আপাত দৃষ্টিতে কিরগিজস্তানে সপ্তাহব্যাপী রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও টানাপড়েনের পর রুশপন্থী প্রেসিডেন্টের সমর্থনপুষ্ট সরকার তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন। কিরগিজস্তানের সংসদ নতুন প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সুরনবায়ে জিনবেকভ সমর্থনপুষ্টরা ক্ষমতার ভিতকে পোক্ত করেছেন। প্রেসিডেন্টের প্রধান বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত, সাবেক প্রেসিডেন্ট আলমাজবেক আতামবায়েভকে কারাগার থেকে ছাড়ার কয়েকদিন পরই আবার গ্রেফতার করা হয়েছে।

গত ৪ অক্টোবর বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই মধ্য এশিয়ার এই দেশটি অস্থিরতার কবলে পড়ে। যেখানে প্রতিষ্ঠিত দলগুলো একটি বড় বিজয় দাবি করেছে। কিন্তু ‘ভোট কেনা’র ব্যাপক অভিযোগ ও বিক্ষোভের মধ্যে গত সপ্তাহে নির্বাচন কমিশন ফলাফল অবৈধ ঘোষণা করে। বিক্ষোভকারীরা রাজধানী বিশকেকের সরকারি ভবনগুলোতে হামলা চালিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট আতামবায়েভকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। সেখানে তিনি দুর্নীতির দায়ে দীর্ঘমেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা বলেছেন, আতামবায়েভ শুক্রবার একটি হত্যাকাণ্ডের চেষ্টা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, তবে রাজ্য নিরাপত্তা কমিটি অস্থিরতা প্ররোচিত করার অভিযোগে শনিবার সাবেক প্রেসিডেন্টকে আবার গ্রেফতার করে। সাবেক প্রেসিডেন্ট আতামবায়েভ হলেন জিনবেকভের সাবেক পৃষ্ঠপোষক এবং এখন তার প্রতিপক্ষ। শনিবার আটক হওয়া অন্যদের মধ্যে সাবেক উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কুরসান আসানভ ছিলেন যিনি অস্থিরতা শুরু হওয়ার পরে মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

পরের দিন, সংসদে প্রেসিডেন্ট জিনবেকভের মিত্ররা ৫১ বছর বয়সী সাদির ঝাপারভকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। এর একদিন পরে প্রেসিডেন্ট জিনবেকভ সেনাবাহিনীকে সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের মধ্যে পুনরায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন এবং রাজধানী বিশকেকের আশেপাশে রাতারাতি সেনাচৌকি স্থাপন করা হয়। এর আগে বিক্ষোভকারী কর্মীরা রাজধানীতে টহল দিচ্ছিল।

প্রেসিডেন্ট আগে বলেছিলেন, দনতুন সরকার গঠন করা উচিত; এরপর তিনি পদত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত। নতুন সরকার বিরোধী দলকে সমর্থনকারী নিরাপত্তা পরিষদের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও বরখাস্ত করেছে। বিরোধীরা মঙ্গলবার বলেছিলেন, তারা ক্ষমতা দখল করেছেন।’ নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে তা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
শনিবার রাতে জরুরি অবস্থা কার্যকর করার পর জনসমাবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং কারফিউ জারি করা হয়। এ সময় রাজধানী শান্ত ছিল। প্রতিবাদকারী প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষসহ বেশ কয়েকদিনের অশান্তির পরে আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

সংসদ অধিবেশনে স্পিকার ঘোষণা করেছেন, এই অধিবেশনটিতে জরুরি অবস্থা নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। তবে, পরবর্তী তিন দিনের জন্য জরুরি অবস্থা থাকবে এবং সংসদ যদি এই জরুরি অবস্থা তিন দিনের মধ্যে বাড়ানোর অনুমোদন না দেয় তবে ডিক্রিটি বাতিল হয়ে যাবে।

এর আগে বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবন দখল করে নিলে নির্বাচিত এমপিরা শনিবার বিশকেকের উপকণ্ঠে প্রেসিডেন্ট বাসভবনে ঝাপারভকে ভোট দেয়ার জন্য জড়ো হন। তিনি আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট, কুরমানবেক বাকিয়েভের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের আগে ঝাপারভ নতুন প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সংসদে বলেছিলেন, জিনবেকভ নতুন মন্ত্রিসভা অনুমোদনের পরে তার পদত্যাগের ব্যাপারে তাকে পুনরায় নিশ্চিত করেছেন। সংসদ ঝাপারভের প্রার্থিতার বিষয়ে ভোটের পর স্পিকার মাইকতিবেক আবদিলদায়ায়েভ পদত্যাগ করেছেন, যার অর্থ ঝাপারভও জিনবেকভ পদত্যাগ করলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণ করবেন।

