ভারতের বিমানবাহী রণতরী : উচ্চাভিলাষ বনাম বাস্তবতা
ভারতের বিমানবাহী রণতরী : উচ্চাভিলাষ বনাম বাস্তবতা - ছবি : সংগৃহীত
ভারতীয় সামরিক বাহিনী দেশটির স্বাধীনতার পর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পুনঃবিন্যাসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি তার ভবিষ্যত কৌশলগত অবস্থানের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এই পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো আঞ্চলিক শক্তি প্রক্ষেপণে ভারতীয় নৌবাহিনীর ভূমিকা।আর এর জের ধরেই তারা তিনটি বিমানবাহী রণতরী নির্মাণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
ভারতীয় নৌবাহিনী বর্তমানে একটি বিমানবাহী রণতরী পরিচালনা করে। এটি হলো ৪৫ হাজার টনের আইএনএস বিক্রামাদিত্য। ৩৭,৫০০ টনের আইএনএস বিক্রান্ত সবেমাত্র সি ট্রায়ালে প্রবেশ করেছে। দুটিই স্কাই-জাম্প ক্যারিয়ার। তবে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের তৃতীয়টিকে ফ্ল্যাট-টপড বিমানবাহী রণতরী হিসেবে দেখতে চাচ্ছে। ৬৫ হাজার টনের আইএনএস বিশালের সুপিরিয়র পাওয়ার প্রজেকশন থাকায় এর নিরঙ্কুশ প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর তিনটি বিমানবাহী রণতরীর প্রথম পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল ২০০০-এর প্রথম দিকে। তখনই তা নীতিগতভাবে গ্রহণ করা হয়। এর ফলে নৌবাহিনী ১৫০টি বিমান নিয়ে দুটি ক্যারিয়ারকে সবসময় কাজে লাগাতে পারবে।
অবশ্য জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ভারতের নতুন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত বলছেন, বাজেটগত সীমাবদ্ধতার কারণে নৌবাহিনীকে তার তৃতীয় বিমানবাহী রণতরীর পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন যে এ ধরনের বাজে ব্যয় বহন করার মতো অবস্থা ভারতের নেই।কারণ আরো কিছু প্রয়োজন এখনই মেটাতে হবে।
রাশিয়ার কাছ থেকে সংগ্রহ করা বিক্রামাদিত্য নিয়ে ভারতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এই ধারণা আরো জোরদার হয়েছে। ওই সময় মূল মূল্য ৯৭৪ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে হয় ২.৩৫ বিলিয়ন ডলার। আর ৪৫টি মিগ-২৯ কে বিমান ও অধিকতর সংস্কারের ফলে সার্বিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ছয় থেকে সাত বিলিয়ন ডলারে।
ভারতে প্রথম নির্মিত বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্তের বিলম্ব হওয়া ও ব্যয় বাড়ায় বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়ে। এটি ইতোমধ্যেই নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর পিছিয়ে পড়েছে। খরচ বৃদ্ধি এবং ৩৬টি বিমান নিয়ে এর ব্যয় হবে মোট ১০ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয়টি তথা বিশাল এখনো রয়েছে রূপরেখাতেই। এর ব্যয় হবে ৬-৮ বিলিয়ন ডলার, সময় লাগবে ১০-১৪ বছর। আর এফ-১৮ই বা রাফাল যদি বর্তমান মূল্যেই সংগ্রহ করা হয়, তবে মোট ব্যয় হতে পারে ১৬-১৭ বিলিয়ন ডলার।
জেনারেল রাওয়াত আগামী কয়েক বছর বাজেটগত সীমাবদ্ধতার আলোকে তার অগ্রাধিকার নির্ধারণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্থল প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছেন। অর্থাৎ তার প্রথম অগ্রাধিখার সেনাবাহিনী, তারপর বিমানবাহিনী। সেনাবাহিনী জরুরিভিত্তিতে পদাতিক সরঞ্জাম, আর্টিলারির কথা বলেছে, তাছাড়া স্ট্রাইক কোরের আধুনিকায়নও প্রয়োজন। ভারতীয় বিমান বাহিনীর স্কয়াড্রোনের শক্তি হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৩২। অথচ প্রয়োজন ৪২ স্কয়াড্রোন বিমানের। অর্থাৎ তাদের শক্তি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। তার মতে, নৌবাহিনীর উচিত হবে সাবমেরিন ও অন্যান্য অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজের দিকে। আর নজর দিতে হবে রক্ষণাত্মক অবস্থানের ওপর। জেনারেল রাওয়াত হলেন সরকারের সামরিক উপদেষ্টা, নবগঠিত সামরিকবিষয়ক বিভাগের সচিব, এবং সেইসাথে চিফস অব স্টাফ কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান পদ তো আছেই। ফলে জেনারেল রাওয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই গুরুত্ব পাবে।
ভারতের উদীয়মান মর্যাদা, তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিট নিরাপত্তা যোগানদাতা হিসেবে তার ভূমিকার কারণে তার নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে ক্যারিয়ারভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে।আর চীন যেহেতু তার বিমানবাহী শক্তি বাড়াচ্ছে, কাজেই ভারতকেও যত দ্রুত সম্ভব এ দিকে নজর দিতে হবে। ফলে ভারতের সামুদ্রিক কৌশলে তৃতীয় ক্যারিয়ারের প্রয়োজন অতীব।
নৌবাহিনী প্রায় চার দশক ধরে স্কাই-জাম্প ক্যারিয়ার ব্যবহার করছে। এতে ব্যয় কম হলেও অপারেশন পরিচালনায় নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে এর। সাবমেরিনবিধ্বংসী যুদ্ধ ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনের সময় বিক্রামাদিত্য সর্বোচ্চ ২৪টি মিগ-২৯ কে জঙ্গিবিমান ও ছয়টি হেলিকপ্টার চালাতে পারে। বিক্রামাদিত্যের অন্তত ৭০ ভাগ শক্তি ব্যয় হয় আত্মরক্ষার জন্য। ফলে দূরপাল্লার হামলা চালানোর জন্য শক্তি থাকে সামান্যই। বিক্রান্তর অবস্থান হবে অনেক কম। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্কাই-জাম্প ক্যারিয়ার আগাম হুঁশিয়ারি বিমানের মতো আরো ভারী প্লাটফর্ম নিক্ষেপে বেশ সমস্যায় পড়ে যায়।
প্রস্তাবিত আইএনএস বিশাল হবে ফ্ল্যাট-টপ ক্যারিয়ার। এতে থাকবে ক্যাটাপুল্ট সক্ষমতা। এতে ৭০-৮০টি বিমান এবং আগাম হুঁশিয়ারি বিমানের মতো আরো ভারী প্লাটফর্মও থাকতে পারবে। ফলে তার আক্রমণ করার সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। ভারত সরকার এই প্রয়োজনের আলোকে ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারে।
আবার নতুন নতুন ধারণা ও প্রযুক্তিও আসছে। এগুলো অর্থনৈতিক ও বিমানবাহী রণতরীর পরিচালনাগত অবস্থানকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে। নতুন প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের ফলে আরো ক্ষিপ্র, দ্রুতগতির জাহাজ, সাবমেরিন, ড্রোনের বিকাশ ঘটাতে পারে। ফলে বিমানবাহী রণতরীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে।
চীনের বিরুদ্ধে উত্তেজনার বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু ভারত সরকার সিদ্ধান্ত দিতে দেরি করার প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্তটি নৌবাহিনীর অনুকূলে নাও থাকতে পারে।
সূত্র : দি ইন্টারপ্রেটার