পর্দা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা
পর্দা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা - ছবি : সংগৃহীত
‘এটি (পোশাক) তোমাদের জন্য দেহের আচ্ছাদন ও শোভাবর্ধনের উপায়। আর সর্বোত্তম পোশাক হলো তাকওয়ার পোশাক।’ (সূরা আরাফ ২৬)
পর্দা ও তাকওয়া শব্দটি একটি অন্যটির পরিপূরক। কিন্তু আধুনিক মনস্ক আমরা পর্দা করার মতো ফরজ বিষয়টির সাথে তাকওয়া বা আল্লাহভীতির নিবিড় সম্পর্ককে ভুলতে বসেছি। আমরা নিজেদের আবৃত করছি ঠিকই কিন্তু সেটা যথাযথ পর্দার উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণ করছে কিনা সে ব্যাপারে আমরা চরম উদাসীন। পর্দা মানে বাহ্যিকভাবে আমরা জানি আবৃত করা। কিন্তু সেটা যদি দায়সারা গোছের রঙিন আকর্ষণীয় সব কাপড়ের সমাহার হয়, তাহলে পর্দার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
রুচিপূর্ণ কারুকাজ সংমিশ্রিত পোশাক আমাদের মন ও মনোযোগ দুটোই কেড়ে নেয়।
প্রথমত পর্দার পোশাকটি আমাদের নজর কাড়ে। তারপর সেই রুচিশীল পোশাক পরিধান কারী ব্যক্তিটি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায়। তার পোশাকটি কী এমন হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় যেটা মানুষের নজর ক্লান্ত করে দিবে, দ্বিতীয়বার তাকানোর অনুভূতি জাগ্রত করবে না। যেহেতু পর্দাটা শুধু আল্লাহর ভয়েই করা উচিত, তাই কে কী বলল, কেউ আমাকে কেয়ার করল কিনা অথবা কেউ ইমপ্রেস হলো কিনা, এই ব্যাপারগুলো সত্যিই কোনো যৌক্তিক অর্থ বহন করে না।
পর্দা মানে আমরা শুধু পোশাক কেই বুঝি কিন্তু তার বাইরেও আমাদের কণ্ঠ ও দৃষ্টিও পর্দার অন্তর্গত। নারীদের নন মাহরামদের সাথে কোমল ও কমনীয়ভাবে কথা বলতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা নারীমাত্রই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সে ক্ষেত্রে কণ্ঠ হতে পারে কারো মনোযোগ আকর্ষণের কারণ।
এছাড়াও আমরা জানি, পুরুষদের দৃষ্টি অবনত করে চলতে বলা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কি মেয়েদের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ নেই? উম্মুল মুমিনীন হজরত উম্মে সালামা রা: হতে বর্ণিত, ‘একদিন আমি এবং হজরত মায়মুনা রাসূলুল্লাহ সা:-এর নিকট বসেছিলাম। হঠাৎ সেখানে প্রবেশ করলেন ইবনে উমমে মাকতুম। রাসূলুল্লাহ সা: তখন উম্মে সালামা ও মায়মুনাকে বললেন, তোমরা লোকটি থেকে পর্দা করো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সা:, তিনি তো অন্ধ। আমাদের দেখতে পায় না। তখন রাসূল সা: বললেন, তোমরা দুজনও কী অন্ধ যে তাকে দেখতে পাচ্ছ না? (তিরমিজি)
এছাড়াও নারীদেরকে চলার সময় দম্ভভরে চলতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যেন পায়ের দ্বারা মাটিতে আঘাত করে না চলে। নতুবা যে সৌন্দর্য তারা গোপন রেখেছে তার অবস্থা জানতে পারবে।’ (সূরা নূর : ৩১)
পর্দার সব শর্ত পূরণ করলেও পুরোপুরি পর্দা ততক্ষণ হবে না যদি আমাদের মনে আল্লাহর ভয় না থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উৎকর্ষের সাথে সাথে আমাদের গোপন অন্যায় করার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। নন মাহরামদের সাথে আমরা হরহামেশাই চ্যাটিং করছি। এই প্র্যাকটিস জাস্টিফাই করে এভাবে যে, এখানে তো আমাদের দেখা যাচ্ছে না, কথা শোনা যাচ্ছে না। তাহলে আর সমস্যা কী? শয়তানের নীলনকশাকে আমরা অবচেতন মনেই বাস্তবায়ন করে চলছি এভাবেই। আক্ষেপের বিষয়ে আমাদের ইসলাম জানা ভাইবোনরাও এই ফাঁদে অহরহ পা দিচ্ছে। আমরা অনেক কিছুকেই টেকেন ফর গ্রান্টেড করে নিয়েছি, যা আদতে আমাদের জন্য অকল্যাণই বয়ে আনছে।
আমরা ভুলে যাচ্ছি নন মাহরাম সে জুনিয়র, সিনিয়র বা বয়স্ক যাই হোক না কেন, আমাদের জন্য হুমকি। আমাদের জন্য নেক সুরতে শয়তানের ধোঁকার মতো। নন মাহরামদের সাথে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া মেলামেশা কঠিনভাবে এড়িয়ে চলি। এতে আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহকে ভয় করি সর্বাবস্থায়। দুই কাঁধের ফেরেশতার উপস্থিতি মনে করিয়ে দেই নাফসকে সবসময়।
বর্তমান নষ্ট সমাজে নিজেকে সবকিছু থেকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা যেন আমাদের থাকে। আমাদের এই কষ্টকর-ক্লান্তিকর প্রচেষ্টাই হয়তো আমাদের আল্লাহর প্রিয় করে তুলবে। জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করবে। যুগে যুগে নবীগণ ও তাদের উত্তরসূরিরা এভাবেই নিজেদের সম্ভ্রমকে হেফাজত করেছেন, হারাম চাওয়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ না করে। ইউসুফ আ:-এর আত্মসম্ভ্রম হেফাজতের ঘটনার মতো উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের সামনে থাকার পরও আমাদের পথ হারা হওয়া কি মানায়? হারামের প্রতি মনস্তাত্ত্বিক এই প্রবণতা যুগে যুগে ছিল, আছে ও থাকবে। শুধু হয়তো ধরন ভিন্ন হবে।
নিজের বিবেক বুদ্ধিকে একটু সচেতনভাবে কাজে লাগাই আমরা। নিজেকে যত্রতত্র মোহনীয়ভাবে প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকি, যা নরপশুদের রিপুকে জাগ্রত করতে সহায়তা করে। কনফিডেন্টলি পর্দার মতো ফরজ হুকুম পালন করি কোনো রকম ফাঁকফোকর ছাড়াই, যখন প্রয়োজনে বাহিরে যেতে হবে। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হিজাবি এক বোনকে সাংবাদিকরা একবার প্রশ্ন করেছিলেন, কিভাবে এই গ্রীষ্মের গরমে আপনি নিজেকে ঢেকে রাখতে পারেন? জবাবে তিনি আল্লাহর সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বলো! জাহান্নামের আগুন আরো অনেক বেশি উত্তপ্ত।’ (সূরা তাওবা : ১৮০)
এই বোনের উত্তরটি আমাদের সবার জন্যই রিমাইন্ডার। আল্লাহ আমাদের ইসলামী হুকুম আহকামগুলো সঠিকভাবে মেনে চলার তাওফিক দান করুন।
লেখিকা : ইসলামী গবেষক