এবার লাদাখ হচ্ছে নতুন কাশ্মির!
এবার লাদাখ হচ্ছে নতুন কাশ্মির! - ছবি : সংগৃহীত
বিরোধপূর্ণ হিমালয় সীমান্তে ৫ মাস ধরে অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে ভারত ও চীনের হয়তো অস্বস্তিকর নতুন বাস্তবতার প্রয়োজন। তা এই যে ‘পৃথিবীর ছাদ’ স্থায়ীভাবে বিরোধপূর্ণ কাশ্মিরের মতো স্থায়ীভাবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ সামরিক জোনে পরিণত হয়ে গেছে, যেটাকে একসময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান’।
পূর্ব লাদাখে তিক্ত শীত নেমে আসছে। ওই এলাকায় মে মাস থেকে দুই দেশের হাজার হাজার সৈন্য মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে অন্তত ১৮ বার বৈঠক হলেও কোনো সমাধান না হওয়ায় চীন ও ভারত এখন স্থায়ী অচলাবস্থার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বরফ-শীতল অবস্থায় হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েনে লজিস্টিক সমস্যা কাটানো নিয়ে কাজ করছে ভারত। আর চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি থার্মাল শেল্টার দিয়ে তার সৈন্যদের সজ্জিত করেছে।
সোমবার দুই দেশর কোর কমান্ডাররা সপ্তম রাউন্ডের বৈঠকে বসে সৈন্য প্রত্যাহার ও উত্তেজনা হ্রাসের জন্য।
সামরিকবাহিনীর সাবেক সদস্য ও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, উভয়পক্ষের শীত প্রস্তুতিতে বোঝঅ যাচ্ছে, অচলাবস্থা রয়ে গেছে। আর এই সীমান্ত পাকিস্তান ও ভারতকে বিভক্তকারী লাইন অব কন্ট্রোলের (এলওসি) মতো হয়ে পড়ছে।
জম্মু ও কাশ্মিরের মধ্যে থাকা এলওসির ৭৪০ কিলোমিটার (৪৫০ মাইল) এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধের পর। যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও এলওসি এখনো উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত রয়ে গেছে। একে প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে সামরিককরণ করা এলাকা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
দুই পক্ষ প্রায়ই বুলেট ও মর্টার নিক্ষেপ করে, স্নাইপাররা প্রস্তুত হয়ে বসে আছে বিভিন্ন পয়েন্টে। তাছাড়া প্রায়ই মাইন বিস্ফোরিত হয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীল নর্দার্ন কমান্ডের সাবেক প্রধান ও ২০১২-২০১৬ সময়কালে কাশ্মিরে দায়িত্ব পালনকারী লে. জেনারেল (অব.) ডি এস হুদা বলেন, সেখানে মোতায়েন মানে যুদ্ধক্ষেত্রেই থাকা। সবসময়ই থাকে উত্তেজনা।
এলওসির মতো ছিল না চীন ও ভারতের মধ্যকার এলএসি (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল)। এখানকার পরিবেশ ছিল তুলনামূলকভাবে শান্ত। ১৯৬২ সালের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ সত্ত্বেও কোনো পক্ষই এই সীমান্তে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেনি।
মেজর জেনারেল (অব.) অশোক মেহতা বলেন, দুই দেশ শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য কৌশলগত কাঠামো অনুসরণ করেছিল।
তিনি বলেন, এটি ভারত-চীন মডেল নামে পরিচিত। এমনকি সীমান্ত বিরোধও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি।
তিনি বলেন, কিন্তু ওইসব বিষয় এখন বদলে গেছে। এখন ওই কাঠামো ভেঙে পড়ছে।
কাঠামোর পাশাপাশি পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতাও ভেঙে পড়ছে।
মেহতা বলেন, কোনো পক্ষই ফিরে যেতে রাজি নয়। কোনো পক্ষই তাদের দখলে থাকা এলাকা ছাড়তে সম্মত নয়।
তিনি বলেন, এর ফলে উভয়পক্ষই আরো টেকসই, স্থায়ী মোতায়েনের নীতি গ্রহণ করেছে।
হুদা বলেন, অনেক দিক থেকেই এলএসি হতে পারে এলওসির মতো। তবে দুইপক্ষই সম্ভবত বোঝে যে অবস্থার আর অবনতি হতে দেয়া যাবে না।
জওহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর চায়নিস অ্যান্ড সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক ড. গিতা কোচার বলেন, উত্তেজনা বাড়তে না দেয়ার ব্যাপারে দুই পক্ষই একমত বলে আমার মনে হচ্ছে।
অনন্ত অচলাবস্থা
উভয় পক্ষ গত জুন থেকে সামরিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে ১৮ দফা বৈঠক করেছে। উভয় দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা মস্কোতে বৈঠক করেছেন। এস জয়শঙ্কর ও ওয়াঙ ইয়ি বৈঠকের পর দুই দেশ যৌথ ইস্তেহারও দিয়েছিল। তাতে দুই দেশ সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মতও হয়েছি। কিন্তু বাস্তবে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বরং পারস্পরিক সন্দেহ আরো বেড়েছে। গত সোমবার ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং চীনের সমালোচনা করে বলেছেন, দেশটি সীমান্তে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতা করছে। তিনি এলএসির কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য সীমান্ত এলাকায় ৪৪টি সেতু উদ্বোধনের সময় এ মন্তব্য করেন।
গত মাসে চীনা মুখপাত্র ওয়াং উয়েনবিন বলেন, চীন এ ধরনের অবকাঠামা নির্মাণের বিরোধী। এগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সামরিক নিয়ন্ত্রণ।
মেহতা বলেন, অচলাবস্থার নিরসনে সমাধান দেখা যাচ্ছে না। তবে কোচার ততটা হতাশ নন। তিনি বলেন, ১৭ নভেম্বর ব্রিকস সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠকে বসতে পারেন। ততে সমাধান বের হয়ে আসতে পারে।
তবে হুদা বলেন, সৈন্য প্রত্যাহার চুক্তিই সম্ভবত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করবে না। এমনকি কিছু সমঝোতা হলেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে কিছু অবিশ্বাস, অনাস্থা ও সন্দেহ থেকেই যাবে।
সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট