ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু : যে রহস্যের কিনারা হয়নি আজো
ইয়াসির আরাফাত - ছবি সংগৃহীত
ইয়াসির আরাফাত ছিলেন প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথোরিটির (পিএনএ) প্রেসিডেন্ট ও প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অরগানাইজেশনের (পিএলও) চেয়ারম্যান। তিনি অল্প কিছু দিন অসুস্থ থাকার পর ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর অপ্রত্যাশিতভাবে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর কোনো সুস্পষ্ট কারণ জানা ছিল না। তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সামনে আনা হয়েছে নানা তত্ত্ব। এর পরও বিষয়টির এখনো কোনো কূলকিনারা হলো না।
অসুস্থতার ইতিহাস
ইয়াসির আরাফাতের অসুস্থতার শুরু ২০০৪ সালের ১২ অক্টোবর। এ সময় তার ডায়েরিয়া, বমি-বমি ভাব, পেটব্যথা দেখা দেয়। এর পরপরই সাধারণভাবে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তিউনিসিয়া, জর্ডান ও মিসর থেকে আসা চিকৎসক দলের চিকিৎসক ও অন্য চিকিৎসকেরা তাকে দেখার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ফ্রান্স সরকারের জেট বিমানে করে তাকে ফ্রান্সে নেয়া হয়। সেখানে ২৯ অক্টোবর প্যারিসের শহরতলির হসপিটাল ডি’ ইনস্ট্রাকশন ডেস আর্মিস পার্চিতে তাকে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে ভর্তির সময়েও তার ডায়রিয়া ও বমি বমি ভাব ছিল। পেটেও ব্যথা ছিল। লিভার ও কিডনি কিছুটা অকার্যকর ছিল। তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটে বৃক্কসংশ্লিষ্ট বড় ধরনের জটিলতা দেখা দেয়ায়। উল্লেখ্য, তলপেটের যে যন্ত্র থেকে মূত্র আলাদা করে, তারই নাম বৃক্ক। এর ফলে ৩ নভেম্বর থেকেই কার্যত তিনি ধীরে ধীরে গভীর কোমায় চলে যেতে থাকেন।
আরাফাতের স্ত্রী সুহা আরাফাত এবং পিএনএ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয় যখন পিএনএ কর্মকর্তরা আরাফাতকে দেখতে ফ্রান্সে যান। তখন সুহা আরাফাত বলেছিলেন, ‘এরা আবু আম্মারকে (আরাফাতকে) জীবন্ত কবর দেয়ার চেষ্টা করছে’। ফ্রান্সের আইন মতে, চিকিৎসকেরা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের রোগীর রোগ পরিস্থিতি সম্পর্কে যে-কারো সাথে আলোচনা করতে পারেন না। তবে ব্যতিক্রম হলো রোগের গতিধারা সম্পর্কে রোগীর আত্মীয়দের একটা পূর্বাভাস চিকিৎসকেরা দিতে পারেন। সে অনুযায়ী আরাফাতের অসুস্থতা-সংশ্লিষ্ট যাবতীয় যোগাযোগ রাখতে হয় তার স্ত্রীর সাথে। পিএনএ কর্মকর্তারা এ কথা শুনে দুঃখ প্রকাশ করেন যে, আরাফাতের অসুস্থতা সম্পর্কিত যাবতীয় খবর তার স্ত্রী সুহা আরাফাত ফিল্টার করছেন। পরদিন পার্চির হাসপাতালের চিফ সার্জন ক্রিশ্চিয়ান এস্ত্রিপিউ রিপোর্ট দেন, আরাফাতের অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে এবং তিনি গভীর কোমায় চলে গেছেন। প্যালেস্টিনিয়ান টেরিটরির ইসলামিক কোর্টের প্রধান শেখ তাইসির তামিমি আরাফাতের পাশেই ছিলেন রাতজেগে তাকে দেখাশোনা করা ও প্রার্থনার জন্য। তিনি আরাফাতকে দেখে বলেন, তার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তার মতে, ইসলামে এ ধরনের কাজের অনুমোদন নেই।
মৃত্যু
ঘোষণা দেয়া হয়, ইয়াসির আরাফাত ৭৫ বছর বয়সে ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর রাত সাড়ে ৩টায় ইন্তেকাল করেন। ফ্রান্সের চিকিৎসকেরা বলেন, তার মৃত্যুর কারণ : massive hemorrhagic cerebrovascular accident তা সত্ত্বেও ইনফেকশনের কথা অজানা বলে ঘোষণা দেয়া হয়; কিন্তু সরকারি ভাষ্যে তার মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়। শুধু বলা হয়, তিনি ভুগছিলেন ‘মিস্টেরিয়াস ব্লাড ডিজঅর্ডারে’।
ফ্রান্সের একটি সংবাদপত্র পার্চি হাসপাতালের চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট নাম-পরিচয়হীন সূত্রের উল্লেখ করে তার চিকিৎসার ব্যাপারে খবর পরিবেশন করে। বলা হয়, এই সূত্রের যোগাযোগ ছিল আরাফাতের সাথে এবং আরাফাতের মেডিক্যাল ফাইলে তার প্রবেশের সুযোগ ছিল। এই সংবাদপত্রের মতে, আরাফাত পার্চি হাসপাতালে আসার পরপরই ধারণা করা হয় আরাফাতের লিভারে ক্ষত বা ঘা রয়েছে। আরাফাতকে তখন রাখা হয় হেমাটোলজি (রক্তসংশ্লিষ্ট) সার্ভিসে। লিউকেমিয়া তথা রক্তশূন্যতার বিষয়টি পুরোপুরি নাকচ করে দেয়া হয়। একই সূত্র মতে, লিভার সিরোসিসের ব্যাপারে কোনো ডায়াগনসিস না করার কারণ, সাধারণ মানুষের ধারণা সিরোসিস রোগটি হয় অতি মাত্রায় অ্যালকোহল অর্থাৎ মদ পান থেকে। আর সবাই জানতেন আরাফাত কখনো মদ স্পর্শ করতেন না। এই সূত্র মতে, আরাফাতের অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি ঘটেনি। তার রোগের কারণ ছিল বহুমাত্রিক। সিরোসিস পরিস্থিতির অবনতির কারণেই আরাফাত কোমায় চলে যান। ফরাসি দৈনিক লা মন্ডে চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে আরাফাত অস্বাভাবিক রক্তসংশ্লিষ্ট রোগ ও লিভার সমস্যায় ভুগছিলেন।
আরাফাতের ইন্তেকালের পর ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ইয়াসির আরাফাতের মেডিক্যাল ফাইল তার ‘নেক্সট অব কিন’ অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তখন ঠিক করা হয়, আরাফাতের ভাইপো ও জাতিসঙ্ঘে পিএনএ’র দূত নাসের আল-খুদা তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ স্বজন। স্বামীর অসুস্থতার সময় সুহা আরাফাতের নীরবতায় নাসের আল-খুদাকে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নাসের আল-খুদার কাছে ৫৫৮ পৃষ্ঠার আরাফাতের মেডিক্যাল ফাইলের একটি কপি দেয়।
আরাফাতের মৃত্যু নিয়ে আল জাজিরার অনুসন্ধান
মৃত্যুসম্পর্কিত নানা তত্ত্ব
ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু সম্পর্কে অসংখ্য তত্ত্ব চালু রয়েছে। প্রথম দিকে ফিলিস্তিন কর্মকর্তারা আরাফাতের রেকর্ডপত্র স্থগিত রাখে। ২০০৪ সালে ফিলিস্তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাবিল শাথ আরাফাতের ফরাসি চিকিৎসকের সাথে কথা বলার পর বলেছিলেন, ফরাসি চিকিৎকেরা আরাফাতের ওপর বিষ প্রয়োগের বিষয়টি পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও আরাফাতের নেতৃত্ব বিষয়ের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য প্রাইস অব কিংস’-এ নাবিল শাথ পরে বলেছেন, ‘আমার কোনো সন্দেহ নেই যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ফ্রান্স বলেছে, তার দেহে যে ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ছিল, তাদের টক্সিকোলজি টেবিলে পজিটিভ টেস্ট দেয়নি। সেখানে সাধারণ ভাষায় লেখা ছিল দিস ওয়াজ অ্যা পয়জন দেট উই হ্যাভ নট ইন আওয়ার ল্যাবরেটরিজ’।
আঠারো বছর ধরে নিয়োজিত থাকা আরাফাতের ব্যক্তিগত চিকিৎসক আল-কুর্দি বলেছেন, এমনকি সামান্য ঠাণ্ডা লাগলেও সাথে সাথে আরাফাত আমাকে ডাকতেন।... কিন্তু তার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সত্যি সত্যিই অবনতির দিকে যাওয়ার পর থেকে তারা আমাকে আর মোটেও ডাকেননি। আর আরাফাতের স্ত্রী আল-কুর্দিকে অনুমতি দেননি প্যারিসের হাসপাতালে তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য। এমনকি পরবর্তী সময়ে আরফাতের মৃত্যুর পরও তার লাশের পাশে যেতেও তাকে দেয়া হয়নি। আল-কুর্দি আরো উল্লেখ করেন, আরাফাতের বিধবা স্ত্রী লাশের ময়নাতদন্ত করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার মতে, ময়নাতদন্ত হলে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলত।
২০০৫ সালে পাওয়া মেডিক্যাল রেকর্ড থেকে জানা যায়, ৭৫ বছর বয়সী আরাফাতের চিকিৎসকেরা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একমত হতে পারেননি। এরা শুধু বলেছেন, আরাফাত স্ট্রোক করে মারা যান, তবে স্ট্রোকের কারণ ছিল অজানা। এসব রেকর্ড বিশ্লেষণ করে অভিমত দেয়া হয়, তিনি মারা যান বিষক্রিয়া, এইডস অথবা কোনো ধরনের সংক্রমণে। ২০১২ সালে প্রকাশ করা নতুন রেকর্ড মতে, ফরাসি চিকিৎসকেরা প্রথমে আরাফাতকে ডায়াগনসিস করে গ্যাসট্রোএন্টারিটিজ দিয়ে।
পয়জনিং
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৪ সালে ফিলিস্তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাবিল শাথ আরাফাতের ফরাসি চিকিৎসকদের সাথে কথা বলার পর বলেছিলেন, এসব চিকিৎসক বিষ প্রয়োগের বিষয়টি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন। ২০০৫ সালে পাওয়া আরাফাতের মেডিক্যাল রেকর্ড উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস দাবি করে, আরাফাত বিষ প্রয়োগে মারা গেছেন এমন কোনো সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তা সত্ত্বেও আল-কুর্দি আরাফাতের সন্দেহজনক মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করেছেন। তিনি বলেননি,‘অ্যানি ডক্টর উইল টেল ইউ দেট দিজ আর দ্য সিম্পটমস অব পয়জনিং’। সাবেক নেসেট সদস্য, শান্তকামী সক্রিয়বাদী ও ইয়াসির আরাফাতের ব্যক্তিগত বন্ধু ইউরি অ্যাভনারি আরাফাতের মৃত্যুর সময় দাবি করেন, আরাফাতের ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। সম্প্রতি তিনি এ দাবির পুনরোল্লেখ করেছেন। আরেকজন ইসরাইলি বর্ষীয়ান চিকিৎসক ইসরাইলের ‘হারেট্জ’ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করে আরাফাতের মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘ইট ওয়াজ অ্যা ক্লাসিক কেস অব ফুড পয়জনিং’। এ লেখায় বলা হয়, সম্ভবত তিনি অসুস্থ বোধ করার ৪ ঘণ্টা আগে খাওয়া খাবারের সাথে এই বিষ ছিল। হতে পারে এই বিষে ছিল না স্ট্যান্ডার্ড ব্যাকটেরিয়াল পয়জনিং, ছিল ৎরপরহ। এই রিসিন খুবই শক্তিশালী বিষ। সামান্য পরিমাণ এই বিষ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রাণ সংহার করতে পারে। একই সপ্তাহে ডেইলি হারেট্জ-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে দাবি করা হয়, নিউ ইয়র্ক টাইমসে আলাদাভাবে প্রকাশিত এক রিপোর্টে আরাফাতের মেডিক্যাল ফাইল সূত্রে দাবি করা হয়েছে, আরাফাত ফুড পয়জনিংয়ে মারা গেছেন, এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
থ্যালিয়াম পয়জনিং
২০০৯ সালে আরাফাতের সাবেক উপদেষ্টা আবু শরিফ অভিযোগ করেন, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোশাদ’ আরাফাতের ওপর এক ডোজ মারাত্মক থ্যালিয়াম বিষ প্রয়োগ করে। যদিও আরাফাতের প্রতিদিনের ওষুধ প্রয়োগে এ থ্যালিয়াম বিরল রাসায়নিকের প্রভাব চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। আবু শরিফ আরো দাবি করেন, ইসরাইলি প্রতিরক্ষাবাহিনী একটি ফিলিস্তিনি অ্যাম্বুলেন্সের চালককে আটক করেছিল। এই অ্যাম্বুলেন্স সার্চ করার সময় কমপক্ষে ৩০ মিনিট এরা আরাফাতের মেডিকেশন পরিচালনা করে। আবু শরিফের মতে, তখন ইসরাইলিরা ওষুধের বদলে বিষ প্রয়োগ করে। আবু শরিফ তার লেখা বই ‘আরাফাত অ্যান্ড দ্য ড্রিম অব ফ্যালেস্টাইন : অ্যান ইনসাইডার্স অ্যাকাউন্ট’-এ তিনি লিখেছেন : ‘আই ওয়াজ পজিটিভ দে ওয়্যার পয়জনিং হিজ ফুড অন অ্যা ডেইলি বেসিস অ্যান্ড ডুইং ইট রাইট আন্ডার আওয়ার ভেরি আইজ’।
২০১১ সালে আবু শরিফ অভিযোগ তোলেন, যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ক’জন ফরেনসিক টক্সিকোলজি এক্সপার্ট পরিচালিত তদন্তে জানা যায়, আরাফাতের ওপর প্রয়োগ করা বিষ ছিল থ্যালিয়াম। আবু শরিফের মতে, ইউরোপীয় টক্সিকোলজি এক্সপার্টেরা থ্যালিয়াম সম্পর্কে সুপরিচিত ছিলেন না। শুধু ফরেনসিক টক্সিকোলজি এক্সপার্টেরাই থ্যালিয়াম চিহ্নিত করতে পারতেন। তা সত্ত্বেও আবু শরিফ এসব এক্সপার্ট ও এই গবেষণা পরিচালনাকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করেননি। আবু শরিফের অভিযোগের সূত্রে ২০০৯ সালে বেথেলহেমে অনুষ্ঠিত ফাতাহ কনভেনশনে একটি প্রস্তাবের ওপর ভোটের মাধ্যমে ইয়াসির আরাফাতের ওপর বিষ প্রয়োগের জন্য ইসরাইলকে অভিযুক্ত করা হয়। জেরুসালেম পোস্টের এক সম্পাদকীয়তে আবু শরিফের অভিযোগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এই সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয় ‘কেউ প্রশ্ন তোলেননি, কী করে আবু শরিফ এই তথ্য জানতে পারলেন’। আরাফাতের ভাইপো ও ফাতাহর জনৈক নেতা বলেছিলেন, তদন্তে জানা গেছেতার ওপর বিষ প্রয়োগের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এর কোনো প্রমাণ নেই।
এইডস
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে আরাফাতের রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে জনৈক ইসরাইলি এইডস বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, আরাফাত এইডসের সব ধরনের সিম্পটমের বাহক ছিলেন। অপর দিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের দাবি, আরাফাত এইডসে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন, এমন সম্ভাবনা একদম নেই এবং জন লফটাস এবিসি রেডিওতে রিপোর্ট করেন, আরাফাত এইডসের শিকার হয়ে মারা যান। লফটাসের অভিমত, সিআইএ আরাফাতের অবস্থা সম্পর্র্কে জানত এবং তাকে হত্যা না করার ব্যাপারে ইসরাইলকে সম্মত করাতে পেরেছিল। সিআইএ বলেছিল, তার অবধারিত মৃত্যু পর্যন্ত ইসরাইল যেন অপেক্ষা করে। কেননা সমকামিতাসংশ্লিষ্ট রোগে শেষ পর্যন্ত তিনি কাবু হবেন; কিন্তু বেশ কয়েকটি আমেরিকান প্রকাশনা আরাফাতের এইডস-সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দেয় এবং বলে ইসরাইলের একজন সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আরাফাত এইডসের শিকার হয়েছিলেন, এমন খবরে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ দেখা দেয়; কিন্তু রেকর্ডপত্র দেখে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এমন কোনো সম্ভাবনাই খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই লেখায় দাবি করা হয়, আরাফাতকে বিষ প্রয়োগ করে মারা হয়েছে, এমন সম্ভবনা খুবই কম। আরো বলা হয়, আরাফাত মারা গেছেন সংক্রমণসৃষ্ট স্ট্রোকে। ২০১২ সালে সুহা আরাফাতের দেয়া তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত তদন্তে দেখা যায়, এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, আরাফাত এইডসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
হাইটেক লেজার : ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কায় নিয়োজিত প্যালেস্টিনিয়ান অ্যাম্বাসেডর আত্তালা কুইবা দাবি তোলেন, হাইটেক লেজার ব্যবহার করে আরাফাতকে হত্যা করেছেন দুই ইসরাইলি। এই দুই ইসরাইলি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু ধস্তাধস্তির পর ফিলিস্তিনি নিরাপত্তাকর্মীর কাছে তারা পরাস্ত হন। কুইবা আরো অভিযোগ করেন, ১৬টি দেশ আরাফাতের রক্ত পরীক্ষা করেছে। এর মাধ্যমে ধরা পড়ে যে, হাইটেকের মাধ্যমে আরাফাতের ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়।
গ্যাস্ট্রোএনটারিটিজ
২০১২ সালে প্রকাশ করা হয় কিছু নতুন মেডিক্যাল রেকর্ড। এসব রেকর্ডে দেখা যায়, প্রথম দিকে আরব চিকিৎসকেরা আরাফাতের ভাইরাল গ্যাস্ট্রোএনটারিটিজ ডায়াগনাইজ করেন। তাকে বিমানে করে ফ্রান্সে নেয়ার আগে এসব চিকিৎসক পশ্চিমতীরে আরাফাতকে দেখাশোনা করতেন। তখন তার অবস্থারও উন্নতি হয়েছিল, এমনকি তিনি রমজানের রোজা রাখাও শুরু করেন। এর পরও তার বমি বমি ভাব ও ডায়েরিয়া অব্যাহত ছিল।
আরাফাত দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করেন। তার ব্লাড প্লেটিলেট (রক্তের মধ্যকার অতি ক্ষুদ্র পর্দাবিশেষ, অণুচক্রিকা) সংখ্যাও কমে যেতে শুরু করে। ২৮ অক্টোবর তার মেডিক্যাল টিম তাকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকালে তাকে পাঠানো হয় ফ্রান্সে।
ইসরাইলি বিশেষজ্ঞ ড. জোসেফ জিমারম্যান রামাল্লাহ মেডিক্যাল ফাইল পর্যালোচনা করে দেখেন। এর পর তিনি বলেন, আরাফাতের প্রথম দিকের সিম্পটমগুলো গ্যাস্ট্রোএনটারিটিজের বৈশিষ্ট্যের সাথে সাঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। আর তিনি বিশ্বাস করেন না, এ ধরনের ভাইরাল ইনফেকশনে কারো মৃত্যু হতে পারে। তিনি এ-ও বলেন, তার ওপর বিষ প্রয়োগ করার সম্ভাবনাও তিনি দেখছেন না। এমনকি তিনি মনে করেন, পলোনিয়াম-২১০-এর মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণের সম্ভাবনাও এখানে ধরা পড়েনি। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, আরাফাতের ব্লাড প্লেটিলেট হঠাৎ করে নিচে নেমে যায় এবং তা নিচেই থেকে যায়। এর ফলে আরাফাতের লিভার আর কাজ করছিল না। এর কারণ হতে পারে ভাইরাল ইনফেকশন, বিষ প্রয়োগ নয়।
প্লেটিলেট ডিজঅর্ডার : আরাফাতের চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকা ফরাসি চিকিৎসকদের তৈরী এক রিপোর্টে বলা হয়, প্লেটিলেট ডিজঅর্ডারে আরাফাতের মৃত্যু হয়েছে। প্লেটিলেট ডিজঅর্ডারের কারণ ছিল অজানা। তবে বিষ প্রয়োগের বিষয়টি তিনি উড়িয়ে দেননি।
স্বাভাবিক কারণ : ব্যারি এম রুবিন ছিলেন আমেরিকান বংশোদ্ভূত ইসরাইলি। তিনি পরিচিত সন্ত্রাস ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি বহুবার দেখা করেছেন ইয়াসির আরাফাতের সাথে। তিনি উল্লেখ করেন, আরাফাতের বয়স ছিল ৭৫ বছর। সে তুলনায় তার ওজন ছিল বেশি। খেতেন অস্বাস্থ্যকর খাবার। কাজ করতেন দীর্ঘ সময়। নিজের ভালো যত নিতেন না। তার অভিযোগ, তার ভালো চিকিৎসকও ছিল না।
পলোনিয়াম বিষ প্রয়োগের সন্দেহ
ইসরাইলি রেডিওর মতে, সাবেক ফিলিস্তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তা অ্যাটর্নি ফাহমি শাবানা বলেছেন, আরাফাতের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী তার মৃত্যুর জন্য দায়ী এবং তাকে মারা হয়েছে পলোনিয়াম বিষ প্রয়োগ করে। ফাহমি ২০০৪ সালে ফরাসি হাসপাতালে আরাফাতের মৃত্যু সম্পর্কিত তদন্তে অংশ নেন। আরাফাতের মৃত্যুর আরো কয়েক মাস পর তিনি এ-ও বলেছিলেন, এই একই চক্র গাজার সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান জেনালের মুসা আরাফাতকে খুন করে। তিনি ছিলেন পিএলও নেতার আত্মীয়। আরাফাতের ক্ষমতার ধারেকাছে কারো আসা ঠেকানোর জন্য কাজটি করা হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আরাফাতের মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত আবার চালুর আদেশ দেন।
আলজাজিরার তদন্ত
২০১২ সালের ৪ জুলাই আলজাজিরা একখবরে জানায়, নয় মাস ধরে পরিচালিত এই তদন্তের মাধ্যমে আলজাজিরা জানতে পেরেছে, তার মৃত্যু সম্পর্কে চার দিকে ছড়ানো কোনো গুজবই সত্য নয়। তদন্ত মতে, ২০০৪ সালের ১২ অক্টোবর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত আরাফাত সুস্থ ছিলেন। সুইজারল্যান্ডের লুসানি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রেডিয়েশন ফিজিক্স পরিচালিত টেস্টে দেখা গেছে, আরাফাতের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে পলোনিয়ামের উপস্থিতি ধরা পড়ে। এতে প্রমাণ হয়, তার দেহে উচ্চ মাত্রার পলোনিয়াম প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়। পলোনিয়াম হচ্ছে বিরল ধরনের অতিমাত্রিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ তথা রেডিওয়েক্টিভ সাবস্ট্যান্স। এই পলোনিয়াম সেখানে এমন মাত্রায় পাওয়া যায়, যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। তা ছাড়া ৬০-৮০ শতাংশ পলোনিয়াম প্রকৃতি থেকে আসতে পারে না।
২০১০ সালের অক্টোবরে ইনস্টিটিউট অব রেডিও ফিজিক্স থেকে একটি আনুষ্ঠানিক প্রেস রিলিজ দিয়ে এসব বিষয় বিশ্লেষণ করা হয়। এতে বলা হয় : ‘মি. আরাফাতের পার্সোনাল এফেক্টে ব্যাখ্যাহীন পরিমাণ পলোনিয়াম-২১০ পাওয়া গেছে। তা সত্ত্বেও তার মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য তা যথেষ্ট নয়। স্মরণযোগ্য, সাবেক রুশ গুপ্তচর আলেক্সান্ডার লিটভিনেকোর ক্ষেত্রে তার মাথার চুল পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু মি. আরাফাতের বেলায় তা ঘটেনি। তা ছাড়া আরাফাতের ফরেনসিক রিপোর্টে পাওয়া রেকর্ড রেডিয়েশন সিনড্রোমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।’
২০১২ সালের জুলাইয়ে ইনস্টিটিউট অব রেডিও ফিজিক্সের এক মুখপাত্র জোর দিয়ে বলেন, ‘আরাফাতের মেডিক্যাল রিপোর্টে যেসব সিম্পটমের বর্ণনা রয়েছে, তা পলোনিয়াম-২১০-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে না যে, ফিলিস্তিনি নেতাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল কি না। আর এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে আরাফাতের লাশ কবর থেকে তুলে আবার পলোনিয়াম-২১০ টেস্ট করা। সুইজাল্যান্ডের লাইসানির ইনস্টিটিউট অব রেডিও ফিজিক্সের প্রধান ফ্রাঙ্কো বচুড বলেছেন, ‘আমাদের পরীক্ষা বিষ প্রয়োগের সুস্পষ্ট প্রমাণমূলক পরীক্ষা নয়। ইংল্যান্ডের লিডস ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল টক্সিকোলজির অধ্যাপক অ্যালেস্টেয়ার হে বলেন, ‘তার পোশাক-আশাক পরবর্তী সময়ে ট্যাম্পার করা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। আপনাকে পরীক্ষা করতে হবে আরাফাতের লাশ।’
আলজাজিরার রিপোর্টের জবাবে হার্জলিভার ইনস্টিটিউট ফর কাউন্টার টেরোরিজমের কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল ও নিউক্লিয়ার স্পেশালিস্ট ড. এলি কারমন বলেন, ‘আট বছর আগে আরাফাতকে হত্যার জন্য যদি উচ্চ মাত্রায় পলোনিয়াম ব্যবহার হয়ে থাকে, তবে এই পদার্থের হাফলাইফ দিয়ে তা প্রমাণ করা অসম্ভব। যদি বিষ প্রয়োগের জন্য তা ব্যবহার হতো তবে তবে সামান্য পরিমাণে হলে তা এখন পাওয়া যেত। তার পরও অনেক উচ্চ মাত্রায় তা পাওয়া যায়। কেউ-না-কেউ আরো অনেক পরে পলোনিয়াম প্রয়োগ করেছিল।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন আরাফাতের বিধবা স্ত্রী সুহা আরাফাত গবেষকদের আরাফাতের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সরবরাহ করেন। সুহা হাসপাতালে আরাফাতের পাশে ছিলেন, তিনি আরাফাতকে ও তার কাপড়-চোপড় ধরেছেন। এর পরও কেন তিনি বিষমুক্ত থাকতে পারলেন?
ইসরাইল সব ধরনের অভিযোগ গুজব বলে অস্বীকার করে। ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি স্পোকম্যান পল হিরশ্চন সব গুজব সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। তিনি কৌতুক করে বলেন, ‘হঠাৎ করে সুহা তার ওয়াশিং বাস্কেট চেক করে এমন পোশাক-আশাক আবিষ্কার করলেন, যা আট বছর ধরে ধোয়া হয়নি। হঠাৎ করে কোথা থেকে আনা হলো কয়েক জোড়া পোশাক, আমরা এগুলো পরীক্ষা করলাম। দ্রুত লয়ে। এতে আবিষ্কার করলাম পলোনিয়াম।’
আরাফাতের ইন্তেকালের সময় ইসরাইলি নিরাপত্তা সংস্থা ‘শিন বেট’-এর দায়িত্বে থাকা অ্যাভি ডিচার আর্মি রেডিওতে বলেছিলেন, আরাফাতের দেশে-বিদেশে শত্রু অনেক। কিন্তু তাদেরকে তদন্ত করতে দেয়া হোক...। তাদের ঘরের ভেতরে কী চলে তা কী করে তদন্ত করতে হয় ফিলিস্তিনিরা ভালো করেই জানে। তাদের তদন্ত করেই তা বের করতে দিন।
২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানচেট’ একটি পর্যালোচনামূলক লেখা প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল ‘ইমপ্রুভিং ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন ফর পলোনিয়াম পয়জনিং’। এ লেখায় সুইজারল্যান্ডের বেশ কিছু চিকিৎসক পরামর্শ দেন, আরাফাত পলোনিয়ামের বিষক্রিয়ায় মারা যেতে পারেন। এই টিম আরাফাতের পোশাক-আশাক ও ব্যবহার্যসহ ৩৭টি রেফারেন্সের নমুনা বিশ্লেষণ করেন, যেগুলো পলোনিয়ামমুক্ত বলে জানা ছিল। সবগুলো না হলেও আরাফাতের বেশ কিছু পোশাক ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায় তেজস্ক্রিয়। এই টিম মনে করে, এ ক্ষেত্রে একটি ময়নাতদন্ত উপকারে আসত। ইয়াসির আরাফাতের দেহের ফ্লুইডের একটি নমুনা পরীক্ষা করে রাশিয়ার ফেডারেল মেডিক্যাল বায়োলজিক্যাল এজেন্সির প্রধান ভদিমির উইবা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আরাফাতের মৃত্যুর কারণ পলোনিয়াম নয়। তবে এই এজন্সি তখন উইবার এই বক্তব্যকে এজেন্সির বক্তব্য বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে। ব্রিটিশ ফরেনসিক সায়েন্টিস্ট প্রফেসর ডেভিড বার্কলে বলেন, সুইস টিমের ফলাফল আসলে একটি স্মোকিং গান। আর এটি পরম সত্য (অ্যাবসলিউটলি সার্টেন) যে, আরাফাতের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে পলোনিয়াম। রুশ ও ফরাসি পরীক্ষার ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশের পর ডেভিড বার্কলে আর মন্তব্য করেননি কিংবা এ ব্যাপারে কারো সাথে যোগাযোগও করেননি। ফরাসি পরীক্ষায় কিছু পলোনিয়াম ধরা পড়ে। এবং বলা যায় এর উৎস প্রাকৃতিক। এরপর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হয় রুশ মেডিক্যাল রিপোর্ট। এতে বলা হয়, রেডিয়েশনের কারণে আরাফাতের মৃত্যু ঘটেনি। ভদিমির উইবা বলেন, আরাফাতের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে এরা আর কোনো পরীক্ষা চালাতে চান না।
নয়া তদন্তের দাবি
আলজাজিরার উদঘাটনের পর সুহা আরাফাত দাবি তোলেন আরাফাতের লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় পরীক্ষা করার জন্য। যাতে আলজাজিরার দাবি মোতাবেক পলোনিয়াম বিষ প্রয়োগের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা যায়। সুহা আরাফাতের এ দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এ ব্যাপারে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, সুইস ইনস্টিটিউট ও যে ফরাসি সামরিক হাসপাতালে আরাফাত ইন্তেকাল করেন, সে সম্পর্কে জানার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি পাঠানো হবে ইউরোপে। মাহমুদ আব্বাস আরো বলেন, আরাফাতের পরিবার রাজি থাকলে তিনি শুধু ময়নাতদন্তের আদেশ দেবেন। তবে তিনি তার পরিবারের কোনো সংজ্ঞা দেননি। পরবর্তী সময়ে আব্বাস বলেন, শুধু প্রয়োজন হলেই তিনি তদন্তের নির্দেশ দেবেন।
