শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের টানাটানি
শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের টানাটানি - ছবি : সংগৃহীত
৮ অক্টোবর চীনের সেন্ট্রাল ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিশন অফিসের ডিরেক্টর ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত ইয়াং জিয়েশির নেতৃত্বে চীনের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। চারটি দেশে সফর করবে এই প্রতিনিধি দল। অন্য তিনটি দেশ হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়া ও সার্বিয়া। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আন্তর্জাতিক সফরের উপর বিধিনিষেধ আরোপের পর এই প্রথম কোন চীনা প্রতিনিধি দল শ্রীলংকা সফরে গেলো। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, শ্রীলঙ্কার মাধ্যমেই চার দেশের সফর শুরু করেছেন ইয়াং।
ইয়াংয়ের সাথে রাজাপাকসা ভাইদের – প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া – বৈঠকের ফল বেশ ইতিবাচক হয়েছে। দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার হয়েছে এবং কৌশলগত সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। বৈঠকে চীনের জন্য দরজা খুলে দেয়া হয়েছে, যাতে দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে বেল্ট অ্যাণ্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য খোলাসা করতে পারে। শ্রীলংকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আলাইনা তেপলিজ এর আগে এই প্রকল্পগুলোর প্রকৃতি এবং এর পেছনের টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
ইয়াংয়ের সফরের পর ১১ অক্টোবর চীন ঘোষণা দিয়েছে যে, শ্রীলংকার গ্রামীণ এলাকায় মেডিকেল সেবা খাত, পানি সরবরাহ, এবং শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য ৯০ মিলিয়ন ডলার অনুমান দেয়া হবে। কলম্বোর চীনা দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে যে, “কোভিড পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কানদের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে এই অনুদান”।
ইয়াংয়ের সফরের পর চীন আর শ্রীলঙ্কা যখন তাদের সাফল্য উদযাপন করছে, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র দেশটির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। সানডে টাইমস জানিয়েছে সামনের সপ্তাহগুলোতে নয়াদিল্লি যাওয়ার পথে শ্রীলঙ্কা সফর করবেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। তার সম্ভাব্য সফর এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, শ্রীলঙ্কা আর চীনের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন, এবং তারা এখানে তাদের স্বার্থ নষ্ট হতে দিতে চায় না।
পম্পেও এই আশা নিয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে আসছেন যে, দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে তারা তাদের আঞ্চলিক পরিকল্পনার সাথে যুক্ত করতে পারবে, কারণ ভারত মহাসাগর অঞ্চলে শ্রীলঙ্কার অবস্থানগত গুরুত্ব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস তাদের ইন্দো-প্রশান্ত কৌশলের জন্য শ্রীলঙ্কা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হবে। শ্রীলঙ্কার পাশ দিয়ে যাওয়া সমুদ্র পথকে পৃথিবীর ব্যস্ততম বাণিজ্য রুট মনে করা হয় এবং বিশ্বের মোট তেল বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই এই পথে পরিবাহিত হয়।
২০১৫ সালে জন কেরির সফরের পর পম্পেওয়ের সফরই হবে শ্রীলঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের সফর। এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ৪৮০ মিলিয়ন ডলারের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশান (এমসিসি) অনুদান এবং স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট (সোফা) চুক্তি নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নেয়া। অনেক বিশ্লেষক মত দিয়েছেন যে, এই চুক্তিগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী হবে এবং চীনের প্রভাব কমে যাবে। কিন্তু একই সাথে এটা আবার শ্রীলংকাকে একটা জটিল জায়গায় নিয়ে যাবে।
২০১৯ সালের জুনে পম্পেও শ্রীলঙ্কা সফরের পরিকল্পনা বাতিল করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক সহযোগিতার ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান বিরোধীতা নিয়ে সৃষ্টি উদ্বেগের কারণে তিনি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
শ্রীলঙ্কার সাথে উপরোক্ত চুক্তিগুলো করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ হলো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তারা তাদের অবস্থানকে আরো মজবুত করতে চায়, চীনের প্রভাবকে তারা মোকাবেলা করতে চায় এবং চীনের তৎপরতার উপর নজরদারি করতে চায়। এই সব কর্মকাণ্ডে ভারতকে তারা অংশীদার হিসেবে সাথে রাখবে বলেও ধারনা করা যায়।
এখন দেখার বিষয় হলো শ্রীলঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে স্বাগত জানায় কি না, এবং চীনের সাথে সম্পর্ককে নষ্ট না করে কিভাবে তারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে দর কষাকষি করে। পম্পেওয়ের আসন্ন সফরের ফল নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন একটি মিডিয়া নিবন্ধে শ্রীলঙ্কা প্রশাসনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন যে, পম্পেওয়ের সফরকালে এমসিসি ও সোফা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার সামনে নত হওয়ার কোন পরিকল্পনা দেশের নেই।
ওই কর্মকর্তা বলেন, “প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা যে গুনারুয়ান কমিটি গঠন করেছেন, তারা এমসিসি পর্যালোচনা করে জানিয়েছে যে, শ্রীলংকার সংবিধান ও আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার জন্য এখানে সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। এখন দেখার বিষয়, আমেরিকা সেখানে একমত হয় কি না। সোফার বিষয়টি এখন আমরা বিবেচনাতেই নিচ্ছি না, কারণ একটি করে ইস্যু নিয়ে আমরা এগুতে চাই”।
সূত্র : এসএএম