কিরগিজস্তানে চীন-রাশিয়া লড়াই
পুতিন ও শি - ছবি সংগৃহীত
কিরগিজস্তান, মধ্য এশিয়ার অনেক অংশের মতো মস্কো এবং বেইজিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক চাপের মধ্যে রয়েছে। দেশটি এশিয়ার পশ্চিমভাগের একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। এর উত্তরে কাজাখস্তান, পূর্বে গণচীন, দক্ষিণে গণচীন ও তাজিকস্তান এবং পশ্চিমে উজবেকিস্তান। কিরগিজরা একটি মুসলিম তুর্কি জাতি যারা কিরগিজ তুর্কি ভাষায় কথা বলে। এরা কিরগিজস্তানের জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশ। এর বাইরে ১৪ শতাংশ উজবেক ও ৬ শতাংশের মতো রুশ জাতিগোষ্ঠীর লোক রয়েছে দেশটিতে।
১৯ শ’ শতকের শেষের দিকে কিরগিজস্তান রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। ১৯২৪ সালে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা পায়। ১৯৩৬ সালে এটিকে একটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৯১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। কিরগিজস্তানের জনসংখ্যা ৬২ লাখ। এর মধ্যে ৮৩ শতাংশ মুসলিম এবং তাদের বেশির ভাগই সুন্নি। কিরগিজস্তানের সরকারি ভাষা কিরগিজ। এই ভাষাতে কিরগিজস্তানের অর্ধেকের বেশি লোক কথা বলে। প্রায় ১৬ শতাংশ লোক রুশ ভাষায় কথা বলে থাকে।
কিরগিজস্তানের রাজনীতি একটি অর্ধ-প্রেসিডেন্টশাসিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় চলছে। প্রেসিডেন্ট হলেন দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান আর সরকারপ্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের ওপর ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার এবং আইনসভা উভয়ের ওপর ন্যস্ত।
এই সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে ক্রেমলিনের ঐতিহাসিক কক্ষপথের অংশ হিসেবে রাশিয়া দেখে। ২০১৪ সালে দেশটির পার্লামেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরবরাহ ও জ্বালানি পুনর্ভরণের জন্য ব্যবহৃত একটি ঘাঁটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। তবে রাশিয়া কিরগিজস্তানে একটি বিমান ঘাঁটি বজায় রাখে।
এবার বিক্ষোভকারীরা চীনা মালিকানাধীন স্বর্ণের খনিগুলোকে লক্ষ করছে মর্মে খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেইজিং। চীনা সীমান্তযুক্ত কিরগিজস্তান বেইজিংয়ের সাথে বাণিজ্যের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল এবং চীনের রফতানি-আমদানি ব্যাংকের কাছে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন ডলার ঋণী যা কিরগিজস্তানের বৈদেশিক ঋণের অর্ধেকের কাছাকাছি।
অন্য দিকে, রাশিয়া বিশেষত বেলারুসের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে টেকসই বিক্ষোভের অভিজ্ঞতার কারণে কিরগিজস্তানে জনঅভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে। মস্কোতে, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিরগিজস্তানের সব পক্ষকে ‘আলোচনার মাধ্যমে এবং শক্তি প্রয়োগ না করেই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে।’ রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে আরো বলেছে, ‘রাশিয়া তার কৌশলগত অংশীদার ও মিত্র কিরগিজস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায় এবং সে দেশের সব ব্যক্তির নিরাপত্তা ও কল্যাণে আগ্রহী।’
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে ৩০ বছরের পুরনো সঙ্ঘাত নতুন করে শুরু হওয়া এবং আগস্টে বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফলের পর, বেলারুসে বিক্ষোভের পর ক্রেমলিনের মিত্র দেশগুলোতে রাশিয়াকে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছে। কার্নেগি মস্কো কেন্দ্রের পরিচালক দিমিত্রি ত্রেনিন টুইটারে লিখেছেন, এই অগ্রগতিগুলো ‘সোভিয়েত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর ভঙ্গুরতা’ এবং ‘আঞ্চলিক প্রভাবক শক্তি’ হিসেবে রাশিয়ার ভূমিকার সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।
কিরগিজস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলমাজবেক আতামবায়েভ ২০১৪ সালে বিশকেকের কাছে মার্কিন একটি সামরিক স্থাপনা বন্ধ করে দেয়ার পর থেকে ওয়াশিংটনের প্রভাব দেশটিতে কমে গেছে যদিও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানকে সমর্থন করেছিল কিরগিজরা। নতুন পরিস্থিতির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের হারানো প্রভাব ফিরে পাওয়ার কোনো বিষয় যুক্ত কি না তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেন।
উল্লেখ্য, দুটি নতুন আঞ্চলিক উদ্যোগ মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক ভূ-দৃশ্যকে রূপান্তর করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং প্রবর্তিত চীনের সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্টের (এসআরইবি) আওতায় পরিবহন ও শিল্পে বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ শুরু করা হয় এই অঞ্চলে। এর মাধ্যমে পুরো অঞ্চলজুড়ে মুক্তবাণিজ্য সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি রাখা হয়েছে। অন্য দিকে, ২০১৫ সালে রাশিয়ার নেতৃত্বে ইউরেশিয়ান অর্থনৈতিক ইউনিয়ন (ইইইউ) প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি শুল্ক ইউনিয়ন তৈরি করা হয় এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে। এই দুই উদ্যোগে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য থাকলেও রাশিয়া ও চীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের আশেপাশে নিরাপত্তার একটি অঞ্চল তৈরি করার সময় তার বিশাল মহাদেশীয় গিরিখাতজুড়ে চীনের জন্য বাণিজ্যপথ উন্মুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বহু বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়া এবং এর ওপারে ইরান, রাশিয়া, ককেশাস, তুরস্ক ও ইউরোপের সাথে রেল ও সড়ক সংযোগ রয়েছে। চীন এই অঞ্চলজুড়ে একটি মুক্ত-বাণিজ্যচুক্তির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অনুসরণে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভূখণ্ড, প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক বাধা হ্রাস করার লক্ষ্য নিয়েছে। তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানের মতো দরিদ্র দেশগুলো তাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে কৃষি ও শিল্পে বিনিয়োগের প্রত্যাশা করে। এই পরিকল্পনার একটি কৌশলগত ও আদর্শিক দিকও রয়েছে, যা চীনা রাজনৈতিক প্রভাবকে প্রসারিত করে এবং একটি রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন উন্নয়নের মডেলকে প্রচার করে থাকে। যদি এটি সফল হয় তবে এটি নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলায় প্রথম পদক্ষেপ সৃষ্টি করতে পারে যেখানে চীন অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
চীনা পরিকল্পনা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। মধ্য এশীয় অভিজাতরা অর্থায়নের আগমনকে স্বাগত জানালেও চীনা বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই জনগণের সন্দেহ সংশয়ের মুখোমুখি। চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য জমি নিয়ে যাওয়ার গুজবে কাজাখস্তানে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। ২০১৬ সালের আগস্টে বিশকেকের চীনা দূতাবাসে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলা নিরাপত্তা সংক্রান্ত দুর্বলতার বিষয়ে বেইজিংয়ে আশঙ্কা জাগিয়ে তোলে। অনেক বিনিয়োগ সাধারণ জনগণের উপকার করে না এবং উচ্চ স্তরের দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগও রয়েছে। জাতীয়তাবাদ, দুর্নীতি ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে ক্ষোভের এই সংমিশ্রণ মধ্য এশিয়ায় চীনবিরোধী এবং একই সাথে সরকারবিরোধী সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তুলতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
এসআরইবি রাশিয়ার জন্যও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। ২০১৪ সালের মে মাসে, রাশিয়া, বেলারুস, কাজাখস্তান কিরগিজস্তান এবং আর্মেনিয়া নিয়ে যে ইইইউ গঠন করা হয় তার লক্ষ্য হচ্ছে আমদানিতে শুল্ক আরোপ করার সময় তার সীমান্তের মধ্যে পণ্য, শ্রম, পরিষেবা এবং মূলধনের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা।
তবে এর রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান পরিষ্কার করে বলেছে যে, তারা রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা ব্লক ‘সম্মিলিত সুরক্ষা চুক্তি সংস্থা’য় (সিএসটিও) যোগদান করবে না। আবার এর সদস্যপদ প্রত্যাখ্যানও করবে না। যদিও রাশিয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্য মূল অংশীদার হিসেবে রয়েছে, তবে মধ্য এশিয়ায় চীনের গভীর এবং বহু স্তরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বর্তমানে মস্কোকে ছাড়িয়ে গেছে।
রাশিয়া এবং চীন ইইইউ এবং এসআরইবির মধ্যে সহযোগিতা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। মস্কো ‘বৃহত্তর ইউরেশিয়া’ ধারণাটি প্রচার করেছে, যা একটি চূড়ান্ত প্রকল্প, যা চীন, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়াকে একটি নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্লকের সাথে যুক্ত করবে এবং চীনের সহযোগিতাকে এর অন্তর্নিহিত হিসাবে দেখছে। তবে মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা রয়েছে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্যে বাধা অতিক্রম করা কঠিন হবে। সুতরাং, কাজাখস্তান রাশিয়ান আর চীনা জড়িতদের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পশ্চিমের সাথে শক্তিশালী যোগাযোগ বজায় রাখতে আগ্রহী এবং উজবেকিস্তান তার প্রতিবেশীদের সাথে আরো ভালো সম্পর্ক চাওয়ার লক্ষণ সত্ত্বেও তার সীমানা পেরিয়ে অবাধ বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ করেছে।
মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের একটি সমীকরণও থাকতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য কোভিড-১৯ উত্তর বিশ্বে চীনা প্রভাবকে সীমিত করার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার ব্যাপারে পাশ্চাত্য সংযোগের একটি সন্দেহ চীন এবং রাশিয়া দুই দেশেরই রয়েছে। এ কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাশিয়াকে নেপথ্যে বেশ উদ্যোগী দেখা গেছে। তবে কিরগিজ রাজনৈতিক সঙ্কটের দ্রুত অবসান ঘটে যাবে এমনটি মনে হয় না।
mrkmmb@gmail.com