আরাফাতের মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত করে দেখার জন্য গঠিত কমিটির প্রধান তৌফিক তিরওয়াই বলেন, আমরা নিশ্চিত আরাফাতকে সরিয়ে দেয়ায় ফিলিস্তিনিদের হাত আছে। তিনি এ-ও বলেন, তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করা হবে, তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। ২০১২ সালের ৩০ জুলাই তিরওয়াই আরো বলেন, আরাফাতকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে এমন পূর্বানুমান থেকে আমরা তদন্তের পদক্ষেপ নিইনি। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিই তদন্তের মাধ্যমে মেডিক্যাল রিপোর্ট বিবেচনায় না নিয়ে সরাসরি হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে, যা থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসবে কোন পদ্ধতিতে কী রাসায়নিক প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তখন জানা যাবে বিষাক্ত পদার্থটির নামও। তিউনিসিয়াও আরব লিগের কাছ অনুরোধ জানিয়েছিল মন্ত্রী-পর্যায়ের সম্মেলন ডেকে আরাফাতের মৃত্যুর বিষয়টি আলোচনার জন্য, যাতে করে জানা যায় কোন পরিস্থিতিতে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আরব লিগের মহাসচিব নাবিল আল আরাবি বলেন, স্থায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক হবে আরাফাতের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য। স্থায়ী প্রতিনিধিরা একটি রিপোর্ট তৈরি করে কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাব দেবে। আর যত শিগগির সম্ভব এই প্রস্তাব আরব লিগের মন্ত্রী-পর্যায়ের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।
তোলা হলো কবর থেকে লাশ
২০১২ সালের ৯ জুলাই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আলজাজিরার দাবি অনুযায়ী পলোনিয়াম প্রয়োগের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য আরাফাতের লাশ কবর থেকে তোলার ব্যাপারে অনুমোদন দেন। ২০১২ সালেল ৮ আগস্ট সুইস বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয় পশ্চিম তীরে এসে আরাফাতের দেহাবশেষে বিষের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য। এই ল্যাবরেটরি এমন নিশ্চয়তা দাবি করে যে, পরীক্ষা স্বাধীন, বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ রাখার জন্য তারা যাকে ইচ্ছা এ পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট করতে পারবে।
২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা আরাফাতের দেহাবশেষ ও কবরের মাটি থেকে তিনটি নমুনা সংগ্রহ করেন। একটি রুশ, একটি সুইস ও একটি ফরাসি টিম আলাদা আলাদাভাবে নমুনাগুলো পরীক্ষা করে দেখে। তদন্তের ফল প্রকাশে বিলম্ব করা হয়। খবরে প্রকাশ, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অনুরোধেই তা করা হয়। কারণ, তা শান্তি আলোচনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বর এক খবরে জানায়, সুইস ফরেনসিক টিম আলাফাতের পাঁজর এবং মেরুদণ্ডের নিচের অংশ ও নিতম্বের মধ্যকার অস্থিকাঠামোয় যে পরিমাণ পলোনিয়াম পেয়েছেন তা স্বাভাবিকের তুলনায় ১৮ গুণ বেশি। এবং এই টিম ৮৩ শতাংশ আস্থাশীল যে, পলোনিয়াম পয়জনিংয়ের ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু অধ্যাপক বচুড আলজাজিরার এই বক্তব্যের প্রতি দ্বিমত প্রকাশ করেন এবং বলেন, পলোনিয়াম পয়জনিংয়ের পূর্বানুমানের বিষয়টি মোটামুটি মেনে নেয়া যায়। সুহা আরাফাতের বিশ্বাস তার স্বামী রাজনৈতিক হত্যার শিকার, তবে তিনি এ ব্যাপারে কারো দিকে আঙুল তোলেননি। তিনি বলেন, তিনি অপেক্ষায় থাকবেন ফরাসি ফরেনসিক রেজাল্টের। বেলজীয় একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়, রেজাল্টগুলো পলোনিয়াম পয়জনিংয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, এ ব্যাপারে বেশির ভাগ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ একমত ছিলেন না। জন জে ক্রিমিনাল জাস্টিস কলেজের ফরেনসিক বায়োলজিস্ট নাথান লেন্টস বলেন, রেজাল্টগুলো পলোনিয়াম পয়জনিংয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তিনি আরো বলেন, ‘দেয়ার ওয়াজ সার্টেনলি নট অ্যা স্মোকিং গান হেয়ার’। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের রেডিওলজিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ডেরেক হিল এই তদন্তে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও বলেন, ‘আমি বলব এটি স্পষ্টত অভিভূত করার মতো কোনো প্রমাণ নয়। নমুনা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে এটি একটি সুন্দর শক্তিশালী ইঙ্গিত।
আরাফাতের দেহাবশেষ রুশ টিমের পরীক্ষার পর রাশিয়ান মেডিক্যাল-বায়োলজিক্যাল এজেন্সি মন্তব্য করে যে, পলোনিয়াম আরাফাতের মৃত্যুর কারণ নয়। তবে সরকারে বৈজ্ঞানিক কমিটি পরে তাদের গবেষণার ব্যাপারে সরকারের ভাষ্য দেয়ার কথা অস্বীকার করে। বলা হয়, কমিটি শুধু তাদের পরীক্ষার ফলাফল রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করেছে। এর পরও আলজাজিরা জানতে পারে রুশ বিজ্ঞানীরা ২০টি নমুনার মধ্যে মাত্র চারটি নমুনা পরীক্ষা করেছে। কিভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে, সে ব্যাপারেও রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কড়াকড়ি আরোপ করে। আলজাজিরা সূত্র মতে, রুশদের লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অনুরোধ রক্ষা করা কিন্তু পিএলওকে সহায়তা করে ইসরাইলকে না চটানো।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে একজন অচিহ্নিত ব্যক্তি দাবি করেন, তিনি ফরাসি তদন্তের ফল এএফপির কাছে ফাঁস করে দিয়েছেন। তার দাবি, রিপোর্ট মতে আরাফাত বিষক্রিয়ায় মারা যাননি। তার মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। এই ফাঁসকারীর মতে, রিপোর্টে আরাফাত মারা গেছে ‘জেনারেল ইনফেকশনের’ ফলে। পরে রাশিয়ার ফেডারেল মেডিকো-বায়োলজিক্যাল এজেন্সি মত দেয় যে, আরাফাত বিষ প্রয়োগের শিকার হয়ে মারা যাননি।
মার্ডার ইনকোয়ারি
২০১২ সালের জুলাইয়ে আলজাজিরার ৯ মাসের তদন্তের ফলাফল উপস্থাপনের পর সুহা আরাফাত ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তিনি তার স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে ফ্রান্সের আদালতে একটি মামলা দায়ের করবেন। সুহা আরাফাত আলজাজিরাকে বলেছিলেন, তিনি দীর্ঘ দিন ধরে সন্দেহ করে আসছিলেন যে, তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এ-ও উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল উভয়ই তাকে শান্তির পথে বাধা মনে করে। ২০১২ সালের ৩১ জুলাই সুহা আরাফাত ও তার কন্যা জাওরা প্যারিসের পশ্চিম শহরতলির একটি আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন। ২৮ আগস্ট ফ্রান্সের প্রসিকিউটর খুনের মামলার ইনকোয়ারি শুরু করেন।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ইসরাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ইসরাইলই হত্যা করেছে ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতকে। ইসরাইলি কর্মকর্তারা সম্প্রতি আরাফাতকে হত্যা করার ব্যাপারে ইসরাইলকে যে অভিযুক্ত করা হয়েছে, এর সাথে ইসরাইলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট খবর পরিবেশনে পারদর্শী ইসরাইলি সাংবাদিক উসি মেলম্যানের লেখা এক সংবাদে বলা হয়, ড্যান র্যাবিবের গবেষণা মতে, ইসরাইল আরাফাতকে হত্যা করেনি।
মেলম্যান বলেন, ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আরাফাতের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল। চেয়েছিল তাকে হত্যা কিংবা ফিলিস্তিন থেকে তাকে বহিষ্কার করতে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শ্যারন এই ধারণাগুলো বাতিল করে দেন। শ্যারনের অভিমত ছিল, আরাফাতকে হত্যা করে যে লাভ হবে, তাকে হত্যার অভিযোগ তার চেয়ে বেশি ক্ষতি বয়ে আনবে ইসরাইলিদের জন্য। তা ছাড়া তার মতে, আরাফাতের নেতৃত্ব এরই মধ্যে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, আন্তর্জাতিক সমাজ তার ওপর আর আস্থাশীল নয়। তবে সাংবাদিক ড্যানি রুবিনস্টিন বলেন, শ্যারনের ইনার সার্কেল আরাফাতের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে থেকে সব সময় আলোচনা করত কী করে আরাফাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ইসরাইলি শান্তিবাদী ও সাবেক নেসেট সদস্য এবং আরাফাতের ব্যক্তিগত বন্ধু ইউরি অ্যাভনেরি আরাফাতের মৃত্যুর জন্য শ্যারনকে দায়ী করেন।
ফিলিস্তিন কর্মকর্তা ও আরাফাতের ভাইপো নাসির আল-খুদা আরাফাতের মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে গঠিত কমিটির রিপোর্ট মতে, তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। আর ইসরাইল সরাসরি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তিনি বলেন, ইসরাইল এমন একটি দেশ, যার পলোনিয়ামে প্রবেশ রয়েছে। দেশটির সক্ষমতা রয়েছে আরাফাতকে হত্যার। দেশটি প্রকাশ্যে বলে আরাফাতমুক্ত হওয়ার পেছনে এর স্বার্থ রয়েছে। ২০০৩ সালে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোশে ইয়ালুন ও অন্যান্য কর্মকর্তা ঘোষণা দেন, ফিলিস্তিনি নেতা আরাফাতকে হয় হত্যা করতে হবে, না হয় বহিষ্কার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন বলেন, আরাফাত শান্তিপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি ইইউ রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানান আরাফাতকে বয়কট করার জন্য।