কূটনীতিতে মহানবীর (সা.) দক্ষতা

ড. মুহাম্মাদ মোহন মিয়া | Oct 12, 2020 05:26 pm
মদিনা শরিফ

মদিনা শরিফ - ছবি সংগৃহীত

 

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সব সমস্যার সমাধান রয়েছে ইসলামে। তাই ইসলামে কূটনৈতিক ব্যবস্থা থাকাও স্বাভাবিক। ইসলামের দৃষ্টিতে কূটনীতি হলো- ওই সব নীতি বা কাজ যেখানে ইসলামী নিয়মনীতি মেনে চলা হয়। ইসলামী নৈতিকতা সমর্থন করে না এমন বিষয় যেমন- প্রবঞ্চনা, মিথ্যা, ধূর্তামি পরিত্যাগ করে ইসলামী রাষ্ট্র ও এর অধিবাসীদের কল্যাণে অন্যান্য রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়ের সাথে নিবিড় ও যৌক্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় যে নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয় তাকে ইসলামী কূটনীতি বলা হয়।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। বিভেদ, হানাহানি, শত্রুতাসহ যাবতীয় খারাপ কাজ ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই ন্যায়, ইনসাফ ও সমতার ভিত্তি হচ্ছে ইসলামী কূটনীতির মূল। মুসলমানরা ইসলাম প্রদর্শিত কূটনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ইনসাফভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং পরস্পরের মধ্যে বিবাদসমূহ ন্যায় ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করবে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রক্ষার্থে শুরু হয় এর বাস্তব কার্যক্রম। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা: স্বয়ং কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি বিভিন্ন দেশ ও রাজন্যবর্গের সাথে দূত ও প্রতিনিধি পাঠানোর মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালান। পরবর্তী সময়ে খলিফা ও রাষ্ট্রপ্রধানরা মহানবী সা: প্রতিষ্ঠিত পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন। ফলে ইসলামী কূটনীতির সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠার প্রভাব মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। এ জন্য দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে একত্রিত হয় এবং একের পর এক রাষ্ট্র ইসলামী সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। কিন্তু কালের চক্রে দেশে দেশে শুরু হয় দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত আর হানাহানি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। এর অন্যতম কারণ ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম থেকে বিচ্যুতি। এই প্রেক্ষাপটে আজ নতুন করে ইসলামী কূটনীতির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।

ইসলামের আগমনের আগে গোটা বিশ্ব নৈতিক অবক্ষয়ের তলানিতে অবস্থান করছিল। তখন মুক্তির বারতা নিয়ে দুনিয়ায় আসেন মহানবী সা:। তিনি নৈতিকতার উৎকর্ষের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। মহানবী সা: কূটনীতির ক্ষেত্রেও নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেন। কূটনীতির ক্ষেত্রে মুহাম্মদ সা: ১৪০০ বছর আগে যে ভূমিকা পালন করেন তা তার কথায় ফুটে উঠেছে। যেমন তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই অন্যায় পরিত্যাগ করি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায় করব না, কারণ দুটো অন্যায়ের ফল ভালো হতে পারে না।’

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নবী করিম সা: বিভিন্ন সময় দেশে দেশে দূত বা কূটনৈতিক প্রতিনিধি পাঠাতেন। কুরাইশরা আবিসিনিয়ায় আশ্রয়গ্রহণকারী মুসলমানদের তাদের হাতে অর্পণ করার জন্য নাজ্জাশিকে প্ররোচিত করেছিল। তাদের এ দুরভিসন্ধি বানচাল করার উদ্দেশ্যে নবী করিম সা: দ্বিতীয় হিজরিতে আমর বিন ওমাইয়া আদ-দামরিকে আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) পাঠান। মহানবী সা: দ্বীনের কাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ পরস্পরবিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্বকে সমন্বয় করার কাজ করতে গিয়ে একজন সফল কূটনীতিকের পরিচয় দেন। তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গিয়ে শুরু করেন দ্বীন প্রচারের কাজ।

সেখানকার সমাজ নানান গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত ছিল। তাই মদিনায় সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্য তাঁর প্রথম কাজ ছিল সেখানে একটি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা। ফলে মদিনাবাসী ও ইহুদিদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করা ছিল খুব জরুরি। প্রথমবারের মতো তিনি একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এ গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিকে ‘মদিনার সনদ’ বা পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান বলে আখ্যায়িত করা হয়। মদিনা সনদে ¯পষ্টভাবে স্বীকার করা হয় যে, সব রকমের বিবাদ মীমাংসার জন্য নবী সা:-এর শরণাপন্ন হতে হবে। এ সম্পর্কে মন্টোগোমারি ওয়াট যথার্থই বলেছেন, ‘বিবাদ মীমাংসার জন্য নবী সা:-এর শরণাপন্ন হওয়ার শর্ত থাকার জন্য তাঁর শক্তি বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু সব বিবাদের মীমাংসা তিনি এমন নিখুঁত ও কূটনৈতিকভাবে সমাধান করতেন যা সর্বসম্মতিক্রমে
গৃহীত হয় এবং এ কারণে তাঁর ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।’

মহানবী সা: মক্কার সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন মদিনায় হিজরতের মাধ্যমে। ফলে দ্বীন প্রচারের জন্য কুরাইশদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা ছিল খুব জরুরি। কুরাইশদের সাথে আলোচনায় মহানবী সা: সবচেয়ে বেশি কূটনৈতিক সফলতা অর্জন করেন হুদাইবিয়ার চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। হিজরতের ছয় বছর পর এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। ৬২৮ সালে নবী করিম সা: প্রায় চৌদ্দ শ’ মদিনাবাসীকে নিয়ে হজব্রত পালনের জন্য মক্কার পথে যাত্রা করেন। কিন্তু মক্কাবাসী প্রথা লঙ্ঘন করে মদিনাবাসীদের বাধা দেয়। উল্টো তারা মদিনাবাসীদের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেয়।

এ সময় মহানবী সা: হুদাইবিয়ায় শিবির স্থাপন করেন। মহানবী সা: তখন কূটনৈতিক তৎপরতার আশ্রয় নেন। সমস্যা সমাধানকল্পে মহানবী সা: মক্কায় একজন দূত পাঠালে কুরাইশরা নবীর দূতের উটকে হত্যা করে এবং মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্য সেনা পাঠায়। মুসলমানরা তাদের বন্দী করে রাখে। কিন্তু তবুও মহানবী সা: প্রতিশোধ না নিয়ে কূটনৈতিকভাবে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। এরপর মহানবী সা: পুনরায় উসমান রা:-কে দূত হিসেবে মক্কায় পাঠান। কুরাইশরা তাকেও আটক করে রাখে এবং কয়েকদিন পর গুজব রটে যে, উসমান রা:-কে হত্যা করা হয়েছে। এ খবর পাওয়ার পর সাহাবিদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা এই হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

অবশেষে মহানবী সা: সাহাবিদের নিয়ে দূত হত্যার বদলা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক তখনই শান্তি আলোচনার জন্য কুরাইশদের দূত এসে উপস্থিত হয়। বহু আলোচনার পর বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে সন্ধিচুক্তি স¤পাদিত হয়, যা ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। উপরোক্ত আলোচনায় নবী করিম সা:-কে আমরা একজন বিজ্ঞ কূটনীতিক হিসেবে দেখতে পাই। অত্যন্ত নাজুক ও বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও স্বীয় মর্যাদা ও অবস্থান বজায় রেখে এবং দ্বীনি মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে আদর্শের বাস্তবায়নের প্রত্যয়ে আল্লাহর নবী কতটা পারদর্শী ছিলেন তা তাঁর এসব কর্মকাণ্ড থেকে অনুধাবন করা যায়। একজন আদর্শ কূটনীতিকের পরিচয় আমরা পাই আল্লাহর নবী সা:-এর চরিত্রে। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, মহানবী সা: তাঁর কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অবস্থাভেদে কখনো দৃঢ়তা অবলম্বন করেছেন, কখনো বা নম্রতা প্রদর্শন করেছেন। অর্থাৎ মহানবী সা: প্রয়োজনবোধে সময়োচিত ব্যবহার করতে সক্ষম ছিলেন। দার্শনিক ও বাস্তববাদী ব্যক্তির গুণের এক অপূর্ব সমাবেশ ছিল তাঁর মধ্যে। স্বীয় অনুসারীদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করে দ্রুত তথা আড়ম্বরহীন পদ্ধতিতে আলোচনা চালিয়ে তিনি এমন এক চুক্তি সম্পাদন করেন যা দূরদৃষ্টি, ধৈর্য, বিশ্বাস, কৌশল ও ন্যায়বিচারের আদর্শ হিসেবে বিবেচ্য।

মহানবী সা:-এর জীবনে কূটনৈতিক সফলতার আরো অনেক নজির ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। স্থান সঙ্কুলানের অভাবে আমরা সেসব আলোচনা করতে পারছি না। মহান আল্লাহ আমাদের পরিচ্ছন্ন ও ইনসাফভিত্তিক কূটনীতির এই উদাহরণ স্থাপন করে শান্তি ও সহাবস্থান বিধান করার তৌফিক দান করুন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সিনিয়র ব্যাংকার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us