কিরগিজস্তানের বিরোধী গোষ্ঠী স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী ১১টি দলের মধ্যে বিভক্ত। নতুন রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও ‘ক্লিনটেলিজম’ থেকে মুক্ত থেকে নতুন ধারার রাজনীতির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল।

মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে যে ক’টিতে তুলনামূলকভাবে মুক্ত গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছিল তার মধ্যে শীর্ষে ছিল কিরগিজস্তান। চীনের সীমান্ত ঘেঁষা এই দেশটিতে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগকে কেন্দ্র করে এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। অপরদিকে, সরকার গঠনের পর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট।

গত সোমবার প্রেসিডেন্ট অফিস জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে সংসদ ও প্রেসিডেন্টের প্রশাসন ভবনের নিয়ন্ত্রণ কিরগিজ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ফিরে পেয়েছে। কিরগিজ প্রেসিডেন্ট সুরনবায়ে জিনবেকভ জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। তার দফতরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সংসদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নতুন ডিক্রিতে বলা হয়েছে, জরুরি অবস্থা এখন কার্যকর হবে। তবে, সংসদ যদি এই ডিক্রি অনুমোদন করতে ব্যর্থ হয়, তবে জরুরি অবস্থা ১৫ অক্টোবর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তুলে নেয়া হবে।

কিরগিজস্তানের এই অস্থিরতা রাশিয়ার উদ্বেগকে আরো গভীর করেছে। বেলারুসে রাজনৈতিক বিদ্রোহের পর এবং বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে নতুন সশস্ত্র সঙ্ঘাতের পর এটি দেখা দিয়েছে।

রোববারের নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট জিনবেকভের সাথে কেনার অভিযোগকারীরা জোট বাঁধার পর বিদ্রোহ শুরু হলে ক্রেমলিন বলেছে, অস্থিরতা নিয়ে আলোচনা করতে রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিচালক আলেকজান্ডার বোর্তনিকভ কিরগিজ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সচিব ওমুরবেক সুভানালিয়েভের সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘পরিস্থিতি গোলমেলে এবং বিশৃঙ্খলার মতো দেখাচ্ছে’। রাশিয়া ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।’
প্রায় সাড়ে ছয় মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ কিরগিজস্তান কৌশলগতভাবে রাশিয়া এবং চীনের মধ্যেকার এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে বেইজিং ও মস্কো ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য প্রতিযোগিতা করে থাকে। এখানে একটি রাশিয়ান সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং কানাডার মালিকানাধীন একটি সোনার খনিও এখানে রয়েছে।

কিরগিজস্তান, মধ্য এশিয়ার অনেক অংশের মতো মস্কো এবং বেইজিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক চাপের মধ্যে রয়েছে। দেশটি এশিয়ার পশ্চিমভাগের একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। এর উত্তরে কাজাখস্তান, পূর্বে গণচীন, দক্ষিণে গণচীন ও তাজিকস্তান এবং পশ্চিমে উজবেকিস্তান। কিরগিজরা একটি মুসলিম তুর্কি জাতি যারা কিরগিজ তুর্কি ভাষায় কথা বলে। এরা কিরগিজস্তানের জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশ। এর বাইরে ১৪ শতাংশ উজবেক ও ৬ শতাংশের মতো রুশ জাতিগোষ্ঠীর লোক রয়েছে দেশটিতে।

১৯ শ’ শতকের শেষের দিকে কিরগিজস্তান রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। ১৯২৪ সালে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা পায়। ১৯৩৬ সালে এটিকে একটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৯১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। কিরগিজস্তানের জনসংখ্যা ৬২ লাখ। এর মধ্যে ৮৩ শতাংশ মুসলিম এবং তাদের বেশির ভাগই সুন্নি। কিরগিজস্তানের সরকারি ভাষা কিরগিজ। এই ভাষাতে কিরগিজস্তানের অর্ধেকের বেশি লোক কথা বলে। প্রায় ১৬ শতাংশ লোক রুশ ভাষায় কথা বলে থাকে।
কিরগিজস্তানের রাজনীতি একটি অর্ধ-প্রেসিডেন্টশাসিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় চলছে। প্রেসিডেন্ট হলেন দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান আর সরকারপ্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের ওপর ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার এবং আইনসভা উভয়ের ওপর ন্যস্ত।

