথে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। উল্লেখ্য, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের কোনো স্থায়ী সদস্যের- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন- কারো সাথেই ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।ভুটান চায়, সব দেশের সাথেই দূরত্ব বজায় রাখতে।
আর চলতি মাসের শেষ দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেইও শ্রীলঙ্কা সফর করবেন বলে মিডিয়ার খবরে বলা হয়।
ওয়াশিংটনে কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের টাটা চেয়ার ফর স্ট্র্যাটজিক অ্যাফেয়ার্সের অ্যাশলে জে টেলিস বলেন, মার্কিন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে এটি সরাসরি আসছে। ওই কৌশলে ভারত মহাসাগর ও এর আশপাশের এলাকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
এশিয়ান কৌশলগত ইস্যুতে বিশেষজ্ঞ এই অধ্যাপক বলেন, ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক গভীর হওয়ার পরিপূরক কৌশল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব জোরদার করছে মার্কিনিরা।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত নবতেজস্বর্নার মতে, এই অঞ্চলে বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর সাথে কাজ করতে ওয়াশিংটনের বেশ কিছু আগ্রহ কাজ করছে : ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পরমাণু সঙ্ঘাতের আশঙ্কা হ্রাস করা; আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চল থেকে সন্ত্রাসী হামলার হুমকি বিলীন করা; এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী অবস্থান মোকাবেলা করা; এবং ইন্দো-প্যাসিফিক সি লেনে নৌচলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার অভিন্ন কারণ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের। কিন্তু এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ ওয়াশিংটনের সাথে তাদের সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের প্রিজম দিয়েই দেখতে চায় না।
টেলিস বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরো ভালো সম্পর্ক চায়। তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্ক থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে চায়।তারা তাদের সাথে ভারতের সম্পর্ককেও এর সাথে জড়াতে চায় না।
এদিকে স্বর্ণা বলেন, ভারত তার নিকট প্রতিবেশী এলাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিতে কিছুটা অস্বস্তিতে থাকলেও এখন দেশ দুটি একই অবস্থানে রয়েছে।
তিনি বলেন, চীনের ব্যাপারে উভয়ের অভিন্ন অবস্থান এ কাজে সহায়ক হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য অন্যতম দাতা এবং সেইসাথে এই অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশের জন্য বৃহত্তম বাজার হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণীয় অংশীদার।কিন্তু এসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের জন্য দলভুক্ত করাটা এসব দেশের দৃষ্টিতে কাঙ্ক্ষিত নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র মিলিনিয়াম চ্যালেঞ্জ কোঅপারেশনের মাধ্যমে নেপালে ৬৩০ মিলিয়ন ডলার ও শ্রীলঙ্কায় ৪৮০ মিলিয়ন ডলার দিতে চেয়েছিল। কিন্তু উভয় দেশের পার্লামেন্টেই এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ দেখা দেয়। তারা মনে করে, এই তহবিলের জের ধরে মার্কিন উপস্থিতিও ঘটবে।
তাছাড়া কলম্বো সোফা চুক্তি সই করতেও অনীহ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো,তাদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা।যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তি এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বৃহত্তম বাজার হলেও দেশটি তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে গেলাতে পারছে না।তবে বৈশ্বিক প্রাধান্যের জন্য চীনের সাথে বৈরিতার প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলে তার নীতি তীক্ষ্ণ করছে এই অঞ্চলের গুটিকতেক দেশকে জোরালভাবে পাকড়াও করার জন্য।
সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট