আফগানিস্তানে চীনা পরিকল্পনা
আফগানিস্তানে চীনা পরিকল্পনা - ছবি সংগৃহীত
আফগানিস্তানের আন্তঃআফগান আলোচনা চলার মধ্যেই তালেবান ব্যস্ত রয়েছে আলাদা চুক্তি করার জন্য, ওই চুক্তি তারা করতে চাচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় উভয়ের সাথে। কাজটি তারা করছে যুদ্ধ-পরবর্তী আফগানিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীনের সাথে চুক্তি করার মাধ্যমে তালেবান নিজেদেরকে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তালেবান ও চীন আলোচনা করছে। আফগানিস্তানে তালেবানের শান্তির নিশ্চয়তার বিনিময়ে চীন সড়ক নেটওয়ার্ক ও জ্বালানি প্রকল্প নির্মাণের জন্য ভালো পরিমাণ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণের জন্য যোগাযোগ, বাণিজ্য ও জ্বালানি চ্যানেল অপরিহার্য উপাদান বিবেচিত হচ্ছে।
সর্বজনস্বীকৃত বিষয় হলো, আফগানিস্তানে চীনের রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ফলে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের বর্তমান প্রস্তাব অনুযায়ী বোঝা যাচেছ যে দেশটি তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) ও চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (সিপিইসি) আফগানিস্তানকে একীভূত করতে চাচ্ছে।
অন্য কথায় বলা যায়, আন্তঃআফগান আলোচনা অব্যাহত থাকার মধ্যেই তালেবান ও চীন ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করছে, আফগানিস্তানের বহুল প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের ভিত্তি প্রস্তুত করছে।তালেবান/আফগানিস্তান প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই চীন আলোচনা করছে, বিষয়টি এমন নয়। চীনের সিল্ক রোডের ওপর আফগানিস্তানের অব্স্থান। এটি সেন্ট্রাল এশিয়ান স্ট্রেটসের (সিএএস)সাথে সরাসরি ভূখণ্ডগত সংযোগ এবং সিএএস থেকে চীনে তেল ও গ্যাস রফতানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই সময়ে আফগানিস্তানের আরেক প্রত্যক্ষ প্রতিবেশী হলো ইরান। শান্তিপ্রক্রিয়ায় তাদেরকেও শান্তিপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সতর্কভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের জন্য এটি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা। কারণ তালেবানের সাথে ইরানের একত্রিত হওয়া মানে ভবিষ্যতে চীন নিজেকে আফগানিস্তানের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া- দুই দিকের সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করতে পারবে। পাকিস্তান (দক্ষিণ এশিয়া) ইতোমধ্যেই সিপিইসির মাধ্যমে চীনের সাথে সংযোজিত হয়ে যাওয়ায় পুরো এশিয়ায় জোরালো উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার চীনের মাস্টার প্লানটি এখন বাস্তবায়িত হতে খুব দেরি নেই।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, চীনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তালেবান ইঙ্গিত দিয়েছে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই শান্তির চীনা ভাষ্যটি তারা গ্রহণ করতে আগ্রহী।
অর্থাৎ তালেবান উন্নয়নের মাধ্যমে শান্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আফগানিস্তানে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট বহাল থাকায় সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। এই সমস্যা যত দিন আফগানিস্তানে থাকবে, শান্তি তত দিন সোনার হরিণই থেকে যাবে।
তালেবান এসব সংগঠনের অনিয়ন্ত্রিত উপস্থিতির ভয়াবহ বিপদ বুঝতে পারছে। তবে কোনো কোনো মিডিয়ার খবরে বলা হয়, তারা তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), আল-কায়দা ও ইসলামিক স্টেটের মতো গ্রুপগুলোর সাথে কথা বলছে। আর এই প্রক্রিয়ায় তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে।
ফলে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আফগান তালেবান বাধ্যতামূলক করেছে যে বিদেশী উগ্রবাদীদেরকে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। বিদেশী উগ্রবাদীদের প্রতিশ্রুতি দিতে বলা হয়েছে যে তারা নতুন যোদ্ধা রিক্রুট করতে পারবে না, তালেবানের নির্ধারিত স্থানে তাদের থাকতে হবে, তাদের চলাচল সম্পর্কে তালেবানকে অবহিত করতে হবে।
টিটিপি নিয়ে চীনের সরাসরি উদ্বেগ না থাকলেও আল-কায়েদা ও আইএস (চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্যই) উদ্বেগের বিষয়, তাদের উপস্থিতি ও তৎপরতা পুরো প্রক্রিয়াকে ভণ্ডুল করে দিতে পারে।
এসব গ্রুপের ওপর তালেবানের চাপ সৃষ্টির একটি প্রভাব সম্ভবত অনুভূত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তির কথা উল্লেখ করেননি। আগের বিবৃতিগুলোর বিপরীতে সর্বশেষ বিবৃতিতে পরিকল্পিতভাবেই আফগানিস্তানের উল্লেখ বাদ দেয়ায় মনে হচ্ছে যে তারা নীরবে চলমান শান্তিপ্রক্রিয়া মেনে নিয়েছে।
চীনের জন্য এসব ঘটনা উৎসাহব্যঞ্জক। তারা এখন এটাকে তালেবানের কাছ থেকে শান্তির আগ্রহ হিসেবে ধরে নিয়েছে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে চীন উদ্বিগ্ন। তারা চায় না, আফগানিস্তান দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার উগ্রবাদীদের নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হোক। কারণ, তারা চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
শান্তির বিনিময়ে উন্নয়নের জন্য চীনের সাথে তালেবানের চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তালেবানের চুক্তির চেয়েও বেশি টেকসই প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই আশঙ্কা করছে যে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহার করা মাত্র তালেবান তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গিয়ে আল-কায়েদাকে সমর্থন করতে থাকবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পক্ষ ও আফগানিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রতিবেশী হিসেবে চীনের উপস্থিতি (যা তালেবান বা চীন বদলাতে পারবে না) এসব অরাষ্ট্রীয় উপাদানের ব্যাপারে তালেবানের নিজস্ব নীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। এতে করে আফগানিস্তানের সন্ত্রাসমুক্ত পথে থাকাটা আরো প্রবল হবে।
অর্থাৎ দোহার আন্তঃআফগান প্রক্রিয়ার বাইরে শুরু হওয়া শান্তি দোহা প্রক্রিয়া হিসেবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের সাথে সম্পর্কিত। দোহা প্রক্রিয়ার লক্ষ্য যেখানে আন্তঃদ্বন্দ্ব এড়ানো ও সমাপ্তি করা, তখন বাইরের প্রক্রিয়ার লক্স্য হলো সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটিয়ে উন্নয়ন আনা।এই দুটি প্রক্রিয়া কেবল একে অপরের পরিপূরকই নয়, সেইসাথে আফগানিস্তানের স্থায়ীভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে বের হওয়ার জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।
সূত্র : এসএএম