এই সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে ক্রেমলিনের ঐতিহাসিক কক্ষপথের অংশ হিসেবে রাশিয়া দেখে। ২০১৪ সালে দেশটির পার্লামেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরবরাহ ও জ্বালানি পুনর্ভরণের জন্য ব্যবহৃত একটি ঘাঁটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। তবে রাশিয়া কিরগিজস্তানে একটি বিমান ঘাঁটি বজায় রাখে।
এবার বিক্ষোভকারীরা চীনা মালিকানাধীন স্বর্ণের খনিগুলোকে লক্ষ করছে মর্মে খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেইজিং। চীনা সীমান্তযুক্ত কিরগিজস্তান বেইজিংয়ের সাথে বাণিজ্যের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল এবং চীনের রফতানি-আমদানি ব্যাংকের কাছে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন ডলার ঋণী যা কিরগিজস্তানের বৈদেশিক ঋণের অর্ধেকের কাছাকাছি।

অন্য দিকে, রাশিয়া বিশেষত বেলারুসের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে টেকসই বিক্ষোভের অভিজ্ঞতার কারণে কিরগিজস্তানে জনঅভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে। মস্কোতে, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিরগিজস্তানের সব পক্ষকে ‘আলোচনার মাধ্যমে এবং শক্তি প্রয়োগ না করেই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে।’ রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে আরো বলেছে, ‘রাশিয়া তার কৌশলগত অংশীদার ও মিত্র কিরগিজস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায় এবং সে দেশের সব ব্যক্তির নিরাপত্তা ও কল্যাণে আগ্রহী।’

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে ৩০ বছরের পুরনো সঙ্ঘাত নতুন করে শুরু হওয়া এবং আগস্টে বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফলের পর, বেলারুসে বিক্ষোভের পর ক্রেমলিনের মিত্র দেশগুলোতে রাশিয়াকে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছে। কার্নেগি মস্কো কেন্দ্রের পরিচালক দিমিত্রি ত্রেনিন টুইটারে লিখেছেন, এই অগ্রগতিগুলো ‘সোভিয়েত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর ভঙ্গুরতা’ এবং ‘আঞ্চলিক প্রভাবক শক্তি’ হিসেবে রাশিয়ার ভূমিকার সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।

কিরগিজস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলমাজবেক আতামবায়েভ ২০১৪ সালে বিশকেকের কাছে মার্কিন একটি সামরিক স্থাপনা বন্ধ করে দেয়ার পর থেকে ওয়াশিংটনের প্রভাব দেশটিতে কমে গেছে যদিও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানকে সমর্থন করেছিল কিরগিজরা। নতুন পরিস্থিতির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের হারানো প্রভাব ফিরে পাওয়ার কোনো বিষয় যুক্ত কি না তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেন।

উল্লেখ্য, দুটি নতুন আঞ্চলিক উদ্যোগ মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক ভূ-দৃশ্যকে রূপান্তর করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং প্রবর্তিত চীনের সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্টের (এসআরইবি) আওতায় পরিবহন ও শিল্পে বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ শুরু করা হয় এই অঞ্চলে। এর মাধ্যমে পুরো অঞ্চলজুড়ে মুক্তবাণিজ্য সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি রাখা হয়েছে। অন্য দিকে, ২০১৫ সালে রাশিয়ার নেতৃত্বে ইউরেশিয়ান অর্থনৈতিক ইউনিয়ন (ইইইউ) প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি শুল্ক ইউনিয়ন তৈরি করা হয় এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে। এই দুই উদ্যোগে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য থাকলেও রাশিয়া ও চীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।

চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের আশেপাশে নিরাপত্তার একটি অঞ্চল তৈরি করার সময় তার বিশাল মহাদেশীয় গিরিখাতজুড়ে চীনের জন্য বাণিজ্যপথ উন্মুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বহু বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়া এবং এর ওপারে ইরান, রাশিয়া, ককেশাস, তুরস্ক ও ইউরোপের সাথে রেল ও সড়ক সংযোগ রয়েছে। চীন এই অঞ্চলজুড়ে একটি মুক্ত-বাণিজ্যচুক্তির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অনুসরণে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভূখণ্ড, প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক বাধা হ্রাস করার লক্ষ্য নিয়েছে। তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের মতো দরিদ্র দেশগুলো তাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে কৃষি ও শিল্পে বিনিয়োগের প্রত্যাশা করে। এই পরিকল্পনার একটি কৌশলগত ও আদর্শিক দিকও রয়েছে, যা চীনা রাজনৈতিক প্রভাবকে প্রসারিত করে এবং একটি রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন উন্নয়নের মডেলকে প্রচার করে থাকে। যদি এটি সফল হয় তবে এটি নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলায় প্রথম পদক্ষেপ সৃষ্টি করতে পারে যেখানে চীন অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

চীনা পরিকল্পনা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। মধ্য এশীয় অভিজাতরা অর্থায়নের আগমনকে স্বাগত জানালেও চীনা বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই জনগণের সন্দেহ সংশয়ের মুখোমুখি। চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য জমি নিয়ে যাওয়ার গুজবে কাজাখস্তানে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। ২০১৬ সালের আগস্টে বিশকেকের চীনা দূতাবাসে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলা নিরাপত্তা সংক্রান্ত দুর্বলতার বিষয়ে বেইজিংয়ে আশঙ্কা জাগিয়ে তোলে। অনেক বিনিয়োগ সাধারণ জনগণের উপকার করে না এবং উচ্চ স্তরের দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগও রয়েছে। জাতীয়তাবাদ, দুর্নীতি ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে ক্ষোভের এই সংমিশ্রণ মধ্য এশিয়ায় চীনবিরোধী এবং একই সাথে সরকারবিরোধী সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তুলতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।

এসআরইবি রাশিয়ার জন্যও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। ২০১৪ সালের মে মাসে, রাশিয়া, বেলারুস, কাজাখস্তান কিরগিজস্তান এবং আর্মেনিয়া নিয়ে যে ইইইউ গঠন করা হয় তার লক্ষ্য হচ্ছে আমদানিতে শুল্ক আরোপ করার সময় তার সীমান্তের মধ্যে পণ্য, শ্রম, পরিষেবা এবং মূলধনের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা।
তবে এর রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান পরিষ্কার করে বলেছে যে, তারা রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা ব্লক ‘সম্মিলিত সুরক্ষা চুক্তি সংস্থা’য় (সিএসটিও) যোগদান করবে না। আবার এর সদস্যপদ প্রত্যাখ্যানও করবে না। যদিও রাশিয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্য মূল অংশীদার হিসেবে রয়েছে, তবে মধ্য এশিয়ায় চীনের গভীর এবং বহু স্তরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বর্তমানে মস্কোকে ছাড়িয়ে গেছে।

রাশিয়া এবং চীন ইইইউ এবং এসআরইবির মধ্যে সহযোগিতা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। মস্কো ‘বৃহত্তর ইউরেশিয়া’ ধারণাটি প্রচার করেছে, যা একটি চূড়ান্ত প্রকল্প, যা চীন, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়াকে একটি নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্লকের সাথে যুক্ত করবে এবং চীনের সহযোগিতাকে এর অন্তর্নিহিত হিসাবে দেখছে। তবে মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা রয়েছে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্যে বাধা অতিক্রম করা কঠিন হবে। সুতরাং, কাজাখস্তান রাশিয়ান আর চীনা জড়িতদের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পশ্চিমের সাথে শক্তিশালী যোগাযোগ বজায় রাখতে আগ্রহী এবং উজবেকিস্তান তার প্রতিবেশীদের সাথে আরো ভালো সম্পর্ক চাওয়ার লক্ষণ সত্ত্বেও তার সীমানা পেরিয়ে অবাধ বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ করেছে।

মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের একটি সমীকরণও থাকতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য কোভিড-১৯ উত্তর বিশ্বে চীনা প্রভাবকে সীমিত করার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার ব্যাপারে পাশ্চাত্য সংযোগের একটি সন্দেহ চীন এবং রাশিয়া দুই দেশেরই রয়েছে। এ কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাশিয়াকে নেপথ্যে বেশ উদ্যোগী দেখা গেছে। তবে কিরগিজ রাজনৈতিক সঙ্কটের দ্রুত অবসান ঘটে যাবে এমনটি মনে হয় না।

mrkmmb@gmail.com